আগাথা ক্রিস্টির অদ্ভুত অন্তর্ধান রহস্য!
আগাথা মেরি ক্লারিসা মিলার ১৮৯০ সালের ১৫ ই সেপ্টেম্বর টরকোয়া, ডেভন-এ জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন ক্লারা এবং ফ্রেডেরিক মিলারের তিন সন্তানের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ। আগাথা ক্রিস্টি তাঁর ৬৬ টি গোয়েন্দা উপন্যাস এবং ১৪টি ছোট গল্পের সংকলনের জন্য সর্বাধিক পরিচিত।
১৯২৬ সালের ডিসেম্বরের এক শীতের রাতে, আগাথা ক্রিস্টি তাঁর প্রিয় মরিস কাউলি রোডস্টার গাড়িতে বেরিয়ে গিয়েছিলেন এবং ১১ দিন ধরে বাড়ি ফিরে আসেননি। এই ১১ দিনে তাকে নিয়ে যা যা ঘটেছিল সেটাই এখানে তুলে ধরা হলো।
এটি অনেকটা তাঁর নিজের লেখা উপন্যাসের প্লটের মতো ছিল। ৪ই ডিসেম্বরের সন্ধ্যায়, আগাথা ক্রিস্টি, একটি অ্যাটাশে কেস নিয়ে বেরিয়ে আসেন, আসার সময় মেয়েকে চুমু দিয়ে আসেন। স্বামী কর্নেল আর্চিবাল্ড ক্রিস্টির তাঁর সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিল না। বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবার পর ক্রিস্টি প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে কোথায় ছিলেন তা কেউ জানত না।
৬ ডিসেম্বর, ১৯২৬
ক্রিস্টির বয়স তখন ৩৬ বছর এবং তিনি ইতিমধ্যে “The Secret Adversary” এবং “The Murder on the Links” সহ বেশ কয়েকটি গোয়েন্দা উপন্যাস প্রকাশ করেছিলেন। তার অন্তর্ধানে বিশ্বজুড়ে পত্রিকার মূল শিরোনাম হয়েছিলেন, ৬ ডিসেম্বর দ্য টাইমসের প্রথম পৃষ্ঠায় তাকে নিয়ে মূল প্রতিবেদন করা হয়েছিল।
“ঔপন্যাসিকের গাড়িটি গিল্ডফোর্ডের কাছে একটি খাদের কিনারায় পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে, সামনের চাকাগুলি খাদের কিনারে প্রায় ঝুলে ছিল,” পত্রিকাটি রিপোর্ট করেছিল এভাবে।
৮ ডিসেম্বর, ১৯২৬
তিনদিন ধরে ওই ঔপন্যাসিকের খোঁজ চালানোর পর পুলিশ তা বন্ধ করে দেয়। তারা বলেছে যে ক্রিস্টির ভগ্নিপতি তার কাছ থেকে একটি চিঠি পেয়েছিলেন, যেখানে বলা হয়েছিল যে তিনি “বিশ্রাম এবং চিকিৎসার জন্য” ইয়র্কশায়ারের স্পাতে যাচ্ছেন। কেস বন্ধ, তাই না? কিন্তু ঘটনা তখনও বাকি।
১০ ডিসেম্বর, ১৯২৬
পুলিশ অবশ্য এই চিঠি পেয়ে সন্তুষ্ট হয়নি বরং তারা তাদের অনুসন্ধানের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এমনকি ক্রিস্টির পোষা প্রাণীকে ঘটনাস্থলে নিয়ে আসে যাতে সে তার মালিকের গন্ধটি চিনতে পারে কিনা তা দেখার জন্য। কিন্তু কুকুরটিও তেমন কোন সাহায্য করতে পারেনি।
দ্য টাইমস এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে এরপর গোয়েন্দারা ধারণা করেন যে ক্রিস্টি আত্মহত্যা করেছেন। এরপর তারা “দ্য সাইলেন্ট পুল” নামে একটি পুকুরকে কেন্দ্র অনুসন্ধান চালাতে থাকে। স্থানীয় কিংবদন্তী অনুসারে, এই পুকুরটি অন্তহীন, এর কোন তলা নেই।
এই গল্পের এখনও বাকি ছিল। পত্রিকাটি দাবি করেছিল, তিনি নিজের বাড়ির মধ্যেই হারিয়ে গেছেন কিংবা মিলিয়ে গেছেন। বাড়িটি ছিল একটি নির্জন গলিতে, রাতে আলোহীন। এরমধ্যেই এই বাড়িটির ভুতুড়ে হওয়ার খ্যাতি ছিল। এই গলিতে একজন মহিলাকে খুন করা হয়েছিল এবং একজন পুরুষ আত্মহত্যা করেছিল। ‘যদি আমি শীঘ্রই সানিংডেল ছেড়ে না যাই, সানিংডেলই আমার শেষ ঠিকানা হবে,’ ক্রিস্টি একবার তাঁর এক বন্ধুকে বলেছিলেন।
১১ ডিসেম্বর, ১৯২৬
ক্রিস্টির নিখোঁজ হওয়ার এক সপ্তাহ পরও পুলিশের কাছে কোন তথ্য ছিল না। “এক সপ্তাহ আগে সানিংডেলে তার বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর থেকে কোনও নির্ভরযোগ্য সাক্ষী তাকে দেখেনি,” দ্য টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
তবে একটি ব্যাপার জানা গিয়েছিল। ক্রিস্টি তিনটি চিঠি রেখে গিয়েছিলেন: একটি তার সচিবের কাছে, অন্যটি তার ভগ্নিপতির কাছে এবং তৃতীয়টি তার স্বামীর কাছে, কিন্তু সবাই যার যার চিঠির বিষয়বস্তু প্রকাশ করতে অস্বীকার করেছিলেন।
১২ ডিসেম্বর, ১৯২৬
গোয়েন্দারা গাড়িচালক এবং অপেশাদার গোয়েন্দাদের কাছ থেকে সাহায্যের জন্য আবেদন করেছিলেন। “পুলিশ তখনও বিশ্বাস করে সে আশপাশে কোথাও আছে। যেখানে তার হারিয়ে যাওয়া গাড়িটি পাওয়া গেছে সেখান থেকে তাঁর অবস্থান খুব বেশি দূরে নয়।”
এই নিবন্ধে একটি ধারণা উল্লেখ করা হয়, তা হচ্ছে ক্রিস্টি নিজেই কোথাও লুকিয়ে আছেন এবং এটা একটা পাবলিসিটি স্ট্যান্ট। কিন্তু তাঁর ব্যক্তিগত সচিব এই ধারণাকে অস্বীকার করেন এবং বলেন, “এটি হাস্যকর। মিসেস ক্রিস্টি’র মতো দামী মানুষ এতো ছোট কাজ করবে না।” সচিব ক্রিস্টি তার জন্য রেখে যাওয়া নোটটিও হস্তান্তর করে বলেছিলেন যে এতে কেবল সময়সূচীর বিবরণ রয়েছে।
পুলিশ সূত্রের জন্য মরিয়া হয়ে গেল, ক্রিস্টির পাণ্ডুলিপিগুলো পড়তে শুরু করল, এমনকি ‘দ্য ব্লু ট্রেন’ নামে ক্রিস্টির লেখা শেষ পাণ্ডুলিপিটাও পড়তে শুরু করল সূত্রের জন্য।
১৩ ডিসেম্বর, ১৯২৬
১০,০০০ থেকে ১৫,০০০ জন লোক মিসেস ক্রিস্টির সন্ধানে অংশ নিয়েছিল, “ছয়টি প্রশিক্ষিত ব্লাডহাউন্ডস, এয়ারেডেল টেরিয়ার্সের একটি দল, অনেক পুনরুদ্ধারকারী আলসেশিয়ান পুলিশ কুকুর এবং এমনকি সাধারণ মংগ্রেলগুলোকেও কাজে লাগানো হয়েছিল।
একই দিনে, পুলিশ অনুমান করেছিল যে ক্রিস্টি সম্ভবত লন্ডনে থাকতে পারে, “ছদ্মবেশে এবং সম্ভবত পুরুষ পোশাকে।” এছাড়া গুজব উড়তে শুরু করে যে তিনি একটি সিল করা খাম রেখে গেছেন গেছেন যা কেবল তার দেহটি আবিষ্কৃত হওয়ার ঘটনায় খোলা হবে।
আধ্যাত্মিকতাবাদীরা এমনকি সেই গর্তের কাছে মৃত্যু পরবর্তী প্রার্থনা সভার আয়োজন করেছিলেন।
১৪ ডিসেম্বর, ১৯২৬
পত্রিকাটি জানিয়েছে যে পুলিশ কাছাকাছি কিছু গুরুত্বপূর্ণ সূত্র পেয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে “একটি সীসা ও আফিমের লেবেলযুক্ত বোতল, একটি ছেঁড়া পোস্টকার্ডের টুকরো, একজন মহিলার পশমী কোট, ফেস পাউডারের একটি বাক্স, একটি রুটির টুকরা, একটি কার্ডবোর্ডের বাক্স এবং দুটি শিশুর বই।
সম্ভবত আরও অশুভ ছিল গোয়েন্দাদের নতুন তত্ত্ব: “পুলিশের কাছে এমন তথ্য রয়েছে যা তারা প্রকাশ করতে অস্বীকার করে এবং তাদের অনুমান হয় যে মিসেস ক্রিস্টির বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার সময় ফিরে আসার কোনও ইচ্ছা ছিল না।”
১৫ ডিসেম্বর, ১৯২৬
ঔপন্যাসিককে ইয়র্কশায়ারের স্পাতে পাওয়া যায়, নিখোঁজ হওয়ার নয় দিন পর।
তাঁর স্বামী সাংবাদিকদের বলেন, ‘তিনি জানেন না তিনি কে… তিনি স্মৃতিশক্তি হারিয়েছেন অনেকটা।”
দ্য টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্রিস্টি ‘মিসেস টেরেসা নীল’ নামে হ্যারোগেট স্পা’তে চেক ইন করেছিলেন। জিজ্ঞাসা করা হলে, কর্নেল ক্রিস্টি জোর দিয়ে বলেছিলেন যে এই নির্দিষ্ট নামের অর্থ কী তা নিয়ে তার কোনও ধারণা নেই, তার ধারণা তার স্ত্রীও তা জানে না। যদিও কয়েক বছর পরে, এটি প্রকাশিত হয়েছিল যে আগাথা ক্রিস্টি আসলে তাঁর স্বামীর বান্ধবীর নাম ব্যবহার করেছিলেন।
যখন কর্নেল ক্রিস্টি তার স্ত্রীকে সংগ্রহ করার জন্য হ্যারোগেটে উপস্থিত হয়েছিলেন, তখন ক্রিস্টি তার দিকে শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন। পরে, শত শত লোক লন্ডনের একটি ট্রেন স্টেশনে উপস্থিত হয়েছিল এই দম্পতিকে এক ঝলক দেখার আশায়।
পত্রিকাগুলোতে খবর আসে সে অনেক শখের গোয়েন্দারা এই খবরে তাদের পুরানো কাজে ফিরে গেছেন।
১৭ মার্চ, ১৯২৮
কাহিনীর পরবর্তী অধ্যায়টি প্রায় ১৫ মাস পরে ঘটে। আগাথা ক্রিস্টি তার স্বামীর বিরুদ্ধে বিবাহবিচ্ছেদের মামলা করেছিলেন।
১৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৩০
বিবাহবিচ্ছেদের দুই বছর পর ক্রিস্টি পুনরায় বিয়ে করেন। আর্কিবাল্ড ক্রিস্টিও তাই করেছিলেন: তার নতুন স্ত্রী মিস নীল ছাড়া আর কেউ ছিলেন না।
৯০ বছরেরও বেশি সময় পরে, জীবনীকার এবং ঐতিহাসিকরা এখনও ১৯২৬ সালের সেই দিনগুলিতে কী ঘটেছিল তা নিয়ে বিতর্ক করছেন। এটা কি প্রতিশোধ ছিল, না বিষণ্ণতা নাকি স্মৃতিভ্রংশ?
Feature Image Source: nytimes.com
References: