অচল নোট
সালমা সিদ্দিকা
আমি এক অচল একহাজার টাকার নোট। কিছুদিন আগে আমার একটা অপারেশন হয়েছে। কোন শয়তান যেন আমার লেজ কেটে একটা পঞ্চাশ টাকা নোটের লেজ লাগিয়ে দিয়েছে। অপারেশনের আগের সব স্মৃতি মুছে গেছে। লেজ কর্তন হলে স্মৃতি চলে যায়, কখনো ভাবিনি। বাংলা সিনেমায় দেখায় যে মাথায় বাঁশের আঘাত লাগলে স্মৃতি চলে যায় আবার আরেক আঘাতে স্মৃতি ফিরে আসে, আর আমার মেমোরির বাত্তি নাকি লেজের সাথে কানেক্টেড ছিল! অবাক কান্ড!
যাক, দুঃখ করে আর কী হবে? নতুন লেজ পেয়ে আমি খুব একটা আনন্দিত ছিলাম না। পঞ্চাশ টাকার লেজটা খুবই পুরানো স্টাইলের, আমার হাজার টাকার পার্সোনালিটির সাথে মোটেই খাপ খায় না। তবে অপারেশন তো হয়েই গেছে, এখন কাকে আর দুঃখের কথা বলবো। প্রথমে ভাবলাম নতুন লেজের সাথে মানিয়ে নেবো। কিন্তু আমার জীবনে শুরু হলো ট্রাজেডি।
জীবনের প্রথম স্মৃতি একটা স্বামী স্ত্রীকে নিয়ে। স্ত্রী কয়দিন আগেই তার বান্ধবীকে দেখেছে পার্লারে গিয়ে গোল্ড ফেসিয়াল করে এসেছে, তারপর থেকে বান্ধবীর গাল গোল্ডের মতোই চকচকে। অতএব এই ফেসিয়াল তাকেও করতে হবে। । কিন্তু হাজব্যান্ডকে তো বলা সম্ভব না যে গোল্ড ফেসিয়াল করার টাকা দাও, স্বামী একটু কিপটা কিসিমের। গোল্ড ফেসিয়াল তো দূরের কথা, তামার ফেসিয়ালও করতে দেবে না। তাই স্ত্রী বললো, ডাক্তার দেখাতে হবে, হাজব্যান্ড যেন তিন হাজার টাকা দেয়। স্বামী বেজার মুখে মানিব্যাগ খুলে তিনটা এক হাজার টাকার নোট দিলো। আমি কিভাবে কখন সেই স্বামীর মানিব্যাগে ঢুকেছি, তা ইয়াদ নাই। শুধু বুঝলাম স্ত্রী গদগদ ভঙ্গিতে আমাকে বাকি দুই নোটের সাথে নিয়ে নিজের পার্সের ভিতর রাখলো। বেচারি পরে পার্লারে গিয়ে ফেসিয়াল করে টাকা বের করে দিতেই পার্লারের ক্যাশিয়ার মুখ কালো করে বললো, “আপ্পি, এই নোট তো জোড়া দেয়া, চেঞ্জ করে দেন।”
এখন স্ত্রী পড়লো মহা বিপদে, তার কাছে তো আর টাকা নেই। আমাকে ঘৃণাভরে পার্সের ভেতর ঢুকিয়ে নিয়ে অনেক কাকুতি মিনতি করে পরের দিন টাকা দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তবেই তিনি বাসায় ফিরতে পারলো। পুরো রাস্তা আমাকে আর স্বামীকে গালাগালি করলো, বুঝতেই পারছেন।
স্বামী স্ত্রীর মান অভিমান ঝগড়া শেষে আবার ফিরে এলাম স্বামীর মানিব্যাগে। মনে মনে ভাবছি এবার জানি আবার কার কাছে যাই। স্বামী পরদিন ভাবলেন ব্যাংকে গিয়ে আমাকে বদলে নতুন নোট নেবেন। কিন্তু সময় কই? কাজ করেই কুল পায়না আর একটা নোট বদলাতে ব্যাংকে গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার কথা ভাবলেই গা শিওরে ওঠে। স্বামীর মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। অফিসে বন্যার্তদের জন্য সাহায্য নেয়া হচ্ছে। অফিসের পিয়ন সবার টেবিলে গিয়ে একটা কার্ডবোর্ড বক্সে টাকা সংগ্রহ করছে আর একটা কাগজে কে কত টাকা দিচ্ছে সেটা লিখে নিচ্ছে। যে যার মতো টাকা দিচ্ছে, কেউ একশো, কেউ পাঁচশো। স্বামী পিয়নকে বললেন, তার কাছে এক হাজার টাকার নোট আছে, পাঁচশো দিতে চান। পিয়ন সরল মনে কার্ডবোর্ডের বাক্সটা এগিয়ে দিলো। স্বামী আমাকে পেঁচিয়ে এমন ভাবে ভাঁজ করলেন যাতে আমার পঞ্চাশ টাকার লেজ দেখা না যায়। বাক্সে আমাকে ফেলে পাঁচশো টাকার একটা নোট উঠিয়ে নিলেন। ব্যাস, আমার যন্ত্রনা থেকে মুক্তি পেলেন। আর আমার জায়গা হলো অন্ধকার কার্ডবোর্ড বাক্সে।
বাক্সে বসে থাকতে থাকতে ভাবছিলাম এরপর না জানি কার বিরক্তির কারণ হই। কতক্ষন সময় গেলো, যে জানে। হঠাৎ আলোর মুখ দেখলাম। অফিসের একাউন্টস ডিপার্টমেন্টের একজন বাক্স খুলে সব নোট গুনে নিলেন। সব মিলিয়ে টাকা উঠেছে আটাশ হাজার দুইশ। তিনি ভাবলেন, একটা রাউন্ড ফিগার করে পঁচিশ হাজার টাকা দিলেই তো হয়। যেই ভাবা সেই কাজ। তিনহাজার টাকার তিনটা নোট আর একশো টাকার দুইটা নোট তুলে টুপ করে নিজের পকেটস্থ করে ফেললেন। জ্বি জনাব, আমি সেই তিনটি এক হাজার টাকার নোটের একজন। অবশ্য আমি এখন পুরোপুরি এক হাজার টাকার নোট না, আমাকে কেটেকুটে হাইব্রিড নোট বানিয়ে ফেলা হয়েছে। যাই হোক, এরপর একাউন্টসের লোকটা পঁচিশ হাজার টাকা তুলে দিলো বন্যার্তদের জন্য সাহায্য নিতে আশা এক চ্যারিটি অর্গানাইজেশনের কর্মচারীর হাতে।
সন্ধ্যায় বাসায় ফেরার সময় একাউন্টসের সেই লোক, মানে আমার তৎকালীন মালিক কাওরান বাজারে গেলেন কমলালেবু আর বেদনা কিনবেন বলে। তার ছেলে ফলমূল খুবই পছন্দ করে, বিশেষ করে বেদনা তো মুঠো মুঠো করে মুড়ির মতো খায়। কিন্তু এত দাম এই ফলটার, কেনার সাহস হয় না। আজ অবশ্য পকেটে কিছু উপরি টাকা আছে। ছেলের জন্য একটু ফল নিয়ে গেলে বেশ হয়। ছেলেটা রোগা পটকা, এই একজিনিস ফল ই তার একমাত্র পছন্দের খাবার।
ফলের দোকানে ফল নেয়া শেষে পকেট থেকে আমাকে বের করে দোকানির হাতে দিলেন। দোকানি আমার শরীর একটু নেড়ে ছেড়ে দেখেই মহা অসন্তুষ্ট হয়ে হাঁকলেন, “এইটা কী নোট দিলেন স্যার? বাতিল নোট। বদলাইয়া দেন।”
আমার মালিক পড়লেন ফাঁপরে! নিজের নির্বুদ্ধিতায় নিজেকেই মনে মনে তিরস্কার করলেন। তিন হাজার টাকা যখন নিলেনই, একটু দেখে শুনে পরখ করে নোটগুলো নিলে কী হতো? আবার কে দেখে ফেলে, এই ভয়ে ঠিক মতো নোটগুলো না দেখেই নিতে হয়েছে। কপালের ফেরে জুটেছে এই বাতিল নোট।
একটা চাপা নিঃশ্বাস ফেলে দোকানদারের কাছ থেকে আমাকে ফেরত নিলেন আমার দুর্ভাগা মালিক। আর এদিকে আমার নিজেকে ঘেন্না লাগতে শুরু করলো। হায়রে আমার পোড়া কপাল, সামান্য এক অপারেশনের কারণে আজ আমি সবার অবহেলার পাত্র হয়ে গেলাম? একসময় আমি ছিলাম দেশের সবচেয়ে দামি নোট, আর লেজ বদলের কারণে আজ হলাম অচল? বলা বাহুল্য, মালিক তখন বিরক্তির চরম সীমায়। মনে মনে ভাবছেন, কিভাবে আমার যন্ত্রনা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। যতক্ষণ আমার চেহারা দেখবেন, ততক্ষনই নিজেকে বোকা মনে হবে।
তখনই বাজারের ইলেকট্রিসিটি বন্ধ হয়ে গেলো। দোকারদাররা নিজেদের জেনারেটর চালু করতে ব্যস্ত হয়ে গেলো, চারপাশে একের পর এক ঘটঘট শব্দে জেনারেটরগুলো জেগে উঠলো। আমার মালিক হঠাৎ দেখলেন কোনায় একটা বইয়ের দোকানে সবে চালান এসে পৌঁছেছে। একটা ভ্যান থেকে বই, স্টেশনারি ইত্যাদি বের করে দোকানে তুলে দেয়া হচ্ছে। দোকানের তরুণ কর্মচারী ছুটোছুটি করে দোকানের মাল-সামান বুঝে নিচ্ছে। কাউন্টারের পেছনে একজন বৃদ্ধ মতো লোক বসে আছেন, সম্ভবত তিনি দোকানের মালিক।
মনে পড়লো, ছেলের জন্য কিছু ছড়ার বইয়ের ফরমায়েশ অনেকদিন থেকেই করছিলেন গিন্নি। মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেলো। বইয়ের দোকানে ঢুকে বৃদ্ধ লোকটিকে বললেন কিছু ছড়ার বই দেখাতে , সাথে কিছু রং পেন্সিল আর রং করার খাতাও দিতে বললেন। বৃদ্ধ একটু অপ্রস্তুত হয়ে এদিক ওদিক তাকালেন, তিনি ঠিক জানেন না কোথায় কী আছে, কর্মচারী ওসব সামলায়। কিন্তু কর্মচারী ছেলেটি ব্যস্ত। আমার ধুরন্ধর মালিক বললেন, “চাচা, তাড়াতাড়ি জিনিসগুলা দেন, একটু পরে আমার বাস চলে যাবে।”
উপায়ন্তর না দেখে বৃদ্ধ একটু খোঁজাখুঁজি করে কয়েকটা ছড়ার বই আর বাকি জিনিস এলে দিলেন। মালিক ঝটপট কয়েকটা বই খাতা পছন্দ করে বিল করতে বললেন। বৃদ্ধ ক্যালকুলেটর নিয়ে হিসাব করে দেখলেন, বিল চারশো বিশ টাকা।
আমার মালিক ত্রস্ত হাতে আমাকে বৃদ্ধর হাতে তুলে দিয়ে হড়বড় করে বললেন, “তাড়াতাড়ি এক হাজার টাকার চেঞ্জ দেন চাচা, ছেলের জন্য বই নিয়ে যাচ্ছি, ছেলেটা না খেয়ে বইয়ের অপেক্ষা করছে, বইয়ের পাগল যাকে বলে। আর আঁকার পাগল। দেন দেন , ভাংতি দেন, আমাকে এক্ষুনি যেতে হবে। বাস চলে যাচ্ছে।”
একদিকে তো ইলেকট্রিসিটি নেই, চার্জ লাইটের আলোতে খুব ভালো করে দেখা যায় না, তার ওপর বকবক করে বৃদ্ধর মনোযোগ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিয়ে ভাংতি পাঁচশো আশি টাকা নিয়ে প্রায় ছুটে বেরিয়ে গেলেন আমার প্রাক্তন মালিক। আমি পড়ে রইলাম বইয়ের দোকানের ক্যাশ ড্রয়ারে। দীর্ঘশ্বাস ফেলি আর ভাবি, আমার এই অভিশপ্ত জীবন কবে শেষ হবে? কেউ বরং ছিড়ে কুটিকুটি করে আমার দেহটা এই জাদুর শহরের হাওয়ায় ছড়িয়ে দেয় না কেন?
রাতে দোকান বন্ধ করার আগে ক্যাশ বাক্স থেকে টাকা বের করে গুনতে গিয়ে বৃদ্ধ মালিক আমাকে আবিষ্কার করলেন। বুড়োর মাথা পরিষ্কার, স্পষ্ট মনে আছে টাকা কে দিয়েছিলো। এমন ঘোল খাওয়ালো লোকটা? একটা জোড়া-তালি দেয়া নোট দিয়ে উল্টো টাকা ফেরত নিয়ে গেলো! নাহ, চোখের ডাক্তার দেখিয়ে চশমা বদলে নেয়া প্রয়োজন। কেমন করে এমন বাতিল নোট খদ্দেরের কাছ থেকে নিলেন তিনি? একবার চোখেও পড়লো না? এসব ভেবে নিজেকে ভীষণ হাদা মনে হলো।
মন খারাপ করে বাড়ি ফিরলেন বৃদ্ধ। তার পকেটে আমিও মন খারাপ করে বসে থাকলাম। বৃদ্ধ বাসায় এসে দেখেন গ্রাম থেকে তার এক ভাতিজা বেড়াতে এসেছে। ছেলেটির নাম মানিক। বড়ই ত্যাঁদড় ছেলে। চাচাকে দেখেই কুশল বিনিময় শেষে বলতে লাগলো, “আহারে, চাচা আপনের এখন আরাম করনের বয়স, তা না, এত রাত পর্যন্ত কাম কইরা শরিলডা তামাতামা হইয়া গেলো। আহারে আমার চাচারে কেউ দেহে না।” বলে তার চাচির দিকে ইঙ্গিত করলো। চাচী মুখ ঝামটা দিয়ে চলে গেলো আর মনে মনে ভাবলো, কোথাকার কোন দরদিয়া উপস্থিত হয়েছে রে!
রাতে খাবার টেবিলে বকবক করে সবার মাথা নষ্ট করে দিলো মানিক। তার গল্প যেন ফুরায় না ! গ্রামে কোন ফুটবল ম্যাচে সে পাঁচটা গোল দিয়েছে, কোন ডাকাতের দলকে একলা একলা বুদ্ধি করে পাকড়াও করেছে, গ্রামে কত বড় মাছের খামার করেছে, টিনের বাংলো বাড়ি তৈরী করেছে ইত্যাদি চাপাবাজি করে নিজেকে খুব জাহির করলো। শেষমেশ বললো আগামীকাল চাচার সাথে একটু টিকাটুলি যাবে মাছের খামারের জন্য কিছু জিনিসপত্র কিনতে। বৃদ্ধ উপায়ন্তন না দেখে বললেন বিকেলে নিয়ে যাবেন।
আমি মনে মনে ভাবছি, আবার জানি কার হাতে পাচার করে আমার বর্তমান মালিক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবেন। পরদিন আমার বর্তমান মালিক সারাদিন আর বাইরে গেলেন না , তার পেটে একটু গুড়গুড় করছে। করবে না কেন? পাক্কা এক হাজার টাকা ধরা খাওয়া বলে কথা। এমন ধরা খেলে পেট মোচড়াবেই। বিকেলে মানিককে নিয়ে বের হলেন টিকাটুলীর উদ্দেশ্যে। মানিক তার কেনাকাটা শেষ করে আবদার ধরলো কাচ্চি বিরিয়ানি খাবে। ঘোরাঘুরি করতে করতে বেশ রাত হয়ে গেছে, খিদেও পেয়েছে ভীষণ। দুইজনে ঢুকলেন “কাদের বিরিয়ানি হাউজ” এ। পেট ভরে বিরিয়ানি খেয়ে মানিক ভাবছে বিলটা নিশ্চয়ই চাচা দেবে। এদিকে বৃদ্ধ ভাবছেন, বিলটা যেভাবেই হোক মানিককে দিয়েই দেয়াবেন। তিনি হঠাৎ বললেন, “মানিক রে, পেটের অবস্থা তো ভালো না, তোরে আগেই বলছিলাম। তুই এক কাজ কর, টাকা দিয়া যাইতেছি, তুই বিল দিয়া আয়। আমি দেখি বাইরে টয়লেট পাই কিনা। তোর সাথে তো অনেক মাল পত্র , তুই একটা রিকশা নিয়ে বাসায় চইলা যা।”
বৃদ্ধ পকেট থেকে ভাঁজ করা অবস্থায় আমাকে মানিকের হাতে দিয়ে প্রায় ছুটে বেরিয়ে গেলেন। আমি একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ভাবলাম, “এইবার মানিক তোর কপাল পুড়লো।”
মানিক আয়েশ করে পায়েস খেয়ে খেতে ভাবলো, চাচাকে ভালোই ‘ছিল’ দেয়া হয়েছে। এক হাজার টাকা এখন তার হাতে, আরো কিছু খাওয়া যাক। সে দই, জর্দা আর সাথে আরেক বাটি পায়েস অর্ডার করলো। সব ঠুসে ঠুসে খাওয়ার পরে ঢেকুর তুলে কাউন্টারে গেলো বিল দিতে। মোট বিল আটশো তিয়াত্তর টাকা। মানিক আমার ভাঁজ করা দেহটা এগিয়ে দিলো কাউন্টারে বসা ম্যানেজারের দিকে। মুশকো ম্যানেজার আমাকে নেড়ে চেড়ে দেখে বাজখাঁই গলায় বললো, “এইডা কী দিলেন? তালি মারা নোট দিলেন কী মনে কইরা? চেঞ্জ কইরা দেন।”
মানিক আকাশ থেকে পড়লো। খামারের জিনিসপত্র কেনা পরে তার হাতে সামান্য টাকা আছে, ফেরত যাবার বাস টিকেট হবে তাতে। সে মানিব্যাগ হাতিয়ে দেখলো ভেতরের কয়েকটা ন্যাতানো নোট পড়ে আছে। তাড়াতাড়ি চাচার ফোনে কল করলো, বন্ধ! অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে, হাত পা ধরে মানিব্যাগে থাকা সাকুল্যে চারশো তিরিশ টাকা ম্যানেজারের হাত ধরিয়ে দিয়ে বললো, পরদিন এসে বাকিটা দেবে। ম্যানেজার মশাই ভালোই বুঝলো, এই লোক আর আসবে না, তাই ইচ্ছা মতো বাপ মা তুলে গালি দিতে ভুল করলো না।
অপমানিত মানিক মনে মনে চাচার চোদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করলো। বাসায় যে ফিরবে, রিকশা ভাড়াটা পর্যন্ত নেই। দুই হাত ভর্তি মালামাল। হাঁটতে হাঁটতে চাচার বাড়িতে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। গরমে মানিকের গলা শুকিয়ে গেলো।
রাস্তায় ‘প্যানি প্যানি ঠান্ডা প্যানি’ বলে কতগুলো ছোকড়া ছুটোছুটি করছে। মানিক একটা ছেলেকে ডেকে এক বোতল পানি দিতে বললো। পানি না খেলে মাথা ঘুরে পরেও যেতে পারে। পানির দাম দশ টাকা চাইতেই মানিক তেতে গিয়ে বললো, “ট্যাকা থাকলে কি এতগুলা মাল নিয়ে হাইটা যাইতাম? এই নে, একহাজার ট্যাকার একটা নোট আছে, তোরেই দিলাম।”
ছেলেটা আমাকে নেড়েচেড়ে দেখে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে বললো, “এই তালি মারা ট্যাকা দিয়া আমি কিতা করতাম? পানির দাম দশ ট্যাকা দেন। “
“আমার কাছে আর কোনো ট্যাকা নাই। ব্যাংকে গেলে এইটা বদলায় দিবো। আবার বায়তুল মোকাররমের সামনে ছিড়া নোট বদলানির দোকান আছে, ওইখানে গিয়া ট্যাকা বদলায় নিস।”
“এই ট্যাকা আপনেই বদলায় নিয়েন স্যার, আমার দশ ট্যাকাই দেন।”
“ধুর শালা, ওই বালের ট্যাকা আমি আর ধরুমই না। তুই নিলে নে, নাইলে ভাগ। বলছি না, আমার কাছে আর ট্যাকা নাই।” বলে ছেলেটার হাতে আমাকে ফেলে মানিক হনহন করে চলে গেলো।
ছেলেটা আমাকে হাতে নিয়ে মনে মনে দুইটা গালি দিলো। খুবই বাজে গালি, তাই আমি আর এখানে উল্লেখ করছি না। লুঙ্গির গিটে আমাকে রেখে আবার ‘প্যানি প্যানি’ বলে চেঁচিয়ে পানি বিক্রি করতে শুরু করলো। গভীর রাত পর্যন্ত পানি বিক্রি শেষে বস্তির ঘরে ফিরলো ছেলেটা। বয়স চব্বিশ পঁচিশ হবে। মাত্র কিছুদিন আগেই বিয়ে করেছে। বৌয়ের বয়স উনিশ। চোখে কাজল মেখে স্বামীর অপেক্ষায় ভাত নিয়ে বসে ঘুমে ঢুলছিলো মেয়েটা। ক্লান্ত ছেলেটা ফিরতেই চট করে ঘুম ভেঙে গেলো তার। পানি এগিয়ে দিয়ে ভাত সাজাতে বসলো। ছেলেটা একটু হাত মুখ ধুয়ে এসে খেতে বসলো। খেতে খেতে শুরু হলো আমাকে নিয়ে গল্প। কিভাবে এক বাটপার লোক পানি খেয়ে একটা ছেড়া নোট দিয়ে গেলো, সেটাই ইনিয়ে বিনিয়ে বললো।
খাওয়া শেষে লুঙ্গির গিট্ খুলে আমাকে বের করে বৌয়ের হাতে দিলো ছেলেটা। নরম গলায় বললো, “তোমারে তো কিছুই দিতে পারি না। একটা গ্রিন কালারের শাড়ি পছন্দ করছিলা না? এই নোটটা রাখো। তোমারে উপহার দিলাম। ব্যাংকে গেলে এইটা বদলাইয়া নতুন এক হাজার ট্যাকা পাওয়া যাইবো।”
“কিন্তু ব্যাংকে আমি ক্যামনে যামু? আমারে ঢুকতে দিবো?”
“পাশের ঘরের বিল্লাল ভাইরে বললে এইটা বদলাইয়া নিয়ে আসবো, ওনার বলে ব্যাংকে খাতা খোলা আছে। আর তাও যদি না পারে, অনেক দোকানে বলে অচল নোট বদলাইয়া দেয়। কিছু ট্যাকা কাইটা রাখে, তাতে কী? যদি সাত-আষ্টশো ট্যাকাও পাও, ওই শাড়ি কিনতে পারবা। নেও , রাখো।”
মেয়েটা লাজুক মুখে পরম আগ্রহে আমাকে নিলো। এই প্রথম কেউ আমার সত্যিকারের পরিচয় গোপন করলো না, আমার অপারেশন করা তালি দেয়া শরীর ঢেকে অন্য একজনকে ঠকাতে চাইলো না।
গভীর রাতে স্বামী ঘুমিয়ে যাওয়ার পরে মেয়েটা উঠে খাটের তলায় রাখা কাঁচের চুড়ির বাক্সে আমাকে যত্ন করে রেখে দিলো। এরপর প্রতিদিন ভাবি, মেয়েটা হয়তো আজকে আমাকে অন্য কারো হাতে তুলে দেবে, আমাকে বদলে নতুন নোট নেবে। কিন্তু মেয়েটা আমাকে হাতছাড়া করেনি। আমি যে তার স্বামীর দেয়া প্রথম উপহার! মাঝে মাঝে বাক্স খুলে আমাকে স্পর্শ করে, ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে, আবার রেখে দেয়। ওর চুড়ির বাক্সে আমার দিন কাটে পরম মমতা আর ভালোবাসায়।
(সমাপ্ত)
লিখেছেন সালমা সিদ্দিকা