ফ্যান্টাসি জনরা পরিচিতি ৪

তারিখ:

পোস্ট শেয়ার করুন:

ফ্যান্টাসি জনরা পরিচিতি পর্ব ৪ – লিখেছেন- আশরাফুল সুমন 

পর্ব ৪

সাবজনরা: হার্ড ফ্যান্টাসি

মনে করুন আপনার গল্পে জাদু খুব শক্তিশালীভাবে উপস্থিত আছে। কিন্তু জাদু কীভাবে কাজ করে, এর উৎস কোথায়, এই ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে কী কী সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়, কেন করতে হয়, অতিরিক্ত জাদু প্রয়োগের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে ইত্যাদি আপনি আপনার গল্পে জুড়ে দিয়েছেন। তখন আপনার গল্পটা হয়ে যাবে হার্ড ফ্যান্টাসি। আবার, আপনি এমন একটি কাল্পনিক জগত তৈরি করলেন যেখানে ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভাষা, জাতি ইত্যাদি নিয়ে বেশ গভীরে ব্যাখ্যা করেছেন। সেই ক্ষেত্রেও আপনার গল্পটা হার্ড ফ্যান্টাসি।

তার মানে, কোনো গল্প হার্ড ফ্যান্টাসি কি না সেটা বলার জন্য দুটো প্যারামিটার আছে। নিচে সে দুটো প্যারামিটার নিয়ে আলোচনা করা হলো।

প্যারামিটার ১: জাদুক্ষমতার ব্যাখ্যা

আপনি যদি আপনার গল্পে জাদুক্ষমতার ব্যাখ্যা দেন, সেই সাথে কোন ক্ষমতাটা কীভাবে কাজ করে, কেন করে, কখন কম করে, কখন বেশি করে, প্রতিক্রিয়া কী, সীমাবদ্ধতা কী ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করেন, তবে আপনার গল্পটা হার্ড ফ্যান্টাসি।

ম্যাজিকের ব্যাখ্যা দেয়ার ক্ষেত্রে আদর্শ উদাহরণ হতে পারে মিস্টবর্ন। এই গল্পে যে বিশেষ ধরনের ম্যাজিক আছে তাকে বলা হয় ‘অ্যালোমেন্সি’। এর দ্বারা ধাতুকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। গল্পে ‘মিস্টবর্ন’ এবং ‘মিস্টিং’ যারা, কেবল তারাই ধাতুকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। সেখানে প্রতিটা ম্যাজিক কেন কাজ করে, কীভাবে কাজ করে, অতিরিক্ত ব্যবহার করলে পরিণতি কী হতে পারে সেসবের ব্যাখ্যা দেয়া আছে।

যেমন, ‘আয়রন পুলিং’-এর মাধ্যমে সেখানকার চরিত্রগুলো যেকোনো ধাতুকে নিজেদের দিকে টেনে আনতে পারে। ধরুন, কোনো চরিত্র আয়রন পুলিং-এর মাধ্যমে কোনো ধাতব বস্তুকে নিজের দিকে টানছে। বস্তুর ভর যদি ব্যক্তির চেয়ে কম হয়, তবে বস্তু তার দিকে চলে আসবে। আর যদি বস্তুর ভর বেশি হয়, তবে ব্যক্তি তার দিকে উড়ে যাবে।

আবার, তারা অ্যালোমেন্সি ব্যবহার করে ধাতব মুদ্রাকে প্রচণ্ড বেগে শত্রুর দিকে ছুঁড়ে দিতে পারে। এগুলোর গতি আর পুঞ্জীভূত শক্তির কারণে শত্রু পড়ে যায়, আবার অ্যালোমেন্সারের ক্ষমতার উপর নির্ভর করে কেউ কেউ সাথে সাথে মারাও যেতে পারে। এটা হয় কারণ তারা যখন অ্যালোমেন্টিক ক্ষমতা দিয়ে কয়েনকে ধাক্কা দেয়, তখন কয়েনের সাথে একটা বল যায়, যেটা হচ্ছে F=ma। এখানে m হচ্ছে অ্যালোমেন্সারের ভর। এখন যদি এই আঘাত ব্যক্তিকে না করে কোনো দেয়ালকে করা হয়, তবে কয়েনটা যে ছুঁড়ে দিয়েছে সে নিজেই পেছন দিকে উড়ে যাবে। এটা হয় কয়েনের উপর দেয়ালের প্রতিক্রিয়া বলের কারণে (নিউটনের তৃতীয় সূত্র)।

এই গল্পে শুধু ম্যাজিকের ব্যাখ্যাই নয়, বরং ম্যাজিকের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কেও বিস্তারিত বলা আছে। ভুল ধাতু ব্যবহার করলে কী হবে, বেশি সময় ধরে এই ক্ষমতা ব্যবহার করলে কী কী প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে, কোন ক্ষমতা ব্যবহার করার সময় কোনদিকে সতর্ক থাকতে হবে—সবকিছু খুব চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করা আছে এখানে।

হার্ড ফ্যান্টাসি অনেকটা হার্ড সায়েন্স ফিকশানের মতোই। হার্ড সায়েন্স ফিকশানে যেমন সায়েন্সের মাধ্যমে ঐ গল্পের বিভিন্ন অংশের খুব ভালো ব্যাখ্যা দেয়া হয়, এখানেও একই ব্যাপার। তবে এক্ষেত্রে কিন্তু ব্যাখ্যাটা ঠিক সায়েন্টিফিক হতে হয় না। লেখকের নিজের তৈরি করা কিছু নিয়ম থাকে, যে নিয়ম দিয়েই প্রতিটা ম্যাজিক বা ক্ষমতা ব্যাখ্যা করা হয়। এগুলো সায়েন্সের সাথে সম্পর্কিত হতেও পারে, আবার না-ও হতে পারে। এখানে লেখকের তৈরি করা জাদুর নিয়মগুলোই ঐ জগতের সায়েন্স। মোটকথা, আপনি ম্যাজিকের ব্যাখ্যা পাবেন এখানে। এবং সেটা ঠিক সায়েন্টিফিকভাবে নয়, ঐ জগতের নিজস্ব নিয়ম অনুযায়ীই যুক্তিগুলো আপনার সামনে উপস্থাপন করা হবে, এবং সেগুলো পড়ে আপনার মনে হবে, আরে তাই তো! এমনই তো হওয়া উচিত!

প্যারামিটার ২: কাল্পনিক জগতের গভীরতা

হার্ড ফ্যান্টাসি মানে শুধু ম্যাজিকের ব্যাখ্যাই নয়, বরং আরো অনেক কিছু। এমন অনেক ফ্যান্টাসি গল্প পাবেন যেখানে ভিন্ন জগত তৈরি করার পাশাপাশি সেই জগতের বিভিন্ন জাতির অতীত ইতিহাস, মিথ, সংস্কৃতি, সমাজতত্ত্ব, রাষ্ট্রতত্ত্ব ইত্যাদির বিশদ বিবরণ দেয়া হয়। এগুলো হার্ড ফ্যান্টাসির অন্যতম উপাদান বা বৈশিষ্ট্য।

যেমন ধরুন, সাধারণ ফ্যান্টাসি গল্পে হয়তো স্যাটার নামক প্রাণীর কথা বলা হবে, তাকে কাহিনির প্রয়োজনে ব্যবহার করা হবে, হয়তো তার পেছনের মিথটাও বলা হবে, কিন্তু হার্ড ফ্যান্টাসিতে স্যাটারদের নিয়ে মিথ বলার পরিবর্তে তাদের উৎপত্তি, অতীত ইতিহাস, সভ্যতা, ভাষা, সমাজ ইত্যাদি নিয়ে বিশদ বিবরণ দেবে। এখন আপনিই বলুন, এত কিছুর যদি পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ থাকে, তবে ঐ গল্পটা কি আর আপনার কাছে নিছক কল্পকাহিনি মনে হবে?

না, হবে না, বরং আপনি তখন গল্পটাকে বিশ্বাস করতে শুরু করে দেবেন। ঐ মুহূর্ত থেকেই গল্পটা আপনার কাছে যথেষ্ট পরিমাণে বাস্তবসম্মত বলে মনে হবে—সেটা ফ্যান্টাসি হওয়ার পরেও। আর তাই হার্ড ফ্যান্টাসিকে বলা হয় বাস্তবতার কাছাকাছি থাকা ফ্যান্টাসি (লো ফ্যান্টাসিকেও কিন্তু এটাই বলা হয়। তবে দুইটা দুই সাবজনরা।)

হার্ড ফ্যান্টাসিতে কি জাদুক্ষমতার ব্যাখ্যা থাকতেই হবে?

আপনার হার্ড ফ্যান্টাসি পরিমাপের দুই প্যারামিটারের যেকোনো একটি পূরণ করলেই সেটাকে এই সাবজনরায় ফেলা যাবে। জাদুক্ষমতার ব্যাখ্যা থাকায় নেম অব দ্য উইন্ড, মিস্টবর্ন এগুলো হার্ড ফ্যান্টাসি। আবার, টোলকিনের লর্ড অব রিংস-এ কিন্তু মিস্টবর্ন-এর মতো করে জাদুর অত ব্যাখ্যা দেয়নি। জাদু সেখানে ব্যাখ্যাতীত এক রহস্যময় শক্তি। কিন্তু এরপরেও একে হার্ড ফ্যান্টাসি বলা হয়। কারণ টোলকিন তার জীবনের বিশ বছর ব্যয় করেছেন মিডল আর্থ তৈরি করতে। খুব যত্ন নিয়ে গড়েছেন এর প্রতিটা ইতিহাস, মিথ, সংস্কৃতি, ভাষা, ভূপ্রকৃতি। এত গভীরভাবে গড়ার কারণে জগতটাকে বাস্তব বলে মনে হয়। স্বাভাবিকভাবেই এটা হার্ড ফ্যান্টাসি। একই যুক্তিতে এ সং অব আইস অ্যান্ড ফায়ার-ও হার্ড ফ্যান্টাসি, আবার উইচার-ও হার্ড ফ্যান্টাসি।

তার মানে আমরা কী দেখলাম? হার্ড ফ্যান্টাসি হিসেবে পরিগণিত হওয়ার জন্য জাদুর ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। ওয়ার্ল্ড বিল্ডিং যথেষ্ট গভীর আর শক্তিশালী এবং তথ্যবহুল হলেও সেটা এই সাবজনরায় পড়তে পারে।

হার্ড ফ্যান্টাসির বৈশিষ্ট্য:

ম্যাজিক:

কোনো কোনো গল্পে ম্যাজিকের প্রভাব এবং ব্যবহার খুব বেশি থাকতে পারে। যদি তাই থাকে, তবে হয়তো সেখানে একটি ম্যাজিক সিস্টেম বা জাদুতন্ত্রও থাকতে পারে। পাঠক সেই গল্পে ম্যাজিক বুঝবে, এর সম্পর্কে বিস্তারিত জানবে। কেন হচ্ছে, কী কারণে হচ্ছে, বেশি হলে কী প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে—সবই তারা জানবে এবং বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে।

আবার, অনেক গল্পে জাদুর ব্যাখ্যা না-ও থাকতে পারে। জাদুতন্ত্র অনুযায়ী তা সফট ম্যাজিকের ভেতর পড়তে পারে। জাদু সেখানে হবে ব্যাখ্যাতীত, রহস্যময় শক্তি। আবার, জাদু না-ও থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে তাকে হার্ড ফ্যান্টাসি হিসেবে পরিগণিত হতে হলে অবশ্যই, অবশ্যই ওয়ার্ল্ড বিল্ডিং বা জগতগঠনের গভীরতা যথেষ্ট হতে হবে।

চরিত্রায়ন:

সাধারণত মাঝারি মানের হয়। এইসব গল্পে ম্যাজিকের ব্যাখ্যা আর জগতের বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করতে এত বেশি পেজ নেয়া হয় যে এরপর চরিত্রায়নের পেছনে বেশি সময় দিতে গেলে গল্পের পেজ আরো বেড়ে যাবে। এই ধরনের গল্পের গতি এমনিতেই অনেক কম, তাই লেখকরা চেষ্টা করে চরিত্রায়নের দিকে কম মনোযোগ দিয়ে গতির ভারসাম্য রাখতে। তবে আজকাল হার্ড ফ্যান্টাসিতেও চরিত্রায়ন অনেক গভীর হয়। অত নিয়ম মেনে তো আর লেখা যায় না, তাই না? আর তাছাড়া, চরিত্রায়ন হলো গল্পের মৌলিক উপাদানগুলোর একটি। সব লেখকই এটা শক্তিশালী করতে চায়।

প্লট:

মাঝারি থেকে বেশ জটিল আকারের হতে পারে। অনেক লেখক চেষ্টা করে জটিলতা কম রাখতে। কারণ এমনিতেই প্রচুর ডিটেইলিং থাকে, তার উপর কাহিনি জটিল করলে পাঠক আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারে। আর সে কারণেই লেখকরা, বিশেষ করে নতুন বা স্বল্প পরিচিতরা প্লটের জটিলতা কমিয়ে দিয়ে ভারসাম্য রাখার চেষ্টা করে। আবার, স্যান্ডারসন, রথফাস আর মার্টিনের মতো লেখকদের কাহিনি বেশ জটিল এবং শাখা-প্রশাখাযুক্ত হয়। এদের ক্ষেত্রে অবশ্য ওসব তত্ত্বকথা খাটে না। কারণ তারা হলো ‘The breaker of chains.’ শৃঙ্খলভঙ্গকারী যদি হতে পারেন, তবে আপনার ক্ষেত্রেও হয়তো অনেক তত্ত্বকথাই খাটবে না।

ওয়ার্ল্ড বিল্ডিং:

যদি জাদুর ব্যাখ্যা থাকে, তবে জগতগঠনের গভীরতা অত না হলেও তা হার্ড ফ্যান্টাসিতে পড়বে। আর যদি ব্যাখ্যা না থাকে, তবে পরেরটা অবশ্যই গভীর হতে হবে। তবে আজকাল সব ফ্যান্টাসি লেখকই জগতগঠন যথেষ্ট গভীরে গিয়ে করে। ঐ হিসেবে অজস্র গল্পই হার্ড ফ্যান্টাসি—জাদুর ব্যাখ্যা থাকুক বা না থাকুক। যেহেতু ফ্যান্টাসির সফলতা অনেকাংশে নির্ভর করে জগতগঠনের উপর, তাই আমার মতে, আপনি যে সাবজনরাই লিখেন না কেন তার জগতটা সুগঠিতভাবে তৈরি করার চেষ্টা করাই উত্তম।

সংঘাত: ঠিক নেই। কম-বেশি যেমন হতে পারে, তেমনি মাঝামাঝিও হতে পারে।

উদাহরণ:

1/ A song of ice and fire

2/ Mistborn

3/ The kingkiller chronicles

4/ The lord of the rings

5/ The witcher

6/ The stormlight archive

7/ The wheel of time

বাংলা হার্ড ফ্যান্টাসির উদাহরণ দেয়াটা আসলে বেশ কঠিন। এখনো তো খুব বেশি কল্পজগত গঠন করিনি আমরা। তারপরেও যে কয়টি গুটিকয়েক উদাহরণ আছে, তার মাঝে দাবনিশ আখ্যান: আসমানের আঁধার-এ একটা হার্ড ম্যাজিক সিস্টেমের অস্তিত্ব আছে বলে জানি। সেই হিসেবে জাদুতন্ত্রের উপর ভিত্তি করে এটিকে হার্ড ফ্যান্টাসি বলা যায়। আমরা আশা রাখি, সামনে এ জাতীয় ফ্যান্টাসি আরো অনেক আসবে।

আগের পর্ব 

মিস্টবর্ণ সিরিজ উইকিপিডিয়া 

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

spot_img

সম্পর্কিত নিবন্ধ

জুতা (ছোট গল্প)- আফিন্দী

জুতাবিদ্যুৎ’এর গলার তেজে ফাঁকা মেসরুম গমগম করে উঠলো, “ভাই, তুমি যাবে পাঁচ ভাইয়ে? খিদেয় আমার জান যায়! খালা...

মৃত্যু পরবর্তী জগতের অভিজ্ঞতা 

মৃত্যু পরবর্তী জগতের অভিজ্ঞতা  মৃত্যু পরবর্তী জীবনের অভিজ্ঞতা কেমন? মানুষ তার অনিশ্চিত জীবনে শুধু একটি বিষয়ের নিশ্চয়তা নিয়ে জন্মেছে।...

বুক রিভিউ- হুমায়ূন আহমেদের ‘মেঘ বলেছে যাব যাব’

বুক রিভিউ- হুমায়ূন আহমেদের 'মেঘ বলেছে যাব যাব' বুক রিভিউ- হুমায়ূন আহমেদের 'মেঘ বলেছে যাব যাব'।বইয়ের নাম:মেঘ বলেছে যাব...

ডা. স্যাটান: সিরিয়াল কিলার ডা. মার্সেল পেটিওটের ভয়ংকর গল্প!

তাকে আখ্যা দেয়া হয়েছিল ডা. স্যাটান বলে। তিনি একই সাথে একজন সৈনিক, ডাক্তার, মেয়র, ভয়ঙ্কর অপরাধী এবং সিরিয়াল...