ফ্যান্টাসি জনরা পরিচিতি পর্ব ২

তারিখ:

পোস্ট শেয়ার করুন:

ফ্যান্টাসি জনরা পরিচিতি দ্বিতীয় পর্ব- লিখেছেন- আশরাফুল সুমন 

সাব জনরা: হাই ফ্যান্টাসি

যেসব সেকেন্ডারি ওয়ার্ল্ড ফ্যান্টাসি গল্পে জাদু এবং কাল্পনিক উপাদানের উপস্থিতি বেশি থাকে, সেগুলোকে হাই ফ্যান্টাসি বলে।

জগতটা হবে পৃথিবী থেকে আলাদা, যতটা সম্ভব স্বতন্ত্র‍্য। এই ধরনের জগতকে টোলকিনস ওয়ার্ল্ড বা টোলকিনের জগতও বলা হয়। আধুনিক ফ্যান্টাসির জনক টোলকিন সর্বপ্রথম এই ধরনের পূর্ণাঙ্গ হাই ফ্যান্টাসি জগত তৈরি করেন বলেই এটাকে তার নামে নামকরণ করা হয়েছে। যদিও তার আগে ১৮৫৮ সালে স্কটিশ লেখক জর্জ ম্যাকডোনাল্ড fantastes নামে একটা সেকেন্ডারি ওয়ার্ল্ড বিশিষ্ট বই লিখেছিলেন। এরপর ১৮৯৬ সালে উইলিয়াম মরিস প্রকাশ করেন দ্য ওয়েল এট দ্য ওয়ার্ল্ডস এন্ড। চার খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছিলো বইটা। বহু পরে সেটি একত্র করে এক খণ্ডে প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়।

এরপরেও হাই ফ্যান্টাসি জগত বা সেকেন্ডারি ওয়ার্ল্ড তৈরির কৃতিত্ব জে আর আর টোলকিনকে দেওয়া হয় কেন বা তাকে আধুনিক ফ্যান্টাসির জনক বলা হয় কেন, তাই তো?

সাহিত্যের বেলায় আমরা যখন বলি কোনো কিছুতে ‘প্রথম’, তখন আমরা কয়েকটা প্যারামিটার বিবেচনা করি। ১) বইটি ঐ নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে কি না ২) এর ব্যাপ্তি এবং গভীরতা উল্লেখ করার মতো কি না এবং ৩) সাহিত্য হিসেবে সেটি ঐ নির্দিষ্ট শাখায় কতটুকু অবদান রাখতে পেরেছে, পাঠকদের মাঝে কতটুকু জনপ্রিয় এবং পরবর্তী লেখকদের কতটুকু প্রভাবিত করতে পেরেছে।

এই কারণেই প্রথম বাংলা উপন্যাস যদিও আলালের ঘরের দুলাল, এরপরেও এই কৃতিত্ব সর্বস্বীকৃতভাবে দেওয়া হয় দুর্গেশনন্দিনী-কে। প্রথম বাংলা নাটক ভদ্রার্জুন হলেও এর কৃতিত্ব দেওয়া হয় শর্মিষ্ঠা-কে। কেবল সবার আগে লেখাটাই মুখ্য না, মুখ্য হলো উপরের তিনটা পয়েন্ট। যে বই খুব কম মানুষ পড়েছে বা খুব কম মানুষ যা নিয়ে আলোচনা করে বা যা বই ঐ নির্দিষ্ট শাখায় উল্লেখ করার মতো কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি, তাকে প্রথমের তকমা দেওয়া হয় না। তবে মাঝেমধ্যে বিতর্ক এড়াতে ‘প্রথম’ এর পরে ‘পূর্ণাঙ্গ’, ‘সার্থক’ ইত্যাদি শব্দ জুড়ে দেওয়া হয়। ঐ হিসেবে, মিডল আর্থ নামক সেকেন্ডারি ওয়ার্ল্ডের ব্যাপ্তি আর গভীরতা, এর পাঠকপ্রিয়তা, পরবর্তী লেখকদের প্রভাবিত করার ক্ষমতা এবং পুরো ফ্যান্টাসি সাহিত্যে এর প্রভাব হিসেব করে প্রথম পূর্ণাঙ্গ হাই ফ্যান্টাসি জগত তৈরির কৃতিত্ব জে আর আর টোলকিনেরই। আর তাই তিনিই আধুনিক ফ্যান্টাসির জনক হিসেবে সর্বজনস্বীকৃত।

হাই ফ্যান্টাসির জগতে ইউকে, ইউএস, ভারত, জাপান এসব কিছুই থাকবে না। যার মানে, হাই ফ্যান্টাসি গল্পে বাংলাদেশ নামেও কোনো দেশ থাকবে না। এই জগত হতে হবে লেখকের নিজের সৃষ্ট, তার কল্পনা শক্তির অনন্য নিদর্শন। আসলে, শুধু হাই ফ্যান্টাসি না, যেকোনো সেকেন্ডারি ওয়ার্ল্ড ফ্যান্টাসির জন্যই এটা সত্য।

এই ধরনের বইতে থাকা বিভিন্ন চরিত্রের নাম, স্থানের নাম বা বিভিন্ন টার্মের বেশিরভাগই লেখকের নিজ হাতে তৈরি করা। নামগুলো হয় স্বতন্ত্র‍্য এবং কখনো কখনো বেশ অর্থবহ।

হাই ফ্যান্টাসিতে দেশীয় প্রেক্ষাপট এবং প্রচলিত কিছু ভুল মতবাদ

এখানে কিছু কথা বলে রাখা প্রয়োজন। বাংলাদেশে হাই ফ্যান্টাসি/সেকেন্ডারি ওয়ার্ল্ড ফ্যান্টাসি নিয়ে প্রচুর ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। অনেকেই ভাবে, এখানে বাংলাদেশ কোথায়? দেশীয় নাম কোথায়? দেশীয় প্রেক্ষাপট কোথায়? বাংলাদেশি গল্পে এত বিদেশি বিদেশি ভাব কেন?

উপরেই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়া আছে। তারপরেও আবার বলছি: হাই ফ্যান্টাসি মানেই সম্পূর্ণ কল্পনা থেকে সৃষ্ট এক জগতের কাহিনি। সেখানে যেমন আমেরিকা নেই, ঠিক তেমনি বাংলাদেশ নামেও কোনো দেশ নেই। তার মানে, সেখানে দেশি প্রেক্ষাপটের প্রশ্ন উঠতেই পারে না। আর যেহেতু প্রেক্ষাপট আলাদা, তাই দেশি নাম কিংবা সংস্কৃতির প্রসঙ্গও ওঠে না। আবার এটা বিদেশি প্রেক্ষাপটে লেখা গল্পও নয়; ইউরোপ, আমেরিকা, ব্রাজিল, উগান্ডা ইত্যাদির কিছুই যেখানে নেই, সেখানে ‘বিদেশি’ শব্দটাই বা আসে কিভাবে? এটা অপরিচিত এক জগতের গল্প, যে জগত লেখকের কল্পনা থেকে জন্ম নিয়েছে।

যেমন ধরুন, স্যান্ডারসন একজন আমেরিকান লেখক। তার স্টর্মলাইট আর্কাইভ বিশ্বের সেরা ফ্যান্টাসি সিরিজের ভেতর অন্যতম। তার এই সিরিজের চরিত্রগুলোর নাম দেখুন: কালাদিন, ডালিনার, এডোলিন, শালান, জাশনা, সেথ সান-সান ভোলানো ইত্যাদি। এই নামগুলো কি আমেরিকান?

আবার, এই ধরনের গল্পে প্রচুর নতুন টার্ম বা স্থানের নাম থাকে, যেগুলো লেখককেই তৈরি করে নিতে হয়। হয়তো বা এই নামগুলোর কারণেই ফ্যান্টাসির নিয়মিত পাঠক নয় এমন কারো মনে হাই ফ্যান্টাসি পড়লে ‘বিদেশি’ অনুভূতি আসতে পারে, কিন্তু আসলে তা নয়। এই টার্মগুলো বিজাতীয় নয়, বরং লেখকের তৈরি করা স্বতন্ত্র‍্য শব্দ।

আবারো স্টর্মলাইটের উদাহরণ দেই। শিনোভার, রেশি, এলেথকার, জাহ কিভেদ এগুলো ম্যাপের বিভিন্ন স্থানের নাম। আবার সানথিড, আশকারকি, মাকাবাকি, ভোরিন, পারশেন্দি এগুলোও কিন্তু ইংরেজি শব্দ নয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, চরিত্রগুলো দেখতেও কিন্তু আমেরিকানদের মতো না। স্যান্ডারসনের একটা স্বভাব হচ্ছে চরিত্রগুলোকে নন-আমেরিকান করে তৈরি করা। এদের চামড়া অনেকটা আমাদের এশিয়ানদের মতো।

তাহলে মূল চরিত্র যেখানে আমেরিকান না, নাম আমেরিকান না, স্থানগুলো এলিয়েন ধরনের, সংস্কৃতি আমেরিকান না, বিভিন্ন জিনিসের নামগুলো ইংরেজির সাথে মেলে না, সেখানে আমেরিকানরা গল্পটাকে কীভাবে নিজের মনে করে? কেন তারা ‘এখানে দেশীয় ভাইব কই’ বলে অভিযোগের তীর ছুঁড়ে দেয় না?

কারণ ওরা অনেক অনেক বছর ধরে এগুলো পড়ছে, ওরা পুরোপুরি অভ্যস্থ এবং হাই ফ্যান্টাসি আর যেকোনো ধরনের সেকেন্ডারি ওয়ার্ল্ড ফ্যান্টাসিকে তার রূপেই মেনে নিতে শিখেছে। আমাদের দেশে হাই ফ্যান্টাসি এখনো খুবই খুবই নতুন। আরো অনেকগুলো দিন এর সাথে কাটালে হয়তো একদিন আমরাও অভ্যস্ত হয়ে যাবো এর সাথে। তবে পাঠকরা যদি সচেতন হয়, সহনশীল হয়, এই ‘অনেকগুলো দিন’ প্রকৃত অর্থে আর ‘অনেকগুলো দিন’ হবে না, ‘অনেক কমসংখ্যক দিন’ হবে।

তবে কি হাই ফ্যান্টাসি বা সেকেন্ডারি ওয়ার্ল্ড ফ্যান্টাসিতে দেশি কোনো নামই থাকবে না? দেশীয় কোনো উপাদানই থাকবে না? থাকতেই পারে। স্টর্মলাইটেও আছে। এ সং অব আইস এন্ড ফায়ারেও আছে। সব হাই/সেকেন্ডারি ওয়ার্ল্ড ফ্যান্টাসিতেই কমবেশি থাকে। যদি আপনার মনে হয় এই নির্দিষ্ট দেশি নামটা আপনার জগতের সাথে মানাচ্ছে, বা ঐ চরিত্রটা যে জাতির ভেতর পড়ে তার সাথে যাচ্ছে, তবে দেবেন। এখানে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই যে দেশি নাম একেবারেই দেওয়া যাবে না। আমি নিজেও আমার হাই ফ্যান্টাসিগুলোতে মাঝে মাঝে কিছু দেশি নাম ব্যবহার করি। যেমন ড্রাগোমিরের হেনা, ইভান, আনিকা এই নামগুলো পরিচিতদের থেকেই নিয়েছিলাম। কুয়াশিয়ার মিরাজ, ঈশিকা, মিনহাজ এগুলোও দেশি নামই।

মূল কথা হচ্ছে, নামকরণে লেখক তার পূর্ণ স্বাধীনতা এবং সৃজনশীলতার প্রয়োগ ঘটাবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, দেশপ্রেম দেখাতে গিয়ে যেন জগতের স্বাতন্ত্র‍্য নষ্ট না হয়। নামগুলো, তা সে যে নামই হোক, যে সংস্কৃতি থেকেই নেওয়া হোক বা তৈরি করা হোক, এগুলো যেন জগতের সাথে খাপ খায়। শুনে যেন মনে হয় নামগুলো এই জগতেরই। কেবল দেশি ভাব আনার জন্য এমন নাম দিয়ে বসবেন না যা আপনার জগতের সাথে বা ঐ নির্দিষ্ট জাতির সাথে খাপ খায় না।

হাই ফ্যান্টাসির জগতে নামকরণ কীভাবে করবেন

অনেকেই হাই ফ্যান্টাসি জগতের বিভিন্ন উপাদানের নামকরণ কীভাবে করা যাবে তা নিয়ে বিভ্রান্তিতে ভোগেন। আমার সাজেশন হচ্ছে, আপনি যদি এই জনরায় নতুন হন, শূন্য থেকে কোনো নাম তৈরি করবেন না। শূন্য থেকে তৈরি করা নামের ভেতরটাও শূন্য হয়। আর ফাঁপা নাম কখনোই মনে আবেগ সৃষ্টি করে না। চেষ্টা করবেন নামটা ‘তৈরি’ করে নিতে। নামের একটা ব্যুৎপত্তি রাখতে। হ্যারি পটারের উদাহরণ দেই।

রোওলিং তার গল্পে নামগুলো কীভাবে তৈরি করেছেন তা দেখুন। ড্র‍্যাকো ম্যালফয়-এর ড্র‍্যাকো এসেছে এথেন্সের আইন প্রণেতা ড্র‍্যাকো থেকে। ম্যাল আর ফয় হচ্ছে প্রাচীন ফ্রেঞ্চ, যাদের অর্থ যথাক্রমে শয়তান এবং বিশ্বাস। ম্যালফয় মানে শয়তানের উপর বিশ্বাস রাখে যে।

আলবাস ল্যাটিন শব্দ, যার অর্থ আলো। রেমাস হচ্ছে প্রাচীন রোমের এক চরিত্র। নার্সিসা এসেছে গ্রিক মিথলোজির নার্সিসাস থেকে। হারমায়ানি ছিলো গ্রিক পুরাণের এক রাজকন্যা।

তার মানে আপনি নামগুলো সরাসরি মিথ, প্রাচীন ইতিহাস বা ভিন্ন কোনো ভাষা থেকে নিতে পারেন, কিংবা সেগুলো থেকে খানিকটা বিকৃত করে বা জোড়কলম করে নতুন শব্দ তৈরি করতে পারেন।

আমি নিজে কীভাবে তৈরি করি তা বলি এবার, হয়তো আপনার কাজে আসতে পারে। কুয়াশিয়াতে ব্যবহৃত কয়েকটা নাম ও টার্মের উদাহরণ দিচ্ছি।

অগ্রীব শব্দটা এসেছে সংস্কৃত অগ্রীয় থেকে। অগ্রীয় অর্থ প্রধান বা শ্রেষ্ঠ। আমার জগতে কোনো কেন্দ্র বা প্রতিষ্ঠানের প্রধানকে অগ্রীব বলে ডাকা হয়। ঋভিক এসেছে সংস্কৃত ঋভু থেকে, যার অর্থ দেবতা, অতিমানব ইত্যাদি। গল্পে ঋভিকরা হলো খনি শ্রমিক, যারা মানুষের চেয়ে অত্যধিক তাপ সহ্য করতে পারে বিধায় অসমোনিয়ামের খনির অস্বাভাবিক তাপমাত্রা সহ্য করেও ধাতুটা আহরণ করতে পারে। অগদ্রিসির এসেছে অগদ এবং আকসির থেকে, যাদের অর্থ যথাক্রমে প্রতিষেধক এবং মহৌষধ। অগদ্রিসির আপনাকে যেকোনো রোগ, জাদু এবং বিষের প্রভাব থেকে মুক্ত করে দেবে। অগদ এবং আকসির, এই শব্দ দুটো বাংলায় এসেছে আরবি থেকে। অসমোনিয়াম এসেছে অসমিয়াম ধাতু থেকে। ন্যাজবাওয়্যাঙ্ক (najbowank) এসেছে বসনিয়ান শব্দ najbolji এবং চিচিওয়া শব্দ wankhondo থেকে। najbolji মানে best, wankhondo মানে warrior। ন্যাজবাওয়্যাঙ্ক এর অর্থ বেস্ট ওয়ারিয়র বা সেরা যোদ্ধা।

তার মানে, আপনি নিজের দেশি শব্দ, বিদেশি শব্দ, মিথলোজি—যেকোনো উৎস থেকে বানিয়ে নিতে পারেন শব্দগুলো। শুধু মাথায় রাখবেন যেন এর পেছনে কোনো ব্যুৎপত্তিগত ইতিহাস থাকে। এতে করে শব্দগুলোকে ফাঁপা মনে হবে না, বরং অর্থবহ মনে হবে। তবে এভাবে শব্দ তৈরি করা অনেক শ্রমসাধ্য ব্যাপার, একেকটা শব্দ বের করতে এক থেকে দুই ঘণ্টা সময় লাগে। শব্দ তৈরি করতে করতে যখন হাত এসে যাবে, তখন দেখবেন এমনিতেই মাথায় অনেক শব্দ ঘুরে বেড়াবে, যেগুলোর বুৎপত্তি অজানা হলেও শুনতে ফাঁপা শোনাবে না।

হাই ফ্যান্টাসিতে সেকেন্ডারি ওয়ার্ল্ডের উপস্থাপন

কোনো ফ্যান্টাসির হাই হওয়ার প্রথম শর্ত হচ্ছে সেকেন্ডারি ওয়ার্ল্ড থাকা। তবে কি সেকেন্ডারি আর প্রাইমারি একত্রে থাকলে তাকে লো ফ্যান্টাসি বলবো? এটা আরেকটা ভুল ধারণা। হাই ফ্যান্টাসিতে টোলকিনের জগতকে তিনভাবে ব্যবহার করা হয়:

১। পরিচিত পৃথিবী বা প্রাইমারি ওয়ার্ল্ডের কোনো অস্তিত্বই থাকবে না। শুধুই টোলকিনের জগত থাকবে। যেমন: দ্য নেম অব দ্য উইন্ড, মিস্টবর্ন।

২। প্রাইমারি ওয়ার্ল্ড আর সেকেন্ডারি ওয়ার্ল্ড একই সাথে অবস্থান করবে। যেমন: নার্নিয়া।

এটা আবার হতে পারে কয়েকভাবে:

ক) গল্পের শুরু হবে প্রাইমারি জগতে। অল্প কিছু সময় পর সেকেন্ডারি ওয়ার্ল্ডের দরজা খুলে যাবে, আর চরিত্রগুলো সেখানে প্রবেশ করবে। এবং গল্পের প্রধান কাহিনিগুলো সেকেন্ডারি ওয়ার্ল্ডেই হবে।

খ) শুরু থেকেই দুই জগত পাশাপাশি অবস্থান করবে (প্যারালাল ওয়ার্ল্ড)। চরিত্রগুলো যখন খুশি এক জগত থেকে আরেক জগতে যেতে পারবে পোর্টালের মাধ্যমে। তবে গল্পের বেশিরভাগ সময় তারা টোলকিন-এর জগতে কাটাবে।

৩) পৃথিবীর অস্তিত্বের কথা চরিত্রগুলোর মুখে শোনা যাবে। কিন্তু পৃথিবীকে দেখানো হবে না।

খেয়াল করুন, নার্নিয়া উপরের ২ এর ক অনুযায়ী হাই ফ্যান্টাসি। শুধু নার্নিয়া নয়, এই জাতীয় যত গল্প আছে সবই হাই ফ্যান্টাসি। এখানে বলে রাখা ভালো, নার্নিয়ার মতো গল্পগুলোর কিন্তু আরো একটা নাম আছে—পোর্টাল ফ্যান্টাসি। ব্যাপারটা হচ্ছে, একটা ফ্যান্টাসি বই একাধিক সাবজনরায় পড়তে পারে।

হ্যারি পটার কি হাই ফ্যান্টাসি?

খুবই ঝামেলাপূর্ণ একটা টপিক। কিছু বই থাকে না, যারা জনরা বাউন্ডারি নিয়ে এমনভাবে খেলে যে জনরার প্রচলিত সংজ্ঞাই পুনরায় সম্পাদনা করার প্রয়োজন দেখা দেয়? হ্যারি পটার তেমনই একটা বই। লেখক নিকি গ্যাম্বেলের মতে, সেকেন্ডারি ওয়ার্ল্ড তিন ধরনের রূপ নিতে পারে। দুই ধরনের রূপের কথা আমি উপরের ১ এবং ২-তে বলে ফেলেছি। নিকি সেকেন্ডারি ওয়ার্ল্ডের তৃতীয় আরেকটা রূপের কথা বলেছেন। তার মতে, সেকেন্ডারি ওয়ার্ল্ড লুকিয়ে থাকতে পারে প্রাইমারি ওয়ার্ল্ডের ভেতরেই, যাকে বলে ওয়ার্ল্ড উইদিন এ ওয়ার্ল্ড, অথবা সেক্লুডেড ওয়ার্ল্ড। হ্যারি পটার এই অঞ্চলে পড়ে। আর তাই নিকি গ্যাম্বেলের তত্ত্ব অনুযায়ী, হ্যারি পটার হাই ফ্যান্টাসি।

তবে এ নিয়ে প্রচুর বিতর্ক আছে। আর তাই আমার মনে হয় হ্যারি পটারকে সরাসরি হাই ফ্যান্টাসিতে স্থান না দিয়ে তাকে সেক্লুডেড ওয়ার্ল্ড ফ্যান্টাসিতে স্থান দেওয়াটাই সবচেয়ে নিরাপদ। আর ঠিক এই কারণেই গত পোস্টে সেটিংসের ভিত্তিতে ফ্যান্টাসিকে তিনভাগে ভাগ করেছিলাম। তাই সেটিংসের ভিত্তিতে হ্যারি পটার সেক্লুডেড ওয়ার্ল্ড বা ওয়ার্ল্ড উইদিন এ ওয়ার্ল্ড ফ্যান্টাসি, আর সাবজনরার ভিত্তিতে একে ইয়ং এডাল্ট ফ্যান্টাসি বলাটাই সবচেয়ে নিরাপদ।

অনেকে হ্যারি পটারকে আরবান ফ্যান্টাসি হিসেবে ট্যাগ দিতে চায়। এটা করার কিছু সমস্যা আছে। আরবান ফ্যান্টাসি মানে শহরের পটভূমিতে লেখা ফ্যান্টাসি। ধরেন, শোণিত উপাখ্যান: বর্তমান একটা আরবান ফ্যান্টাসি। আবার, আর্কন, অক্টারিন আর পাপপিঞ্জরও আরবান ফ্যান্টাসি। এরা আরবান কারণ এদের কাহিনি গড়ে উঠেছে শহরকে কেন্দ্র করে। অন্যদিকে, হ্যারি পটার-এর উইজার্ডিং ওয়ার্ল্ড কিন্তু শহুরে পরিবেশে না। আরবান ফ্যান্টাসির আলাদা জগত নেই, ফ্যান্টাসি উপাদানগুলো আমাদের সাথেই ঘুরে বেড়ায়, কিন্তু যেকোনো কারণেই হোক আমরা তাদের দেখি না বা মুখোমুখি হই না বা তারা আমাদের সাথে খুব কমই সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।

অন্যদিকে, হ্যারি পটারের জগত নিজেই এক ধরনের সেকেন্ডারি ওয়ার্ল্ড, যার মাঝে আলাদা জাতি, সংস্কৃতি, রীতিনীতি, ইতিহাস ইত্যাদি আছে। এই সেকেন্ডারি ওয়ার্ল্ড আমাদের জগতের কোনো শহরের মাঝখানে অবস্থিত না, শহর থেকে অনেক অনেক দূরে পাহাড় আর বনভূমির মাঝে অবস্থিত (সত্যিকার অবস্থান জানা যায়নি)। এবং এটি নিজেই একটা আলাদা জগত, যে জগতে শুধু সুনির্দিষ্ট কিছু মানুষ প্রবেশ করতে পারে, সবাই পারে না (এটা আবার সেক্লুডেড ওয়ার্ল্ডের অন্যতম বৈশিষ্ট্য)।

এই ভুল ধারণার উৎপত্তি হয়েছে আরবান ফ্যান্টাসির জনপ্রিয়তার কারণে। ৮০-র দশকে জন্ম নেওয়া এই জনরা বর্তমানে খুবই জনপ্রিয় হওয়ায় প্রকাশক আর পাঠকদের মাঝে প্রাইমারি ওয়ার্ল্ডের যেকোনো ফ্যান্টাসিকে আরবান ফ্যান্টাসি ট্যাগ দেওয়ার প্রবণতা খেয়াল করা যায়। আর সেখান থেকেই এই ভুল শ্রেণিবিন্যাসের উৎপত্তি।

আর হ্যারি পটার নিয়ে প্রচলিত দ্বিতীয় ভুল ধারণার—হ্যারি পটার একটি পোর্টাল ফ্যান্টাসি—উত্তর গত পোস্টেই দিয়েছি।

হাই ফ্যান্টাসির বৈশিষ্ট্য

১। ম্যাজিক: এই ধরনের গল্পে ম্যাজিকের প্রভাব বেশি থাকে। পুরো পৃথিবীটাই এখানে ম্যাজিকের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। এখানে ম্যাজিক বলতে সরাসরি স্পেল না বুঝিয়ে বিশেষ ধরনের ক্ষমতাকেও বোঝাতে পারে। যেমন মিস্টবর্নের এলোমেন্সি একধরনের ক্ষমতা, যা আসলে সরাসরি ম্যাজিক না হলেও তার প্রতিস্থাপক হিসেবে কাজ করে।

২। প্লট: হাই ফ্যান্টাসির প্লট সাধারণত বেশ জটিল হয়।

৩। চরিত্রায়ন: এই ধরনের গল্পে চরিত্র সংখ্যা কম থাকে। একজন বা দুইজন হিরোর বেড়ে ওঠা, তাদের জীবনের উত্থান-পতন, জয়-পরাজয়, চূড়ান্ত পরিণতি ইত্যাদির দিকেই হাই ফ্যান্টাসির মনোযোগ বেশি থাকে। (কী, মাথায় কিছু নাম ঘুরছে যেগুলোর চরিত্র সংখ্যা বেশি, তাই না? ওগুলো শুধু হাই না, একই সাথে এপিকও। তাই চরিত্র বেশি।) হাই ফ্যান্টাসি যেহেতু চরিত্রনির্ভর গল্প, তাই সে চরিত্রায়নের গভীরতার দিকে মনোযোগ দেয়।

৪। সংঘাত: যুদ্ধ-বিগ্রহ, রক্তপাত এগুলো থাকতেও পারে, আবার তেমন একটা না হলেও সমস্যা নেই। রক্তপাত এই ধরনের গল্পের প্রধান ফোকাস না।

উদাহরণ:

১। দ্য লর্ড অব দ্য রিংস

২। মিস্টবর্ন

৩। স্টর্মলাইট আর্কাইভ

৪। ক্রোনিকলস অব নার্নিয়া

৫। দ্য নেম অব দ্য উইন্ড

৬। ওয়াইজ ম্যানস ফিয়ার

৭। দ্য হুইল অব টাইম

৮। মালাজান বুক অব দ্য ফলেন

৯। দ্য ইনহেরিটেন্স সাইকেল

১০। দ্য হবিট

দেশীয় হাই ফ্যান্টাসির তালিকাটা এখনো অত বড় নয়। তবে সম্প্রতি বেশ কয়েকটা হাই ফ্যান্টাসি বেরিয়েছে, যা আমাদেরকে আশাবাদী করে। রাজকীয় উৎসর্গ, মিরিয়া: যোদ্ধাকুমারীর খোঁজে, দাবনিশ আখ্যান: আসমানের আঁধার। এছাড়া, আমার নিজের তিনটা হাই ফ্যান্টাসি আছে: ড্রাগোমির, কুয়াশিয়া: স্পেলমেকারের অনুসন্ধান, অন্তিম শিখা। এখানে বলে রাখা ভালো, ড্রাগোমির টিপিক্যাল হাই ফ্যান্টাসি না। এর মাধ্যমে আমি চেষ্টা করেছিলাম হাই ফ্যান্টাসির সাথে ম্যাটাফিকশনাল টেকনিক মিশিয়ে জনরা বাউন্ডারিকে পুশ করতে। ওখানের হাই ফ্যান্টাসি জগত ‘ওটিয়োসাস’ সৃষ্টি হয়েছে বইয়ের ভেতর, কোনো এক ফ্যান্টাসি লেখকের লেখনশৈলীর জাদুতে।

আজ এ পর্যন্তই। পরবর্তী পর্বে আলোচনা করবো এপিক ফ্যান্টাসি নিয়ে। সে পর্যন্ত বিদায়।

পরের পর্ব 

আশরাফুল সুমনের চমৎকার আরেকটি আর্টিকেল 

উইকিপিডিয়া 

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

spot_img

সম্পর্কিত নিবন্ধ

জুতা (ছোট গল্প)- আফিন্দী

জুতাবিদ্যুৎ’এর গলার তেজে ফাঁকা মেসরুম গমগম করে উঠলো, “ভাই, তুমি যাবে পাঁচ ভাইয়ে? খিদেয় আমার জান যায়! খালা...

মৃত্যু পরবর্তী জগতের অভিজ্ঞতা 

মৃত্যু পরবর্তী জগতের অভিজ্ঞতা  মৃত্যু পরবর্তী জীবনের অভিজ্ঞতা কেমন? মানুষ তার অনিশ্চিত জীবনে শুধু একটি বিষয়ের নিশ্চয়তা নিয়ে জন্মেছে।...

বুক রিভিউ- হুমায়ূন আহমেদের ‘মেঘ বলেছে যাব যাব’

বুক রিভিউ- হুমায়ূন আহমেদের 'মেঘ বলেছে যাব যাব' বুক রিভিউ- হুমায়ূন আহমেদের 'মেঘ বলেছে যাব যাব'।বইয়ের নাম:মেঘ বলেছে যাব...

ডা. স্যাটান: সিরিয়াল কিলার ডা. মার্সেল পেটিওটের ভয়ংকর গল্প!

তাকে আখ্যা দেয়া হয়েছিল ডা. স্যাটান বলে। তিনি একই সাথে একজন সৈনিক, ডাক্তার, মেয়র, ভয়ঙ্কর অপরাধী এবং সিরিয়াল...