হাংরিয়ালিস্ট মুভমেন্টঃ আন্দোলনের অস্ত্র যখন কবিতা!
হাংরিয়ালিস্ট মুভমেন্ট এর শুরু যখন ভারত সবেমাত্র ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তি পেয়েছে। ব্রিটিশদের বিতর্কিত দেশভাগ থেকে বাংলা ভাষাভাষী কোলকাতার মানুষ তখন যে খুব একটা সুখে শান্তিতে বাস করছিল তেমনটাও নয়। কোলকাতা তথা সারা বাংলাতেই তখন খাদ্যাভাব উঠে গেছে প্রকটে, স্বাধীনতার অমৃত সুধা ফুরিয়ে সেই পাত্রে স্থান করে নিয়েছে কেবলই দরিদ্রতা। আর ঠিক সেই সময়কার বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের পক্ষে একসাথে গর্জে উঠেছিল গুটিকয়েক তরুণ ব্রিগেড, পেশায় তাঁরা ছিল কবি, আন্দোলনের অস্ত্রও তাদের জন্যে তাই ছিল কবিতা। আর এই আন্দোলনই এখন আমরা চিনি হাংরিয়ালিস্ট মুভমেন্ট হিসেবে।
“হাংরিয়ালিস্ট মুভমেন্ট”, কেউ কেউ বলে থাকেন “হাংরি জেনারেশান মুভমেন্ট”- মূলত বাংলা সাহিত্যকে পুঁজি করে গড়ে ওঠা আন্দোলন । ১৯৬১ সালের সেই আন্দোলনের পুরোধা ব্যাক্তিত্ব ছিলেন মূলত একঝাঁক তরুণ কবি। তবে হাংরিয়ালিস্ট মুভমেন্টে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া চার কবি ছিলেন- মলয় রায়চৌধুরী, সমীর রায়চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায় আর দেবী রায়! এই চারজন আবার এই ‘হাংরিয়ালিজম’কে ধার করেছিলেন ইংলিশ কবি জিওফ্রে চসারের কবিতার লাইন “in the swore hugry tyme” থেকে।
সে যাক, এই কবিচতুষ্টয়ের হাংরিয়ালিস্ট মুভমেন্টের মূলকথা ছিল জার্মান ঐতিহাসিক অসওয়াল্ড স্পেনগ্লারের ইতিহাস নিয়ে সেই বিখ্যাত উক্তিটার মত- “একটা দুর্বল সংস্কৃতি বাইরের অন্য একটা সংস্কৃতির ওপর ভর করেই চলে”। মূলত অসওয়াল্ডের মতই এই কবি চতুষ্টয় মনে করতেন ”বাঙালি সংস্কৃতিও অন্য একটা সংস্কৃতির ওপর ভর করেই চলছে”।
মূলত হাংরিয়ালিস্ট মুভমেন্ট ভারতে বাংলা সাহিত্য আর কালচারাল এসটাব্লিশমেন্টের ভিতকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। এই কবিরা মনে করতেন এখনই ঠিক সময় যখন আমরা বাংলা ভাষাতে আর বাংলা ভাষার শব্দভান্ডারে একটা পরিবর্তন আনতে পারি। হাংরিয়ালিস্টরা মনে করতেন বাংলা সাহিত্যের পাঠকের মনে এখনও ব্রিটিশদের তৈরি করা কলোনিয়াল আইডিয়া গেঁথে আছে আর এটাকেই সাহিত্যের মাধ্যমেই প্রশ্নবিদ্ধ করতে হবে। হাংরিয়ালিস্টরা আরো ভাবতেন যারা বাংলা সাহিত্য পড়ে তাঁরা সেই কলোনিয়াল আইডিয়াতেই এখনও কনভিন্সড হন আর এটাকে অতি অবশ্যই মগজ থেকে সরাতে হবে। সেই সরানোর জন্যেই তাঁরা বেছে নিলেন সাহিত্যকে, সাহিত্যের ধারা পাল্টাতে চাইলেন, বাংলা সাহিত্যে আর এর শব্দভান্ডারে একটা পরিবর্তনের তাগিদ দিলেন।
তবে হাংরিয়ালিস্টদের এই ধারণা সে সময়কার “এলিট সোসাইটি” আর সরকার গ্রহণ করল না। হাংরিয়ালিস্টরা প্রচুর সমালোচনার স্বীকার হতে থাকলেন। চারপাশ থেকে নিন্দার ঝড় ধেয়ে এল তাঁদের দিকে। সেটা অবশ্য স্বাভাবিকই । বেশিরভাগ মানুষই প্রচলিত নিয়মের বাইরে যেতে পারেনা। সেটা ভুল কি ঠিক তা তাঁদের কাছে বিবেচ্য নয়। যা কিছু বয়ে চলা, তাই এরা ধরে নেয় ধ্রুব সত্য হিসেবে।
তবে সেই আন্দোলন কিন্তু সমর্থনও পেল। ধীরে ধীরে উৎপল কুমার বসু, বিনয় মজুমদার, সন্দ্বীপন চট্টোপাধ্যায়, বাসুদেব দাশগুপ্ত, ফাল্গুনী রায়, ত্রিদিব মিত্রের মত তরুণ কবিরা নিজেদের হাংরিয়ালিস্ট মুভমেন্টের সাথে যুক্ত করলেন। তাঁরা কবিতার মাধ্যমে অনিয়মের কথা বলে যেতে লাগলেন, সেই সময়কার সরকারের সমালোচনা করে যেতে লাগলেন, মানুষের মনে গেঁথে থাকা কলোনিয়াল আইডিয়াকে প্রশ্ন করে যেতে থাকলেন, বাংলা ভাষা আর সাহিত্যে একটা নতুন রূপ যোগ করার চেষ্টা করলেন। সেই রূপ সাবলীলতার, সেই রূপ যা কবিরা চায় তা বলবার। সাহিত্যে এরপর যে মুক্ত চর্চা হয়েছে, প্রচলিত সমাজের চোখে ‘অশ্লীলতা’ যোগ হয়েছে তার শুরু বাংলা ভাষায় এখানেই। যা হোক, হাংরিয়ালিস্ট মুভমেন্ট ধীরে ধীরে বেশ প্রকট আকার ধারণ করতে শুরু করল। আর ঠিক তখনই, ১৯৬৪ সালের ২রা সেপ্টেম্বর সেই সময়কার সরকার এই কবিদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য অবস্থান নিলেন। হাংরিয়ালিস্ট মুভমেন্টের ১১ কবির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হল। সরকারের তরফ থেকে বলা হল, সাহিত্যে অশ্লীলতা যোগ করা আর রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিধ্বংসী চক্রান্ত করার অভিযোগে তাঁদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। আর ঠিক তখনই হাংরিয়ালিস্ট মুভমেন্ট আর শুধুমাত্রই ভারতবর্ষের গন্ডিতেই আবদ্ধ থাকল না। মামলার মারপ্যাঁচে কোর্টে সেই মামলা চলল বছরের পর বছর। খুব দ্রুতই কবিদের বিরুদ্ধে এই গ্রেফতার আর মামলা বহির্বিশ্বের দৃষ্টি কেড়ে নিল। মেক্সিকান কবি অস্টাভিও পাজ, খ্যাতিমান কবি আর্নেস্টো কার্ডিনাল আর অ্যালেন গিনেসবার্গের মত কবিরা ছুটে এলেন, মলয় রায়চৌধুরীর সাথে দেখে করলেন।মলয় রায়চৌধুরীর পক্ষে সেসময় ১০০ এর ওপর ম্যানিফেস্টো ইস্যু করা হয়। তাঁর লেখা কবিতা “প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার” ইংরেজি ভাষায় “Stark Electric Jesus” নামে ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে প্রকাশ করা হয়। কবিতাটি বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। জার্মান ভাষায় কার্ল ওয়েইসনার, স্প্যানিশ ভাষায় মার্গারেট র্যান্ডাল, উর্দুতে আমেক হানফি, অসমীয়াতে মানিক দাস, গুজরাতিতে নলিন প্যাটেল, হিন্দিতে রাজকমল চৌধুরী এবং ইংরেজিতে হাওয়ার্ড ম্যাককর্ড। তবে সরকারের আগ্রাসন থেকে তিনি রেহাই পেয়েছিলেন না। তাকে কোমরে দড়ি বেঁধে চোর ডাকাতদের সঙ্গে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। লালবাজারের কনফারেন্স রুমে তাকে জেরা করা হয়েছিল, যার ইনভেস্টিগেশন বোর্ডে ছিলেন স্বরাষ্ট্র দপ্তর, পুলিশ প্রশাসন, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বিভাগ, ভারতীয় সেনার প্রতিনিধিরা এবং পশ্চিমবঙ্গের আ্যাডভোকেট জেনারেল। এ থেকেই বোঝা যায় হাংরিয়ালিস্ট মুভমেন্ট ঠিক কতটা সপাটে আঘাত করেছিল!
এই আন্দোলনে থাকা বাকিদের ওপর তখন খড়গ নেমে আসে। উৎপলকুমার বসু অধ্যাপনার চাকরি থেকে বরখাস্ত হন, প্রদীপ চৌধুরী বিতাড়িত হন বিশ্বভারতী থেকে, সমীর রায়চৌধুরী সরকারি চাকরি থেকে বহিষ্কৃত হন, সুবিমল বসাক ও দেবী রায়কে কলকাতার বাইরে বদলি করে দেয়া হয়, সুবো আচার্য ও রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় তো ফেরারী হয়ে যান।
হাংরিয়ালিস্ট মুভেমেন্ট বাংলা সাহিত্যে শুরু হলেও পরে তা ব্রিটিশ কলোনী থেকে মুক্তি পাওয়া অন্য সকল ভাষাতেই প্রচন্ড প্রভাব রাখতে সক্ষম হয়। হিন্দী, মারাঠী, অসম, তেলেগু আর উর্দু সাহিত্যেও এই আন্দোলন একটা জোর ধাক্কা দেয়। তবে শক্তি চট্টোপাধ্যায় ,শৈলেশ্বর ঘোষ আর সুভাষ ঘোষ পরে এই আন্দোলন থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছিলেন। তবে কবিরা সরিয়ে নিলেও বামপন্থী ছাত্ররা ঠিকই এই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়েছিল কয়েক বছর। তবে তখনও কবিদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা চলমান ছিল।
কৃত্তিবাস এবং হাংরিয়ালিস্ট
একটি ভুল ধারণা প্রচলিত ছিল যে হাংরিয়ালিস্ট এবং কৃত্তিবাস গোষ্ঠী একই এবং কৃত্তিবাস পত্রিকা একটি হাংরিয়ালিস্ট প্ল্যাটফর্ম ছিল। কিন্তু এই ধারণাটা ভুল, কারণ কৃত্তিবাস ছিল পঞ্চাশ দশকের একটি পত্রিকা, অন্যদিকে হাংরিয়ালিস্ট আন্দোলন ষাটের দশকের ঘটনা। কৃত্তিবাস পত্রিকা তার সম্পাদকীয়তে প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছিল যে হাংরিয়ালিস্ট আন্দোলনের সাথে তাদের কোন সম্পর্ক নেই এবং তারা আন্দোলনের দর্শনকে অনুমোদন করে না।
হাংরি জেনারেশন, যা হাংরিলিজম নামেও পরিচিত, মূলধারার সাহিত্যের ধারাগুলোকে চ্যালেঞ্জ করেছিল। দলটি সম্পূর্ণ ভিন্ন আকারে কবিতা ও গদ্য রচনা এবং বিষয়বস্তু নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিল। এই আন্দোলন বাংলার সাহিত্যিক পরিবেশকে পুরোপুরি বদলে দেয়। হিন্দি, মারাঠি, অসমীয়া এবং উর্দু সাহিত্যে এর প্রভাব ছিল।
যাই হোক, মামলা চলতে থাকে। এরমধ্যে ৩৫ মাস ধরে চলা এই মামলার শেষে ১২০বি এবং ২৯৪ ধারা তুলে নিয়ে কেবল ২৯২ ধারায় চার্জশীট দেয়া হয় মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে তার প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার কবিতাটির জন্য ; তিনি বাদে বাকি সবাইকে অবশ্য রেহাই দেয়া হয় । তবে নিম্ন আদালতে হেরে গেলেও উচ্চ আদালতে মলয় রায়চৌধুরী শেষ অব্দি মামলা জিতে যান। আর এভাবেই বাংলা সাহিত্যে মেইনস্ট্রিম লেখার ধারাকে চ্যালেঞ্জ করে প্রতিষ্ঠিত হল নতুন এক ভাব- যে ভাব সাবলীলতার এবং হাংরয়ালিস্ট মুভমেন্ট হয়ে গেল সাহিত্যের ওপর গড়ে ওঠা এই পৃথিবীর সবচাইতে বড় আন্দোলন!
লিখেছেনঃ সামিয়াতুল সামি