ওরা আলাদা আলাদা ভাবে, আলাদা আলাদা ভাবে একত্রে বিবিধ ছড়া মুখে নিয়ে বড় হয়,
চাঁদ উঠেছে ফুল ফুটেছে,
কদম তলায় কে?
হাতি নাচে ঘোড়া নাচে
সোনামণির বে।
কিংবা
হাট্টিমা টিম টিম,
তারা মাঠে পাড়ে ডিম!
তাদের খাড়া দুটো শিং,
তারা হাট্টিমা টিম টিম।
বিবিধ ছড়া তাঁদের মুখ থেকে মগজস্থ হতে সময় লাগে। কারো এক বছর, কারো পনেরো বছর, কারো বিশ কিংবা একশো বছর। কেউ কেউ তাঁদের দেখে তখন বলে— এরা তো বড় অইগেছে; লাফাঙ্গা ফুয়াইন। লাফাঙ্গা ছেলেদের কাছে জীবন তখন আশ্চর্য মনে হয়। তারা দেখে সরলতার ভাজে ভাজে রাজনীতি, কুটিলতা। তারা দেখে হাট্টিম আর টিম টিম দুজনে আলাদা আলাদা কিন্তু কর্ম এক— মাঠে ডিম পাড়া। তারা আলাদা আলাদা ভাবে, আলাদা আলাদা ভাবে একত্রে বিভিন্ন সময়ে চিন্তা এবং যাপিত জীবনে একসাথে কর্ম করে। তারা বাজারের সিডির দোকানে একত্রে যায়, একটা ক্যাসেট যেখানে একসাথে রনজিত মল্লিক কি তাপস পাল কিংবা আলাদা আলদা ভাবে রনজিত মল্লিক আর তাপস পালের সিনেমার ক্যাসেট ভাড়া করে আনে। একই মুহূর্তে তারা একজন কিংবা আলাদা আলাদা ভাবে ভিন্ন জন একটা নীল ছবির ক্যাসেট মেরে দেয়, লুকিয়ে ফেলে। তারা আলাদা আলাদা ভাবে, আলাদা আলাদা ভাবে একত্রে বিভিন্ন পথ কিংবা একই পথে বিভিন্ন সময়ে একজনের বাসায় একত্রিত হয়ে রনজিত মল্লিক কিংবা তাপস পাল অথবা রনজিত মল্লিক তাপস পালকে একসাথে একপাশে রেখে নীল ছবি দেখা শুরু করে। তখন আলাদা আলাদা ভাবে, আলাদা আলাদা ভাবে একত্রে তারা হস্তমৈথুন শিল্পে পারদর্শি হয়ে উঠে। তারা যেনো একেকজন একেক সত্ত্বা, হাট্টিম আর টিম টিমের মতোন। বিশ ইঞ্চি রঙিন টেলিভিশনের পর্দায় শেতাঙ্গ উলঙ্গ নারীকে ব্যবচ্ছেদকৃত শিশ্নের দিকে তাকিয়ে তারা ভাবে এই শিশ্ন নিজের। কেউ কেউ উদ্যত শিশ্ন মুষ্ঠিতে ভরে দেখে তাঁদের শিশ্ন পলকহীন, কেউ কেউ বিছানার সাথে মিলনে, কেউ কেউ শিশ্নকে দুই উরুর মাঝখানে ঘষে মৈথুন বিশেষজ্ঞের স্থান লাভ করে। এইরূপ সরল জীবনযাপনে তারা অভ্যস্ত হয়ে উঠে, তারা আলাদা আলাদা ভাবে, আলাদা আলদা ভাবে একত্রে স্কুল পালিয়ে বিমানের দোকানে আলাদা আলাদা ভাবে, আলাদা আলাদা ভাবে একত্রে পাঁচ টাকা দামে টিকেট খরিদ করে বাংলা সিনেমা দেখে; আলাদা আলাদা ভাবে, আলাদা আলাদা ভাবে একত্রে তাঁদের প্রিয় নায়ক হয় মান্না, প্রিয় খল ডিপজল। তারা হয়ত প্রেমিকা কিংবা প্রেমিকাদের সাথে ডেট করতে যায় লুঙ্গী পড়ে; ভোজনালয়ে কন্যা কিংবা কন্যাদ্বয়ের লজ্জারা জানতে চায় প্যান্ট কই? তারা আলাদা আলাদা ভাবে, আলাদা আলাদা ভাবে একত্রে উত্তর দেয়— ছাদে শুকাতে দেয়া কাপড়ের সাথে প্যান্ট কিংবা প্যান্টগুলো সকালের তুফানে উড়ে গেছে এবং আকাশি গাছের ডালে ঝুলে আছে কিন্তু ডাল থেকে বিবিধ সময় ডাব চুরির অভ্যাস থাকলেও তারা জানায় প্যান্ট কিভাবে আকাশি গাছে ধরে সেটা তারা জানে না। প্রেমিকা কিংবা প্রেমিকারা তখন আলাদা আলাদা ভাবে, আলাদা আলাদা ভাবে একত্রে তাঁদের জিন্দাবাজারে ভিন্ন ভিন্ন দোকান ঘুরে জিন্স প্যান্ট কিনে দেয়। তারা আলাদা আলাদা ভাবে, আলাদা আলাদা ভাবে একত্রে তাঁদের বড় আব্বার কলিকাতা যাওয়া গল্প বলে; সময় তখন সংগ্রামের পূর্বে, বড় আব্বা নানা ঘাটে টাকা ফেলে শেষে যখন কলকাতার বন্দরে পৌঁছালেন তখন সবচেয়ে দামি, পাঁচ টাকা মূল্য পরিশোধ করে এক পিয়ালা বাঘের দুধ খেয়ে ছিলেন; তারা জানায় বাঘের দুধ খাওয়ার পরেই বড় আব্বার রাগ প্রচন্ড মাত্রায় বেড়ে গেলে ঘুষি দিয়ে হাতি মারার ক্ষমতা প্রাপ্তি হয়। বড় আব্বার গল্প বলে তাঁদের একত্রে সিনা টানটান হয়ে যায়। তারা আলাদা আলাদা ভাবে, আলাদা আলাদা ভাবে একত্রে মাইক্রোল্যাব এমপি-ত্রি প্লেয়ারে ফকির লাল মিঁয়ার গান শুনে,
রাস্তার মাজে ফয়লা দিনউ দেইক্যা মনো অইছে,
আসমান তনে উস্টা খাইয়া ফড়ি একগু ফরছে!
কিতার লাগি সামনে আইয়া মাথা নষ্ট করছে,
আসি দেইক্যা কইলাম আমার বারোটা আইজ বাজছে।
বিষ মাখাইয়া তীরের মুখও আমার বুকও মারছে,
অউ ফয়লা একগু ফুড়ি দেইক্যা অতো বালা লাগছে,
আল্লায় তোমার মুখটা দেখবার লাগিই আইজ বাঁচাইয়া রাখছে,
হাছন রাজায় গানর মাজে তোমার কথা লেখছে।
আলাদা আলাদা ভাবে, আলাদা আলাদা ভাবে একত্রে তারা ভাবে কবে বয়স হবে প্রেম করার; তারা সম্মতি হয়, লাল মিঁয়া একটা মাল। এসএসসি পরীক্ষা প্রেমিকার মতোন দুয়ারে টোকা দিলে তারা সেই প্রেমিকার মুখ দেখতে চায় না, বিহ্বলতায় ভোগে। তাঁরা দেখে নকলের সুবিধা আছে, কলজের, পাড়ার সিনিয়র ভাইয়েরা স্কুলের টয়লেট প্রাঙ্গনে, টয়লেটের চালের উপরে-দেয়ালে বই আর প্রশ্ন নিয়ে বাজার বসালে সেখানে একটা গোল্ড লিফের বিনিয়ময়ে নকল সাপ্লাই পাওয়া গেলে তারা আলাদা আলাদা ভাবে, আলাদা আলাদা ভাবে একত্রে নকল করে জিপিএ-৫ প্রাপ্তির সুখ পায়। আলাদা আলাদা ভাবে কিংবা সমষ্টির চেতনা এইভাবে তাদের মুখে লেগে থাকা ছড়ারাও বড় হতে থাকে। আলাদা আলাদা ভাবে, আলাদা আলাদা ভাবে একত্রে একদিন একটি ছড়া তাঁদের বিশেষ মনে হয়, তারা ভাবে-বলে,
ঘুম পাড়ানি আমসি-পিসি
মোদের বাড়ি এসো,
খাট নেই পালং নেই
চোখ জুড়ে বসো…
তাঁদের বড় হতে থাকা সরল জীবনে নীল ছবির সাদৃশ পায় ছড়ার ভেতরে। নীল সিনেমায় তারা দেখে বিবিধ নারী-পুরুষ সম্পর্কের শেকল ভেঙে মিলিত হয়; তাঁদের কাছে ঘুম পাড়ানি মাসি কিংবা পিসিকেও একই মনে হয়, যিনি তার যোনি মুখে চেপে ধরতে পারেন। তারা আলাদা আলাদা ভাবে, আলাদা আলাদা ভাবে একত্রে হেসে উঠে, দারুণ কিছু আবিষ্কার করেছে ভেবে গর্বিত হলে শারীরিক উষ্ণতার আড়ালে টের পায় শীত নামছে। শীতের সময়ে কোনো এক বছরের ১৬ই ডিসেম্বরকে সামনে রেখে তারা আলাদা আলাদা ভাবে, আলাদা আলাদা ভাবে একত্রে বিবেচনা করে যে একটা পোস্টার ছাপানো দরকার। তারা তখন সমগ্র মিলে একটি দল এবং আত্মপ্রকাশ করতে চায় এবং এই শীত এবং ১৬ই ডিসেম্বর মারাত্মক সুন্দর ও মুখ্যম সময় বলে বিবেচনা করে। তারা টাইপিং এন্ড প্রিন্টিং জোন নামক এক দোকানে হাজির হয় এবং আকুতি জানায় একখানা চমকপ্রদ পোস্টার তৈরি করে দেয়ার। “মহান স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা” লেখা সমেত একটা টানা বন্দুক ও বাংলাদেশের পতাকার গ্রাফিকাল ইমেজ সমেত,
মা গো, ভাবনা কেন
আমরা তোমার শান্তি প্রিয় শান্ত ছেলে
তবু শত্রু এলে অস্ত্র হাতে ধরতে জানি
তোমার ভয় নেই মা আমরা প্রতিবাদ করতে জানি।…
গানের লাইন সমেত একখানা পোস্টার তৈরি হয়ে এলে তারা আলাদা আলাদা ভাবে, আলাদা আলাদা ভাবে একত্রে দেখে কি জানি নাই নাই পোস্টারে। খানিক চিন্তার পর পাওয়া যায় পোস্টারটি প্রচারে কে কিংবা কারা সেটার উল্লেখ নাই এবং পোস্টারটি সংশোধনের জন্য দেয়া হলে সেখানে নামের প্রয়োজন পরলে তারা আলাদা আলাদা ভাবে, আলাদা আলাদা ভাবে একত্রে নামগুলো বলে গেলে মোট বারোটি নাম পাওয়া যায় এবং ১৫ই ডিসেম্বর সন্ধ্যায় পোস্টারটি তৈরি হয়ে গেলে তারা মোট ১০০ কপি রঙিন পোস্টার ছাপিয়ে দোকানে দাম চুকিয়ে দিয়ে খুশিতে গদগদ হয়ে দোকান থেকে বের হয়ে এসেই সমস্যার মধ্যে ঢুকে যায়। তাঁদের পোস্টার দেয়ালে লাগানোর জন্য আঠার প্রয়োজন পড়ে এবং তারা আলাদা আলাদা ভাবে, আলাদা আলাদা ভাবে একত্রে পকেট হাত দিয়ে দেখে সেখানে আরামে ঘুমাচ্ছে শূন্য সংখ্যা যেনো নিগূড় মাতৃগর্ভ। তারা তখন তাঁদের নীল ছবি কিংবা ডাব হস্তগত করার বিদ্যা কাজে লাগিয়ে দোকান থেকে একখানা আঠার বোতল কব্জা করে ফেললে আপাত দৃষ্টিতে সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। তারা প্রথমে খেয়া ঘাটে পোস্টার লাগানো শুরু করলে সবে মাত্র সন্ধ্যা রাত। এরপর তারা একে একে বয়েজ স্কুলের বাইরের দেয়াল, স্কুলের ভেতরে বিভিন্ন দেয়াল, মূল বাজারের বিভিন্ন দোকানের দেয়াল, বৈদ্যতিক পিলার, থানা, রেস্ট হাউজ হয়ে গার্লস স্কুলের সামনে এসে হাজির হয়। গার্লস স্কুলের প্রবেশ পথে তারা আলাদা আলাদা ভাবে, আলাদা আলাদা ভাবে একত্রে হাতের সকল অবশিষ্ট পোস্টারগুলো লাগিয়ে দিয়ে খুশিতে ঝিকমিক করে উঠলে তখন মধ্যরাত, মধ্যরাত মানে ১২টা বেজে গেছে, ১২টা মানে বিজয় দিবস শুরু হয়ে গেছে। বিজয় দিবসের শুরুর লগ্নে, গার্লস স্কুলের প্রবেশপথে তাঁদের জ্বলন্ত পোস্টারগুলো থেকে একটা সমস্যা স্বাধীন চেতা হয়ে আত্মপ্রকাশ করে; তাঁদের মধ্যে একজন জানায় তার নাম মাঝখানে কেনো? সকাল বেলা স্কুলের মেয়েরা হাঁটা পথে হয় প্রথম দিকের নাম অথবা শেষের দিকের নাম পড়বে; মাঝের নামগুলো কেউ পড়বে না। এই অভিযোগ উঠার পর পরেই অনেকের মধ্যে পরিচয় সংকট তৈরি হয়ে গেলো। তারা ভাবলো নামগুলো ক্রম অনুসারে আসা উচিত। তারা ভাবলো নামের ক্রম ঠিক করার কোনো উপায় নেই, তারা সবাই এক, তারা বন্ধু, তারা হাট্টিম আর টিম টিমের মতোন নির্দিষ্ট কাজ করে, তারা স্কুল পালায়, তারা বিমানের দোকানে বাংলা সিনেমা দেখে, তারা ফকির লাল মিঁয়ার গান শুনে, তারা নীল ছবি দেখে, তারা হস্তমৈথুনে বিবিধ ডিগ্রি প্রাপ্ত কিন্তু তাঁদের ক্রম ঠিক করে পোস্টারে নাম আগপিছু করার কোনো উপায় জানা নেই। এইরকম অবস্থায় কথা কাটাকাটি শুরু হলে তারা প্রথমবারে মতোন বোধ করে তারা আলাদা আলাদা ভাবে এবং আলদা আলাদা ভাবে একত্রে আর থাকছে না; তারা কথাকে কেটে ফেলার মজা পেয়ে যায় এবং এক সময় উগ্র হয়ে গার্লস স্কুলের প্রবেশ পথের সকল পোস্টার ছিঁড়ে ফেলে যে যার বাড়ির পথে রওনা দিলে তারা উপলব্ধি করে তারা কোনো দিনই সমগ্র ছিলো না, তারা দল নয়, তারা একেকজন একেকটা আলাদা মানুষ এবং তার আর কোনো দিনই আলাদা আলাদা ভাবে একত্রিত হতে পারবে না।
১৬ই ডিসেম্বরের সকালে একদল মানুষ অবাক হয়ে লক্ষ করে বাজারের দেয়ালে, বৈদ্যুতিক পিলারে, খেয়া ঘাটে, বয়েজ স্কুলের দেয়ালগুলোতে একটা কালচে সাদা কাগজ লাগানো যার লেখাগুলো রাতের শিশির ভেজা হয়ে বিছিন্ন রঙ হয়ে উঠে গেছে।
সেসব মানুষদের জীবদ্দশায় কেউ জানেনি, পোস্টারটায় ভেজা রঙের আঁকিবুকি বন্ধুত্ব ভাঙার গল্প। জনতা রঙের খেয়াল পড়তে জানেনা, তারা হাসে, তারা আলাপ করে- কোন গরুচোদা ফাগলের কাম আন্তাজি খাগজ লাগাইয়া ওয়াল অগুইন ভরাইছে।