ফ্যান্টাসি জনরা পরিচিতি প্রথম পর্ব- লিখেছেন- আশরাফুল সুমন
পর্ব ১
ফ্যান্টাসি জনরা এবং এর শ্রেণিবিভাগ
জনরা মানে কী?
এই শব্দটির উৎস ফ্রেঞ্চ ভাষা। জনরা বলতে সাহিত্য, শিল্প বা সঙ্গীতের নানা ধরণের শ্রেণীকে বোঝায়।
শিল্প, সঙ্গীত বা সাহিত্যের একটি শৈলী বা বিভাগ।
ফ্যান্টাসি কী?
জাদুর দুনিয়ায় ম্যাজিক ব্রুমে চড়ে বেড়ানো চশমাপরা ছেলেটিকে কে না চেনে? বিশ্বের সর্বকালের সর্বাধিক বিক্রিত সিরিজটির সম্পর্কে জানে না এমন লোক খুঁজে পাওয়াটাই তো বিস্ময়কর। সিরিজটির নাম নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন? জে. কে. রোওলিং-এর অমর সৃষ্টি, বিখ্যাত হ্যারি পটার।
লর্ড অব দ্য রিংস কিংবা দ্য হবিট-এর মুভিগুলো একবারও দেখেননি এমন খুব বেশি লোক কি পাওয়া যাবে? ভালো লাগুক আর না লাগুক, অন্তত একটা দৃশ্য হলেও সবার দেখা আছে। পৃথিবীর অন্যতম বিখ্যাত টিভি সিরিজ গেম অব থ্রোনস সম্পর্কে শোনেনি, এমন লোক খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর।
উপরে উল্লিখিত প্রত্যেকটিই হচ্ছে ফ্যান্টাসি। যারা ফ্যান্টাসি সম্পর্কে ভালো করে জানে না, তাদেরকে উপরের চারটি নাম বললেই বুঝে ফেলবে যে ফ্যান্টাসি গল্প কোনগুলোকে বলা হয়।
কিন্তু তারপরেও, একে সংজ্ঞায়িত করতে হলে কীভাবে করবো?
যেসব গল্পে জাদু, জাদুময় প্রাণী, দেবতা, দানব, আলাদা জগত এবং বিভিন্ন আজগুবি ব্যাপার ঘটতে দেখা যায় যা বাস্তবে সম্ভব নয়, সেগুলোকে ফ্যান্টাসি বলা হয়।
ফ্যান্টাসিতে কি ম্যাজিক আবশ্যক?
এ প্রশ্নের জবাব দিতে হলে প্রথমে আপনাকে বুঝতে হবে, ফ্যান্টাসির ম্যাজিক হয় দুরকম: প্রত্যক্ষ ম্যাজিক এবং পরোক্ষ ম্যাজিক।
হ্যারি পটার-এর ম্যাজিক স্পেল, পার্সি জ্যাকসন-এ ডেমিগডদের বিশেষ ক্ষমতা, মিস্টবর্ন-এর এলোমেন্সি, স্টর্মলাইট আর্কাইভ-এর সার্জবাইন্ডিং, অক্টারিন-এর ক্যাওস ম্যাজিক—এগুলো প্রত্যক্ষ ম্যাজিক। কথাবলা প্রাণী, উড়ন্ত কার্পেট, জাদুময় প্রাণী, দেবতা, দানব, জাদুর অস্ত্র—এগুলো পরোক্ষ ম্যাজিক। উপরে উল্লিখিত সবগুলোকেই ফ্যান্টাসির ‘উপাদান’ হিসেবে ধরা হয়। খেয়াল করে দেখুন, এখানে যে উপাদানগুলোর কথা বলা হচ্ছে, সেগুলোর কোনোটিই পার্থিব বা জাগতিক উপাদান নয়, প্রত্যেকটিই ‘অবাস্তব’ উপাদান। আর কোনো গল্প ফ্যান্টাসি হবে কি হবে না তা নির্ভর করে তাতে থাকা উপাদানগুলোর উপর; সেগুলো কি বাস্তব নাকি অবাস্তব? অবাস্তব হলে সেগুলোর পরিমাণ কেমন? গল্পে তাদের ভূমিকা কেমন? এই প্রশ্নগুলোর উত্তরের উপর নির্ভর করে যে কোনো গল্পকে ফ্যান্টাসি বলা হবে কি হবে না।
তবে এর অর্থ কি এই যে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ম্যাজিক না থাকলে তাকে ফ্যান্টাসি বলা যাবে না?
হ্যাঁ এবং না। উত্তরটা আসলে এত সহজ না। যদি আপনার গল্পের সেটিংস এই পৃথিবী না হয়ে আপনার তৈরি করা কোনো পৃথিবী হয়, যে পৃথিবীতে অনেক জাতি আছে, আপনার বানানো হাজার বছরের পুরোনো ইতিহাস আছে, আলাদা সংস্কৃতি আছে, তবে সেক্ষেত্রে অবশ্যই ফ্যান্টাসি—ম্যাজিক না থাকলেও। হ্যাঁ, প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ উভয় ধরনের ম্যাজিকের কথাই বলছি। আপনার গল্পের সেটিংস যদি সেকেন্ডারি ওয়ার্ল্ড হয়, মানে সেটিংস যদি এমন এক পৃথিবী হয় যেটা আমাদের এই জগত না, লেখকের কল্পনায় সৃষ্ট ভিন্ন জগত, এবং সেটা যদি টেকনোলজি নির্ভর না হয়, তবে সেটা এমনিতেই ‘অবাস্তব’। আগেই বলেছি এই অবাস্তবকে ফ্যান্টাসির উপাদান হিসেবে ধরা হয়। ফ্যান্টাসির স্কেলে এই অবাস্তব উপাদান কিন্তু ছোটখাটো নয়, আস্ত একটা জগত, ফ্যান্টাসি উপাদান হিসেবে তাই এর ভরও কিন্তু বেশি। এই জগত তাই নিজেই একটা পরোক্ষ ম্যাজিক। অবাস্তব উপাদান কম থাকার কারণে এই ধরনের গল্পকে ট্যাগ দেওয়া হয় ‘লো ফ্যান্টাসি’ হিসেবে। এরকম কিছু ফ্যান্টাসি এখন বেশ জনপ্রিয় হয়েছে।
এ সং অব আইস অ্যান্ড ফায়ার সিরিজের প্রথম বই এ গেম অব থ্রোনস-এর কথাই ধরুন। পুরো বইটা লেখা হয়েছে এমন এক জগতে যা আমাদের বাস্তব জগতের কাছাকাছি, আর কাহিনি আবর্তিত হয়েছে মূলত সিংহাসনের দখল আর রাজনীতি নিয়ে। সেখানে প্রত্যক্ষ ম্যাজিক বলতে একটা দৃশ্যে মিরি মায দুরের ব্লাডম্যাজিক এবং পরোক্ষ ম্যাজিক বলতে দুয়েকটা দৃশ্যে থাকা হোয়াইট ওয়াকার আর একদম শেষের দিকের ড্রাগন। এরপরেও সেটা ফ্যান্টাসি। মার্টিন যদি এই ‘ম্যাজিক’-টুকুও সরিয়ে নিতো, এরপরেও সেকেন্ডারি ওয়ার্ল্ডের উপস্থিতির কারণে একে ফ্যান্টাসিই বলা হতো।
আচ্ছা, গল্পের কাহিনি সেকেন্ডারি ওয়ার্ল্ডে না হয়ে যদি এমন এক জগতে সংঘটিত হয় যেটা এই পৃথিবীরই কোনো দূর ভবিষ্যৎ বা পোস্ট-এপোক্যালিপ্টিক ভার্শান? এই ধরনের বেশ কিছু ফ্যান্টাসি এখন বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। যেমন, দ্য শ্যাটার্ড সি ট্রিলোজি পড়লে বোঝা যায়, এটা আসলে ঠিক আলাদা জগতের কাহিনি না, এখানকার মিথ আর অতীতের (মানে আমাদের বর্তমানের) বিভিন্ন কিছুর রেফারেন্স টানার মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি যে এটা আসলে আমাদের পৃথিবীই। যে পৃথিবী এক মহাদুর্যোগে ধ্বংস হয়ে সভ্যতা আবারো পেছনে চলে গেছে। পোস্ট-এপোক্যালিপ্টিক ভার্শান। এই ধরনের কনসেপ্ট নতুন, সেটা এসেছে মার্ক লরেন্স আর জো এবারক্রোম্বির মতো লেখকদের জনরা বাউন্ডারিকে পুশ করার মাধ্যমে। এই ধরনের গল্পে ম্যাজিক থাকে খুবই কম, বা একেবারে থাকেই না। যেমন জো এবারক্রোম্বির দ্য শ্যাটারড সি ট্রিলজি পুরোপুরিভাবে ম্যাজিকবিহীন গল্প। ওখানে আলাদা জাতি, আলাদা ইতিহাস ও সংস্কৃতি, ভিন্ন ধরনের ধর্মীয় বিশ্বাস আছে। সেখানে ‘এলফ ম্যাজিক’ বলতে যা বোঝায়, তা আসলে টেকনোলজি (এর উপস্থিতির কারণে কেউ কেউ আবার একে সাই-ফাইতেও ফেলতে চায়, তবে সেটা ভিন্ন তর্ক)। এরপরেও এটা ফ্যান্টাসি কেন? প্রকাশনী একে ফ্যান্টাসি বলে, সব জায়গায় একে এপিক ফ্যান্টাসি হিসেবে ট্যাগ দেওয়া হয়, কিন্তু কেন? কারণ এই কাহিনি পৃথিবীর দূর ভবিষ্যতের হলেও জগতটা আমাদের পরিচিত পৃথিবী থেকে ভিন্নতার কারণে সেকেন্ডারি ওয়ার্ল্ডের মতোই একটা ভিন্ন জগতের অনুভূতি উপহার দেয়। এই কারণেই ম্যাজিক থাক বা না থাক, এটাকেও ফ্যান্টাসিই ধরা হয়।
আর যদি প্রেক্ষাপট অনেক অনেক অতীতের কোনো পৃথিবীর হয়? আমরা জানি যে জে আর আর টোলকিনকে প্রথম পূর্ণাঙ্গ হাই ফ্যান্টাসি জগত বা সেকেন্ডারি ওয়ার্ল্ড সৃষ্টির জন্য কৃতিত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু মজার ব্যাপার কী জানেন? তিনি দাবি করেছেন যে তার মিডল আর্থ আসলে আলাদা কোনো জগত না, অনেক অনেক অতীতের কোনো এক অজানা সময়ের পৃথিবী, যে পৃথিবীতে তখন জাদু আর জাদুর প্রাণীদের অস্তিত্ব ছিলো। কিন্তু এরপরেও মিডল আর্থকে সেকেন্ডারি ওয়ার্ল্ডের মর্যাদা দেওয়া হয় আমাদের পরিচিত পৃথিবী থেকে এর উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ভিন্নতার কারণে। আর দ্য শ্যাটার্ড সি-এর উদাহরণ থেকে আমরা বুঝতে পারছি, যদি মিডল আর্থে ম্যাজিক না-ও থাকতো, এরপরেও এই ভিন্নতার জন্যে একে ঠিকই ফ্যান্টাসির মর্যাদা দেওয়া হতো।
তার মানে কোনো গল্পে ম্যাজিক না থাকলেও ফ্যান্টাসি হতে পারে যদি এর সেটিংস ১) কাল্পনিক জগত হয়, ২) পৃথিবীর পোস্ট-এপোক্যালিপ্টিক ভার্শান হয় অথবা, ৩) অনেক অতীতের কোনো অজানা সময়ের হয়। এই তিন ক্ষেত্রেই শর্ত হচ্ছে, সৃষ্ট জগত হবে এমন যে এর সাথে বর্তমান পৃথিবীর ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক, ভাষাগত এবং সাংস্কৃতিক দিকে লক্ষণীয় মাত্রায় পার্থক্য থাকবে এবং জগতটা তার ভিন্নতার মাধ্যমে সেকেন্ডারি ওয়ার্ল্ডের অনুভূতি জাগাবে।
আর যদি কাহিনি আমাদের এই পৃথিবীর হয়? এক্ষেত্রে কোনো গল্প ফ্যান্টাসি কি না তা নির্ণয় করাটা সত্যিই অনেক অনেক কঠিন। এখানে সহজ সূত্রটা হচ্ছে, আপনার গল্পে ফ্যান্টাসি উপাদান কী পরিমাণে আছে এবং তাদের কাহিনিতে প্রভাব কতটুকু—এই দুটো প্যারামিটারের উপর ভিত্তি করে বলা। কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে, ফ্যান্টাসি উপাদান নির্ণয় করাটা আরো কঠিন।
কোনটাকে ফ্যান্টাসি উপাদান বলবেন? ধরেন একটা সাধারণ উপাদান নিলাম, ভ্যাম্পায়ার। আমরা জানি ভ্যাম্পায়ার বলে কিছু নেই, এর অস্তিত্বে কেউ বিশ্বাস করে না। আর তাই উপাদানটা ‘কাল্পনিক’, এবং সে কারণে একে আমরা ফ্যান্টাসি উপাদান বলতে পারি।
হ্যাঁ এবং না।
সহজ একটা গল্পকে উদাহরণ হিসেবে ধরি। এই ধরনের গল্প এতই কমন যে আমরা অনলাইনে প্রায়ই এই প্যাটার্নের গল্প পড়ে থাকি।
আপনার গল্পের মূল চরিত্র কারো ক্ষতি করার উদ্দেশে রাস্তায় বেরিয়েছে। যার ক্ষতি করবে তাকে সে বাসায় নিয়ে এলো। অস্ত্র বের করে হুমকি-ধামকি দিলো। আর তারপর হঠাৎ হেসে উঠলো বিপদে পড়া ব্যক্তি, বেরিয়ে এলো তার শ্বদন্ত। দড়ি ছিঁড়ে সে কামড় বসালো মূল চরিত্রের গায়ে। একটি সাধারণ ভ্যাম্পায়ার স্টোরি। এখন এই গল্পকে আমরা ফ্যান্টাসি বলবো কি না।
প্রথম প্রশ্ন হলো, আপনার গল্পে ফ্যান্টাসি উপাদান কী পরিমাণে আছে? এটার উত্তর খুঁজে নেই আগে। ভ্যাম্পায়ার ফ্যান্টাসি উপাদান হতে পারে, আবার সে কিন্তু একই সাথে সুপারন্যাচরাল আর হররেরও উপাদান। ফ্যান্টাসি, সুপারন্যাচরাল আর হরর কিন্তু একই জনরা না। তবে এরা প্রায়ই একই সাধারণ উপাদান শেয়ার করে, আর বিভ্রান্তিটা সৃষ্টি হয় ঠিক এই কারণেই।
তাহলে আপনার গল্প কোন জনরায় পড়বে, তা নির্ভর করবে উপাদানটাকে আপনি ঠিক কীভাবে ব্যবহার করেছেন তার উপরে। উপরের গল্পটা লেখা হয়েছে হরর বা সুপারন্যাচরাল গল্পের প্যাটার্নে। ব্যাখ্যাতীত কিছু হলো, তারপর ব্যাখ্যাতীতভাবে শেষ হলো। এখানে মূল উদ্দেশ্য আপনার ভেতর ভয়ের অনুভূতি জাগানো, আপনার পিলে চমকে দেওয়া, আপনাকে গা শিউরে ওঠা অনুভূতি উপহার দেওয়া। ঠিক এই কারণেই উপরের গল্পে ভ্যাম্পায়ার ফ্যান্টাসি উপাদান নয়, হরর কিংবা সুপারন্যাচরাল উপাদান হিসেবে বিবেচিত হবে। তাই জনরাটাও ফ্যান্টাসি নয়, হরর কিংবা সুপারন্যাচরাল হবে। গল্পটা কখন ফ্যান্টাসি হতো? তখন হতো যখন আপনি ব্যাখ্যাতীত কিছুর ব্যাখ্যা দিয়ে গল্পটা শেষ করতেন। ভ্যাম্পায়ার আছে? সে কীভাবে জন্ম নিলো? তার শক্তিমত্তা কী? দুর্বলতা কী? কীভাবে শিকার করে? সে কোথায় থাকে? কী ভাষায় কথা বলে? তার কি কোনো বিশেষ ক্ষমতা আছে? থাকলে তা কী? ওকে হত্যা করার উপায় কী? এরকম আরো অনেক প্রশ্নের উত্তর ফ্যান্টাসি আপনাকে দেবে। এই কারণেই হয়তো ফ্যান্টাসি গল্পগুলো সাধারণত বেশ বড় বড় হয়। আর সবশেষে, গল্পটা যদি ফ্যান্টাসি হতো, তবে এভাবে হুট করে মূল চরিত্র তার শিকার হয়ে যেত না (এটা হরর/সুপারন্যাচরালের স্টাইল), কাহিনি আরো বিস্তৃত হতো, উপরের প্রশ্নগুলোর মাঝে বেশ কিছুর উত্তর দিতো, এরপর একটা প্রপার এন্ডিং থাকতো।
ধরেন কোনো গল্প উপরের পয়েন্ট স্যাটিস্ফাই করলো। এবার? এবার দেখার বিষয় হলো, গল্পে সেই উপাদান বা উপাদানগুলোর ভূমিকা আসলে কতটুকু? মনে করুন, একটা গল্পে আপনি দেখালেন আপনার মূল চরিত্রের কাছে একটা পরী এসে মাঝেমধ্যে কথাবার্তা বলে, এরপর সে তার কাজে চলে যায়। পরীটা তার সম্পর্কে অনেক কথা বলে (যা পয়েন্ট ১-এর প্রশ্নগুলোর উত্তর দেয়)। কিন্তু পুরো গল্পে তার ভূমিকা কেবল এটুকুই। এটুকু বাদে পুরো গল্পটা হয়তো সামাজিক। বা হরর। বা যেকোনো জনরা। তবে পয়েন্ট ২ স্যাটিস্ফাই না করায় এটা ফ্যান্টাসি না। এটা হয়তো সামাজিক, হরর বা অন্য কোনো জনরা।
আপাত অবাস্তব, মিথ আর অকাল্ট
কিছু ‘আপাত অবাস্তব’ উপাদান আছে যেগুলোতে আমরা নিজেরা বিশ্বাস করি। বা পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য অংশ বিশ্বাস করে। কোনো প্রধান ধর্মের লোকেরা বিশ্বাস করে। এইসব উপাদান নিয়ে লিখলে কি সেটা ফ্যান্টাসি হবে?
ভূতে বিশ্বাস করেন? আমি জানি আপনি করেন না, কিন্তু কখনো মাঝরাতে অন্ধকার বিলের পাশ দিয়ে হেঁটেছেন? বা ঘুটঘুটে আঁধারে ঘেরা বাঁশবনের পাশ দিয়ে? জীবনে একবারও ভয় লাগেনি? পেছনে ঘুরে তাকাননি? আমি জানি, একবার হলেও ভয় পেয়েছেন। একবার হলেও পেছনে ঘুরে তাকিয়েছেন। কেন তাকিয়েছেন? কারণ আপনি চরম অবিশ্বাসী হলেও আমাদের পূর্বপুরুষদের সেই আদিম ভয় আমাদের জিনে এখনো আছে। এটা সেই প্রবৃত্তির কারণে সৃষ্ট সহজাত প্রতিক্রিয়া। এতে লজ্জিত হওয়ার কিছু নেই। সবাই ভয় পায়, গলা সবারই শুকায়। সাহসীরা ভয়ের মুখোমুখি হয়, আর ভীতুরা পালিয়ে যায়।
তো এখন ভূতের গল্পকে আপনি কী বলবেন? ফ্যান্টাসি? ভেবে দেখুন। অবাস্তব উপাদান। আপনার চেতনার সক্রিয় অংশ তাকে অস্বীকার করে, হেসে উড়িয়ে দেয়। কিন্তু এরপরেও আপনার মনের একটা অংশ আপনাকে বলে: কিছু থাকলেও থাকতে পারে। আপনাকে মনে করিয়ে দেয়, আপনি জীবনে কিছু না দেখলেও আপনার পাশের বাসার ভাবীর ছোট ভাইয়ের শ্যালিকার দেবর সে রাতে কী দেখে যেন মাথা ঘুরে পড়ে গেছিলো। ঠিক এই কারণেই ভূতকে ফ্যান্টাসি উপাদান ধরা হয় না, হরর উপাদান ধরা হয়। তাছাড়া, ভূতের গল্পের উদ্দেশ্যই হলো নিছক ভয় দেখানো। তাই ভূত যতই অবাস্তব উপাদান হোক, এটা ফ্যান্টাসি উপাদান না।
তবে জিনের কী হবে? জিন কি ফ্যান্টাসি উপাদান? এবার আমরা একটু ভয়ংকর জায়গায় চলে এসেছি। জিন এমন এক উপাদান যা বিশ্বের প্রধান একটি ধর্মের লোকেরা বিশ্বাস করে। তাদের অনেকের মতে, এতে বিশ্বাস করা ধর্মেরই একটি অংশ। ভয়ংকর জায়গাটা এখানেই। আপনি যদি বলে বসেন জিন ফ্যান্টাসি, তবে জনসংখ্যার একটা বড় অংশই কিন্তু ক্ষেপে যাবে। আমরা লেখক, কারো ধর্মীয় উপাদানকে ফ্যান্টাসি বলে তাদের অনুভূতিতে আমরা আঘাত করতে চাই না। আর তাই জিন এবং প্রধান ধর্মগুলো হতে উদ্ভূত যত উপাদান আছে, সেগুলোকে আমরা ‘ফ্যান্টাসি’ মানে কাল্পনিক, অবাস্তব ইত্যাদি বলি না। আমরা এদের বলি হরর বা সুপারন্যাচরাল উপাদান। গল্পে এই উপাদানগুলোর উপস্থিতি হয় আমাদের মনে ভয় জাগায়, অথবা ভক্তির সৃষ্টি করে।
দাঁড়ান। তবে কি জিন নিয়ে লেখা কোনো গল্পই ফ্যান্টাসি না? এই প্রসঙ্গটা পরিষ্কার করা উচিত আসলে। দেভাবাদ ট্রিলোজি পুরোটা জিন নিয়ে। কিন্তু এটা এরপরেও ফ্যান্টাসি। কারণ দেভাবাদ-এ শুধু জিন নয়, ফ্যান্টাসি ধাঁচের ম্যাজিকের উপস্থিতিও আছে। এই ম্যাজিকের কারণেই আমরা একে ফ্যান্টাসি বলি, শুধু জিনের কারণে নয়। একইভাবে, শুধু জিনের উপস্থিতির কারণে আমাদের দেশীয় উপন্যাস অক্টারিন ফ্যান্টাসি নয়, ক্যাওস ম্যাজিকের উপস্থিতি এবং গল্পে তার উপস্থাপন আর প্রভাবের কারণে তা ফ্যান্টাসি। শুধু জিনের কারণে পাপপিঞ্জর ফ্যান্টাসি নয়, এতে উপস্থিত আরো অনেক মিথ, মিথিক্যাল উপাদান, ক্ষমতা/জাদু, জাদুময় অস্ত্রের উপস্থিতির কারণেই তা ফ্যান্টাসি।
ধর্মীয় উপাদান গেল। পুরাণ বা মিথের উপাদান থাকলে কী হবে? এই ক্ষেত্রে ব্যাপারটা বেশ সহজ। মিথ মানে এমন কিছু যা অনেক অনেক যুগ আগে হয়তো বা কিছুসংখ্যক লোক বিশ্বাস করতো, এখন আর করে না। এটা একদম পরিষ্কার ‘অবাস্তব’ উপাদান, যার কারণে মিথিক্যাল উপাদানকে ফ্যান্টাসি উপাদান ধরা হয়। আপনার গল্পে সারবেরাস নামের তিন মাথাওয়ালা কুকুর আছে? ফ্যান্টাসি। পৌরাণিক দেবতা, দানব কিংবা পুরাণের পাতা থেকে উঠে আসা অন্যান্য উপাদান আছে? ফ্যান্টাসি। পৌরাণিক অস্ত্র বা আরক বা স্থানকেও ফ্যান্টাসির উপাদান হিসেবে ধরা হয়। এসব উপাদানের উপস্থিতিও আপনার গল্পকে ফ্যান্টাসি ট্যাগ দিতে পারে, যদি আপনার উপাদানগুলোর প্রয়োগ এবং উপস্থিতি আর গল্পে তাদের প্রভাব শক্ত হয়। সরাসরি মিথের উপাদান ব্যবহার করা একটা বাংলাদেশি নোভেলার নাম মাথায় আসছে এখন। কেটজালকোয়াটল এবং সৃষ্টিবিনাশ রহস্য। পুরো গল্পটাই মিথনির্ভর, তাই সাবজনরার হিসেবে এটি মিথলোজিক্যাল ফ্যান্টাসি।
ব্ল্যাক ম্যাজিকের ক্ষেত্রে কী হবে? এর উপস্থিতি কি কোনো গল্পকে ফ্যান্টাসিতে পরিণত করে? এখানে একটু বোঝার ব্যাপার আছে। ব্ল্যাক ম্যাজিক, ভুডু ম্যাজিক, তন্ত্রমন্ত্র ইত্যাদি আমাদের এই পৃথিবীরই বিভিন্ন সংস্কৃতিতে চর্চা করা হয় বা হতো। এমন অসংখ্য লোক আছে যারা এখনো এগুলোতে বিশ্বাস করে, এবং অনেকে এইসব যারা করে তাদের দারস্থও হয়। এই ম্যাজিক কাজ করে কি করে না, এটা ভোগাস কি আসল, ঐ তর্ক এখানে মুখ্য না। মুখ্য হলো, এগুলোকে আমরা ফ্যান্টাসি উপাদান হিসেবে ধরতে পারবো কি না।
কালো জাদু, তন্ত্রমন্ত্র, ভুডু ম্যাজিক ইত্যাদি অকাল্ট সায়েন্সের অংশ। এগুলোর অতীতে চর্চা করা হতো বা এখনো করা হয়। এগুলোতে অনেক লোকেই অতীতে বিশ্বাস করতো বা এখনো বিশ্বাস করে। আর তাই এই উপাদানগুলোকে অকাল্ট উপাদান হিসেবে আলাদা জনরার উপাদান বলে ধরা হয়। অকাল্ট ফিকশন। ফ্যান্টাসি নয়।
এবার উপরে উল্লিখিত ব্যাপারগুলো মাথায় নিয়ে ভাবুন, বুঝতে পারবেন প্রাইমারি জগতে লেখা কোন বইগুলো ফ্যান্টাসি আর কোনগুলো ভিন্ন জনরা।
ফ্যান্টাসি জনরা ট্যাগ এবং আমাদের উদ্ভট সাইকোলজি
আমাদের বইয়ের জগতের সাইকোলজি খুবই অদ্ভুত। একটা সময় ছিলো, যখন ফ্যান্টাসি শব্দটাই মানুষ মুখে আনতে চাইতো না। ঐ সময় খুব কম মানুষই ফ্যান্টাসি লিখতো, তার চেয়েও কম মানুষ তাদের বইকে ফ্যান্টাসি ট্যাগ দেওয়ার সাহস করতো। আমি ২০১৩-১৬-এর সময়ের কথা বলছি, যখন শ্রদ্ধেয় শরীফুল হাসানের ফ্যান্টাসি সিরিজ সাম্ভালা-র মাধ্যমে ফ্যান্টাসি সম্পর্কে মানুষ আস্তে আস্তে জানা শুরু করলো, তানজিম রহমানের আর্কন, অক্টারিন-এর মতো কয়েকটা ফ্যান্টাসি উপন্যাস বাজারে এলো, সৈয়দ অনির্বাণ সাহস করে লিখে ফেললো শোণিত উপাখ্যান। আমার নিজের ক্যারিয়ারের শুরুটাও তখনই, ২০১৪ থেকে। অনলাইনে ৭-৮টা বড়সড়ো ফ্যান্টাসি নোভেলা/নভেলেট জাতীয় গল্প লিখে তারপর অফলাইনে ড্রাগোমির-এর মাধ্যমে ফ্যান্টাসিতে যাত্রা শুরু করলাম। আমার এবং আমার সতীর্থদের ভালোই মনে আছে সেই প্রতিকূল সময়ের কথা। ফ্যান্টাসি ট্যাগ দেওয়াটাই ছিলো তখন ঝুঁকির। মানুষের প্রথম প্রশ্ন হতো, এ কী জিনিস? এবার দাও ব্যাখ্যা। কয়জনকে বোঝাবেন? সেই সময়টা এখন গত হয়েছে। এখন মানুষ কমবেশি জানে ফ্যান্টাসি কী।
আর উদ্ভট পরিস্থিতির শুরুটা এরপরেই। যে জনরার নামই আগে কেউ মুখে আনতে চাইতো না, এখন সেই জনরার ট্যাগ বইতে পড়লো কি পড়লো না সেটা কীভাবে কীভাবে যেন আত্মসম্মানের সাথে যুক্ত হয়ে গেল। ব্যাপারটা সত্যিই অদ্ভুত।
ধরুন, আপনি একটা বই লিখলেন, তা ফ্যান্টাসি হলো। তবে কি আপনি বেশি সম্মানিত হলেন? আপনার গল্প অন্য জনরার লেখকের থেকে বেশি ভালো হয়ে গেল? বা আপনি যা লিখেছেন তা যদি ফ্যান্টাসি না হয়ে হরর হয়, অকাল্ট ফিকশন হয়, প্যারানর্মাল স্টোরি হয়, তবে কি আসলেই তাতে আপনার গল্পের গুণগত মান কমে যায়? আপনার সম্মান হ্রাস পায়?
পায় না। এগুলো সবই সাইকোলজিক্যাল ব্যাপার। আপনি এটাকে বিগ ইস্যু ভাবছেন বলেই এমন লাগছে। যখন এই সাইকোলজি একপাশে সরিয়ে রাখবেন, দেখবেন বই কোন জনরায় পড়লো আর কোন জনরায় পড়লো না তাতে আসলে কিছুই যায় আসে না। জনরা ম্যাটার করে না, ম্যাটার করে আপনি যা লিখলেন তা কেমন হলো। সেটা ভালো হলেই পাঠক খুশি, আপনারও সন্তুষ্টি। আপনার বই ফ্যান্টাসি হলো না? তো হলো না! কী যায় আসে! কেউ কেউ আমাকে বলেছে, আমার ‘আলেয়া’ বইটা তার কাছে হরর/সুপারন্যাচরাল ধাঁচের লেগেছে, ফ্যান্টাসি না। আমি বলেছি, ‘ওকে, হলো হরর। নইলে সুপারন্যাচরাল। কী যায় আসে তাতে? আপনার কাছে বই ভালো লেগেছে কি না সেটা আসল কথা। কোন জনরা হলো না হলো তাতে আসলে কিচ্ছু যায় আসে না।’ লেখালেখিতে এই দেশে আমি যাদের গুরুস্থানীয় মানি, আমার সিনিয়ররা, তাদের আমি কখনোই জনরা নিয়ে অত মাথা ঘামাতে দেখিনি। থ্রিলার হয়নি? আচ্ছা হয়নি। ফ্যান্টাসি হয়নি? আচ্ছা হয়নি। এসব নিয়ে মাথা ঘামায় কে?
সত্যিটা শুনুন তবে। জনরা কী হলো না হলো তা নিয়ে কেউই সেভাবে মাথা ঘামায় না। জনরা হলো স্রেফ একটা ট্যাগ, যে ট্যাগ দেওয়া হয় ব্যবসায়ীক স্বার্থে। কার কাছে বইটা মার্কেটিং করবেন তা বোঝার স্বার্থে। কোনো সুনির্দিষ্ট পাঠক বইটা হাতে নেবে কি নেবে না, তা যাতে সে কেনার পূর্বেই বুঝতে পারে তার স্বার্থে। লাইব্রেরিতে দশ-বিশ হাজার বইয়ের মাঝে কাঙ্ক্ষিত বইকে সহজে খুঁজে পাওয়ার স্বার্থে। এর বাইরে এর কোনো গুণগত মূল্য নেই। সেটা আছে কেবলই আপনার লেখায়।
ফ্যান্টাসির শ্রেণিবিন্যাস
ফ্যান্টাসির শ্রেণিবিন্যাস করা আর জৈব যৌগের শ্রেণিবিন্যাস করা একই রকম—দুটোই বেশ কঠিন। কারণ জৈব যৌগের সংখ্যা যেমন অসংখ্য, তেমনি ফ্যান্টাসির সাবজনরাও অসংখ্য। আবার একেক দৃষ্টিভঙ্গিতে ফ্যান্টাসির ভাগ একেক রকম। এই শ্রেণিবিভাগ ম্যাজিকের উপস্থিতির উপর ভিত্তি করে করা যায়, সেটিংসের উপর ভিত্তি করে করা যায়, আবার সাবজনরার উপর ভিত্তি করেও করা যায়। আমি মনে করি, সবার প্রথমে এই বিভাজন করা উচিত সেটিংসের উপর ভিত্তি করে। কারণ ম্যাজিক থাকুক আর না থাকুক, আপনার সেটিংসই যথেষ্ট আপনার ফ্যান্টাসিটা কী ধরনের তা বুঝিয়ে বলার জন্য।
ধরুন, আমি আপনাকে বললাম নেম অব দ্য উইন্ড, ড্রেসডেন ফাইলস আর হ্যারি পটার-কে আলাদা করতে। অল্প কথায় কীভাবে করবেন? প্রথমটা সেকেন্ডারি ওয়ার্ল্ডের, দ্বিতীয়টা পৃথিবীর আর শেষেরটা পৃথিবীর ভেতর লুকোনো ম্যাজিকেল জগতের গল্প।
এই কারণেই প্রথম বিভাজনটা হওয়া উচিত সেটিংসের ভিত্তিতে। বলে রাখা ভালো, এই বিভাজন আমি নিজের মতো করে করেছি।
আমার মতে, সেটিংসের ওপর ভিত্তি করে ফ্যান্টাসি তিন রকম:
১। প্রাইমারি ওয়ার্ল্ড ফ্যান্টাসি
২। সেকেন্ডারি ওয়ার্ল্ড ফ্যান্টাসি
৩। সেক্লুডেড ওয়ার্ল্ড ফ্যান্টাসি বা ওয়ার্ল্ড উইদিন এ ওয়ার্ল্ড ফ্যান্টাসি
যে গল্পের সেটিংস আমাদের এই পৃথিবী, সেটা প্রাইমারি ওয়ার্ল্ড ফ্যান্টাসি। যেমন, ড্রেসডেন ফাইলস, দ্য মর্টাল ইন্সট্রুমেন্টস, অক্টারিন, সাম্ভালা, অন্ধ জাদুকর, পাপপিঞ্জর, শোণিত উপাখ্যান, আলেয়া ইত্যাদি।
যে গল্পের সেটিংস ফিকশনাল জগত, তাকে বলে সেকেন্ডারি ওয়ার্ল্ড ফ্যান্টাসি। এই জগতের ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য এসব আমাদের জগত থেকে আলাদা হয়। এর মানে এই না যে আমাদের জগতের কোনো কিছুর সাথে মিল থাকতে পারবে না। পারবে, তবে সেই মিল যত কম হবে, ঐ জগত সেকেন্ডারি ওয়ার্ল্ড হিসেবে ততবেশি সমৃদ্ধ হবে। যেমন, এ সং অব আইস অ্যান্ড ফায়ার, মিস্টবর্ন, স্টর্মলাইট আর্কাইভ, কিংকিলার ক্রোনিকলস, দ্য হুইল অব টাইম, মালাজান বুক অব দ্য ফলেনস ইত্যাদি।
বাংলায় সেকেন্ডারি ওয়ার্ল্ড তৈরি করে ফ্যান্টাসি লেখার চর্চা বেশ কয়েক বছর আগে শুরু হলেও এতদিন সংখ্যাটা ছিলো হাতেগোনা। এই বছর থেকে সংখ্যাটা লাফ দিয়ে বাড়তে শুরু করেছে, যা সত্যিই আশাব্যঞ্জক। এই বছর যেসব গল্প বের হলো, সুজানা আবেদীন সোনালির মিরিয়া: যোদ্ধাকুমারীর খোঁজে, জুলিয়ানের আশিয়ানি, আল কাফি নয়নের রাজকীয় উৎসর্গ এই জাতীয় ফ্যান্টাসি। এর আগে গত বছর তানজিরুল ইসলামের দাবনিশ আখ্যান: আসমানের আঁধার নামে এই জাতীয় একটি ফ্যান্টাসি উপন্যাস বেরিয়েছিলো। আমার নিজের তিনটা উপন্যাস আছে যা এই গোত্রে পড়ে: ড্রাগোমির, কুয়াশিয়া: স্পেলমেকারের অনুসন্ধান আর অন্তিম শিখা।
যদি পৃথিবীর ভেতরেই লুকোনো কোনো জগত থাকে যাতে সেকেন্ডারি ওয়ার্ল্ড ফ্যান্টাসির গুণাবলী উপস্থিত থাকে? যদি তাতে ম্যাজিক এবং ম্যাজিকেল প্রাণী থাকে, ঐসব প্রাণী বা জাতির লম্বা ইতিহাস থাকে, পার্থক্য করার মতো সংস্কৃতি ও ভাষা থাকে? যদি সেই স্থানটা যথেষ্ট বড় হয় এবং উপরের বৈশিষ্ট্যগুলো থাকে, তবে তাকে বলা হয় সেক্লুডেড ওয়ার্ল্ড ফ্যান্টাসি, যাকে আবার ওয়ার্ল্ড উইদিন এ ওয়ার্ল্ড ফ্যান্টাসিও বলে। এই সেক্লুডেড ওয়ার্ল্ডকে বাংলায় অন্তর্নিহিত জগত বলা যায়। যেমন, হ্যারি পটার, দ্য ম্যাজিশিয়ানস ইত্যাদি। মাদার ন্যাচার নামে আমার নিজের একটি ফ্যান্টাসি বই আছে, যা এই শ্রেণির ভেতর পড়ে।
পোর্টাল ফ্যান্টাসি বনাম সেক্লুডেড ওয়ার্ল্ড ফ্যান্টাসি
এখানে একটা বিভ্রান্তির ব্যাপার আছে। অনেকে ভাবে, পোর্টাল ফ্যান্টাসি আর সেক্লুডেড ওয়ার্ল্ড ফ্যান্টাসি একই। না, এরা একই না। পোর্টাল ফ্যান্টাসি সাবজনরার ভিত্তিতে ভাগ করে পাওয়া একটি নাম, সেক্লুডেড ওয়ার্ল্ড ফ্যান্টাসি হলো সেটিংসের ভিত্তিতে ভাগ করে পাওয়া একটি নাম। এটা সাবজনরা না, আপনার গল্পের সেটিংসের প্রকৃতি। দ্বিতীয়ত, পোর্টাল ফ্যান্টাসিতে পোর্টালের মাধ্যমে আপনি সেকেন্ডারি ওয়ার্ল্ডে প্রবেশ করবেন। এক্ষেত্রে জগত দুইটি পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন কিন্তু পোর্টালের মাধ্যমে সংযুক্ত। সেক্লুডেড ওয়ার্ল্ড ফ্যান্টাসিতে প্রাইমারি ওয়ার্ল্ড থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো সেকেন্ডারি ওয়ার্ল্ড নেই, প্রাথমিক জগতের ভেতর লুকোনো অন্তর্নিহিত জগত আছে। এই জগতে সবাই ঢুকতে পারে না, নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তি বা অস্তিত্ব ঢুকতে পারে। প্রাইমারি জগত থেকে এই জগত অদৃশ্য কোনো পর্দা দিয়ে পৃথক থাকে। ঐ জগতে ঢুকতে আপনার সুনির্দিষ্ট কোনো পোর্টালের প্রয়োজন নেই।
হ্যারি পটারের ক্ষেত্রে হগওয়ার্টসের ছাত্ররা প্ল্যাটফর্ম নম্বর পৌনে দশের দেয়ালের ভেতর দিয়ে ঢুকে অন্য স্থান দিয়ে বেরিয়ে আসে বলে অনেকে ভাবে হ্যারি পটার পোর্টাল ফ্যান্টাসি, বা সেক্লুডেড আর পোর্টাল ফ্যান্টাসি একই। না, একই না। ভেবে দেখুন, চ্যাম্বার অব সিক্রেটস-এ ডবি যখন সেই দেয়ালটাকে সলিড করে দিলো, এরপরেও ঠিকই উড়ন্ত গাড়িতে চড়ে হগওয়ার্টসে পৌঁছালো হ্যারি আর রন। যদি পোর্টাল ছাড়া ‘উইজার্ডিং ওয়ার্ল্ড’-এ প্রবেশ করা অসম্ভব হয়, তবে তারা গাড়ি নিয়ে কীভাবে সেখানে গেল? এর একটাই অর্থ; এখানে সেকেন্ডারি ওয়ার্ল্ডে ঢুকতে পোর্টাল মুখ্য না, ঐ প্ল্যাটফর্ম শুধু ব্রিটেনের জাদুকরদের জন্য একটা শর্টকাট ছিলো।
ম্যাজিক এবং ফ্যান্টাসি উপাদানের ভিত্তিতে শ্রেণিবিভাগ
ম্যাজিক এবং ফ্যান্টাসি উপাদানের উপর ভিত্তি করে আবার ফ্যান্টাসি দুই ধরনের: হাই ফ্যান্টাসি এবং লো ফ্যান্টাসি।
যে গল্পে ফ্যান্টাসি উপাদানের ব্যবহার বেশি তাকে হাই ফ্যান্টাসি আর যে গল্পে কম বা ক্ষেত্রবিশেষে একেবারেই নেই (যদি সেটা সেকেন্ডারি ওয়ার্ল্ড হয়) তাকে লো ফ্যান্টাসি বলে।
হাই ফ্যান্টাসিতে অবশ্যই একটি সেকেন্ডারি ওয়ার্ল্ড থাকতে হবে। তবে লো ফ্যান্টাসিকে সংজ্ঞায়িত করা অনেক কঠিন। কারণ এর দুই ধরনের সংজ্ঞা আছে। প্রথম সংজ্ঞা অনুযায়ী, লো ফ্যান্টাসি হচ্ছে সেকেন্ডারি ওয়ার্ল্ড-এর গল্প, যাতে ম্যাজিক এবং ফ্যান্টাসি ইলিমেন্ট খুবই কম থাকে বা একেবারেই থাকে না। কাল্পনিক জগত হয়েও সেই জগত আমাদের পৃথিবীর মতোই বাস্তব হয়।
দ্বিতীয় সংজ্ঞা অনুযায়ী, প্রাইমারি ওয়ার্ল্ড-এ যেসব গল্প লেখা হয় সেগুলো লো ফ্যান্টাসি। ঐ হিসেবে হ্যারি পটার-ও লো ফ্যান্টাসি, যদিও ওখানে প্রচুর প্রচুর ম্যাজিকের ব্যবহার আছে। এই কারণেই দ্বিতীয় সংজ্ঞার ব্যবহার আজকাল কমে যাচ্ছে। মানুষ এখন লো ফ্যান্টাসি বলতে বোঝাচ্ছে শুধু ফিকশনাল জগতের ম্যাজিকবিহীন বা কম ম্যাজিকবিশিষ্ট জগতের গল্পকে। প্রাইমারি জগতের জন্য কিছু বিকল্প টার্মের উদ্ভব হয়েছে—কন্টেম্পোরারি ফ্যান্টাসি, মানডেন ফ্যান্টাসি, আরবান ফ্যান্টাসি, রুরাল ফ্যান্টাসি ইত্যাদি।
ফ্যান্টাসিকে আরেকভাবে শ্রেণিবিন্যাস করা যায়, আর সেটা এর সাবজনরার উপর ভিত্তি করে। ৫০+ সাবজনরা আছে এর, যেগুলোর সবগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা সম্ভব নয়। ঠিক এ কারণেই আমার মনে হয় ফ্যান্টাসিকে সেটিংস-এর ভিত্তিকে শ্রেণিবিন্যাস করা সবচেয়ে সহজ।