ছোট সামছু’র লকডাউন বৃত্তান্ত
শরীফুল হাসান
ছোট সামছুর মেজাজ খুব খারাপ। লকডাউন চলছে। পকেট একদম ফাঁকা। এলাকায় যেসব বড় ভাইদের সাথে ঘুরতো, ফিরতো, থাকতো, সেসব ভাই-ব্রাদাররা এখন লকডাউনে। কিন্তু লকডাউন তো পেট মানে না। পেটের খিদের চেয়ে বড় আজাব পৃথিবীতে আর নাই। সে কারো কাছে চাইতে পারে না, এটা একটা সমস্যা। বড় ভাইরা তাকে এমনিতেই টাকা দিতো, হাত খরচের জন্য। এরজন্য বড় ভাইদের অনেক অন্যায্য কাজও করে দিতো সে। কোন সময় হাত খালি থাকলে ছিনতাই করতো। কারো কাছ থেকে হাত পেতে টাকা নেয়া ছোট সামছুর ধাঁতে নেই। কিসের সাহায্য-ফাহায্য, ছোট সামছু কারো সাহায্যের ধার ধারে না।
সেই এই মুহূর্তে মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে বসে আছে মহাখালির কাছাকাছি এক বস্তিতে। ফোনে যে কয়টা টাকা আছে সেটা দিয়ে একটা কল করা যেতে পারে। টাকা যে রিচার্জ করবে সেই টাকাও হাতে নেই। কাছাকাছি এক বড় ভাই আছে, নাহিদ আলম নাম। তার কাছে কিছু টাকা ধার চাওয়া যেতে পারে। কল বাটনে চাপল সামছু।
রিং বেজে বেজে অনেকক্ষন পর কল রিসিভ হলো।
“ভাইজান, সামছু কইতাছি?”
“ক।”
“ভাইজান, কিছু টেকা লাগে।”
“কতো?”
“হাজার পাঁচেক দেন, কয়টা দিন পার করি।”
“টেকা তোর পু..” এরপর ওপাশ থেকে যে গালাগালির ঝড় বয়ে গেল তা থেকে বাঁচতে ফোনটা কান থেকে দূরে সরাল সামছু। তারপর কল কেটে দিল।
নাহিদ আলম এতো ক্ষেপা কেন মনে পড়ল। এই তো কিছুদিন আগে তাকে একটা কাজ দিয়েছিল। গুলশানের এক ব্যবসায়ীকে গিয়ে হুমকি-ধামকি দিয়ে আসতে হবে। সেই ব্যবসায়ীর নাম শুনেই ভড়কে গিয়েছিল সামছু। সে টুকটাক চাঁদাবাজি করে, সেটাও বড় ভাইদের ছত্রছায়ায়। এতো বড় ব্যবসায়ীকে সরাসরি হুমকি দিয়ে আসা তার জন্য অনেক বেশি হয়ে যায়। নাহিদ আলম ব্যাপারটা মনে রেখেছে।
মোবাইল ফোনটা বিছানার একপাশে ছুঁড়ে মারল সামছু। ব্যালেন্স শেষ। এখন চাইলেও ফোন করা যাবে না।
বাসা থেকে বের হবে, তাতেই বা কী লাভ! এই দুপুর বেলায় পুরো এলাকায় একটা কাক-পক্ষী নেই। এলাকার চায়ের দোকান খোলা থাকলেও দুপুরটা চা-বিস্কুট খেয়ে পার করা যেতো। বিল না হয় পরেই দিতো।
এসব ভাবতে ভাবতে বাসা থেকে বের হলো সামছু। কমদামী একটা মাস্ক কিনেছিল, সেটা মুখের উপর পরে নিলো। তার কেন জানি মনে হয় এইসব ভাইরাস টাইরাস ভূয়া। এসব হলেও বড়লোকদের হতে পারে। তারমতো পাতি লোকজনের এইসব রোগ হবে না আর হলেও জান যাবে না। জীবনে কম মার খায়নি সামছু। ছিনতাই করতে গিয়ে বা পকেট মারতে গিয়ে উত্তেজিত জনতার হাতে পিটুনি খাওয়ার পরও যে মানুষ বহাল তবিয়তে বেঁচে থাকে, তাকে সামান্য ভাইরাস কী করবে!
বাসা থেকে চড়চড়ে রোদের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে বনানীর দিকে চলে এলো। এইখানে বড় বড় বিল্ডিং। সব অফিস আর আপার্টমেন্ট। বড় লোকের জায়গা। সব বড়লোক এখন বাসার মধ্যে লুকিয়েছে। সারাদিন বসে পপকর্ণ খাচ্ছে আর সিনেমা দেখছে। লকডাউন ওদের জন্য আশির্বাদ। সন্ধ্যা পর্যন্ত একটা বিল্ডিং-এর নীচে লুকিয়ে রইল সামছু।
মাঝে মাঝে পুলিশ টহল দিচ্ছে। কাউকে দেখলেই জিজ্ঞাসাবাদ করছে। ওদের হাতে পড়লে নির্ঘাত হাজতে ঢোকাবে। পুলিশগুলো চলে যাওয়ার পর সামছুর একটু আফসোস হলো। হাজতে নিশ্চয়ই খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা থাকবে! রাত আটটার দিকে সামছুর মনে হলো পেট কামড়ে ধরেছে। যে কাজটা তার খুবই অপছন্দের সেই কাজটাই করতে হবে মনে হচ্ছে। হাত পাততে হবে। কিন্তু হাত পাতবে কোথায়! কেউ তো নেই।
বিল্ডিং-এর দারোয়ানগুলো সব চামার। ওদের কাছে সাহায্য চেয়ে লাভ নেই। এরচেয়ে যে কাজটা দিয়ে জীবনে আয়-রোজগারের শুরু সেটাই করবে বলে ঠিক করলো।
অন্ধকারে ঘুরতে ঘুরতে দোতলা একটা বাড়ি বেছে নিলো সামছু। বনানীতে এরকম বাড়ি অল্প দু’একটা টিকে আছে, যেগুলো এখনো ডেভেলপাররাদের হাতে পড়েনি। পুরো বাড়িটার দেয়ালও খুব উঁচু নয়। দেয়াল টপকে ঐপারে যেতে পারলেই হলো।
রাত দশটার দিকে সামছু দেয়াল টপকাল। বাড়ির সামনে ছোটখাট একটা উঠোন। দেয়াল থেকে পড়ে বেশ ব্যথা পেয়েছে, পা মচকে গেছে সম্ভবত। কোনমতে উঠে দাঁড়াল। ভয় হচ্ছিল এইসব বাড়িতে পেল্লায় সব বিদেশি কুকুর ছেড়ে দেয় রাতে। একটা ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে নীচতলায় বড় কাঠের দরজাটার দিকে তাকাল। এটাই প্রবেশপথ। কিন্তু এটা দিয়ে ঢুকবে বাড়ির অতিথিরা, তার মতো নিশিকুটুম্ব নয়।
ঝোপঝাড়ের আড়ালে আড়ালে বাড়ির পেছনের দিকে চলে এলো সামছু। এখান থেকে রান্নাঘরটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। অন্ধকার। নীচতলায় কোথাও বাতি জ্বলছে বলে মনে হলো না। উপরের তলায় একটা রুমের বাতি জ্বলছে। ওটা সম্ভবত বেডরুম।
রান্নাঘরের পেছনের দিকে ছোট একটা দরজা আছে। দরজাটায় তালা লাগানো। এই দরজা দিয়ে হয়তো বাড়ির পেছনের দিকে আসা-যাওয়া করে কাজের লোকজন, ভাবল সামছু।
বেশ কিছুক্ষণ তালাটা নিয়ে নাড়াচাড়া করল। মানিব্যাগ বের করল। আগে তালা খোলায় বেশ বিশেষজ্ঞ ছিল, বিশেষ করে চায়নীজ তালা। ম্যানিব্যাগের এক ফাঁকে সরু লম্বা লোহার তারটা পাওয়া গেল। এটা দিয়ে খোঁচাখুঁচি করে দেখা যায়। বেশ অনেকক্ষন ধরে খোঁচাখুঁচি চালাল সামছু। তাকে অবাক করে দিয়ে ফট করে খুলে গেল তালাটা।
ভেতরে ঢোকার আগে চারপাশে তাকাল। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কেউ তাকে দেখেনি। সে আগে রান্নাঘর খুঁজবে, আগে দরকার কিছু খাবার। তারপর অন্য কিছু চুরি করা যায় কিনা দেখা যাবে।
অন্ধকার রান্নাঘরের এক কোণায় বড় আকারের রেফ্রিজারেটর চোখে পড়ল। ওটার পাশে মাঝারি আকারের একটা ডিপ ফ্রিজ। ডিপ ফ্রিজ খোলার প্রয়োজন নেই। বড় ফ্রিজটা খোলার আগে চারপাশ দেখল। কোথাও কোন শব্দ নেই। নীচতলা ঘুটঘুটে অন্ধকার। বাসায় তেমন কেউ নেই সম্ভবত, থাকলেও হয়তো একজন, দুজন। নইলে এই রাত দশটায় এতো নীরব থাকার কথা নয়।
খুব সাবধানে রেফ্রিজারেটর খুলল সামছু। ডালা খোলার সাথে সাথে ফ্রিজের ভেতরের আলোয় বেশ আলোকিত হলো রান্নাঘরটা। ভেতরটা দেখে বেশ রোমাঞ্চিত অনুভব করল। থরে থরে খাবার সাজানো। ফল, আট-দশটা বিরিয়ানীর প্যাকেট, অর্ধেক খাওয়া পিজা, কোক, চকলেটের প্যাকেট, জ্যাম-জেলি। আপাতত একটা আপেল টেনে নিলো সামছু। আপেলে কামড় দিতে দিতে একটা
বিরিয়ানীর প্যাকেটটা বের করল। একদম বরফের মতো ঠান্ডা। এটা গরম করার উপায় নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু সেই ঝামেলায় যাওয়ার প্রয়োজনবোধ করলো না সামছু। ফ্রিজের দরজা খুব সাবধানে লাগাল। তারপর রান্নাঘরের এক কোণায় বসল। ঘুটঘুটে অন্ধকারে বিরিয়ানীর প্যাকেটটা খুলে খাওয়া শুরু করল। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে প্যাকেটে কোন ‘রাইস’ নেই, শুধু চাপ চাপ মাংস।
মাংসগুলো জমে গেছে। খেতে অবশ্য বেশ ভালো লাগছিল। দাঁত দিয়ে টেনে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে হচ্ছে। বেশ কষ্ট হলেও খিদের যন্ত্রনা থেকে মুক্তি পেতে যতোটা দ্রুত সম্ভব খাওয়ার চেষ্টা করছে সামছু। মাংসগুলো এতোটাই জমে গেছে যে গলা দিয়ে নামতে চাচ্ছে না। কোনমতে বেশ কয়েক টুকরো গিলে ফেলল। পানির তেষ্টা পেয়েছে খুব। প্যাকেটটা একপাশে রেখে দ্রুত ফ্রিজ খুলল। একটা কোকের বোতল খুলে ঢকঢক করে পান করলো কিছুটা। ফ্রিজের দরজা বন্ধ করতে গিয়েই জমে গেল সামছু।
মাঝবয়সী এক লোক খুব কাছেই দাঁড়িয়ে আছে। ফ্রিজের আলোয় লোকটাকে আবছা দেখা যাচ্ছে। তাকিয়ে আছে তার দিকে। সামছু ফ্রিজের দরজা লাগাল। তবে তাতে লাভ হলো না। লোকটা রান্নাঘরের বাতি জ্বেলে দিয়েছে একপাশের সুইচ টিপে। তাতে সামছু এখন ¯পষ্ট দেখতে পাচ্ছে পুরো রান্নাঘরটা আর কাছেই দাঁড়ানো লোকটাকে।
রান্নাঘরের যে কোণায় বসে একটু আগে খাচ্ছিল সে জায়গাটা দেখে গা ঘিনঘিন করে উঠলো তার। মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে লাল লাল সব মাংসের টুকরো, সেখান থেকে রক্ত গড়িয়ে জমাট বেঁধে আছে। মাংসগুলোর টুকরোর মাঝে কয়েকটা টুকরো দেখে বমি চলে আসলেও কোনমতে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলো। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে ওখানে কয়েকটা হাতের আঙুল আছে। আঙুলে নখের মাথায় লাল রঙের নেইল পালিশও পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে।
লোকটার হাতে লম্বা অস্ত্রটা এতোক্ষন চোখে পড়েনি। বেশ বড় আকারের ধারাল একটা ছুরি। সামছুর দিকে তাক করে আছে।
“এইদিকে আসো, একটু এদিক-সেদিক করবা, কিমা বানায়া ফেলমু,” খুব ঠান্ডা গলায় বলল লোকটা।
হাঁটার শক্তি পাচ্ছিল না সামছু। বারবার ঐ মাংসের দৃশ্য চোখে ভাসছে আর পেট মোচড় দিয়ে বমি আসতে চাচ্ছে। তবু লোকটার কথামতো সামনে এগুলো। এক এক করে বেশ কিছু বাতি জ্বালাল লোকটা। বড় একটা রুমের মাঝ বরাবর সামছুকে দাড়াতে বলে নিজে একটা সোফায় হেলান দিয়ে বসল।
“ঐটা কী মাইনষের মাংস?”
“আয়নায় নিজের চেহারা দেখ,” লোকটা বলল।
ড্রইং রুমের একপাশে বড় একটা আয়না লাগানো। তার সামনে দাঁড়াল সামছু। নিজের চেহারা দেখে নিজেই চমকে গেল। রক্তে মাখামাখি একটা মুখ। বীভৎস দেখাচ্ছে।
“স্যার, আমি কি মাইনষের মাংস খাইছি!” চেঁচিয়ে উঠলো সামছু।
লোকটা দ্রুত গতিতে এসে সামছুর গলায় ছুরি ধরল। আরেকটু চাপ দিলেই গলা কেটে রক্ত বেরিয়ে আসবে। ভয় পেল সামছু। এভাবে সে মরতে চায় না।
“এই মাংসের কী গতি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না, তুমি আসাতে ভালো হয়েছে,” লোকটা আবার সোফায় গিয়ে বসল।
“কি কন এইসব?”
“শোনো, ফ্রিজে অল্প কিছু মাংস আছে, বাকিটা আছে ঐ ড্রিপ ফ্রিজে। লকডাউনের কারনে কোন গতি করতে পারছিলাম না।”
“স্যার, এই মাংস কার?”
“আর বলো না,” বিরক্তির সাথে বলল লোকটা, “লকডাউনে আমি আর আমার স্ত্রী ছিলাম বাসায়। কাজের লোক, দারোয়ান সবাইকে ছুটি দিয়ে দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম এই ভাইরাসের সময় বাইরের কারো থাকার দরকার নেই। আমরা স্বামী-স্ত্রীই যথেষ্ট। কিন্তু একটা ঝামেলা হয়ে গেল!”
“কি ঝামেলা?”
“আমার স্ত্রী, মানে তোমার ভাবি সে আমার কাছে হাতে-নাতে ধরা পড়ে গেল।”
“ধরা পইড়া গেল মানে?”
“আগেও তাকে নিয়ে আমার সন্দেহ ছিল, সে আমাকে লুকিয়ে কারো সাথে প্রেম করে। এই লকডাউনে সারাদিন আমার সাথে থাকতে হচ্ছিল। একদিন রাতে ঘুম ভেঙে পাশের ঘরে গিয়ে দেখি সে ঐ লোকের সাথে ভিডিও চ্যাট করছে, অশ্লীল সব কথাবার্তা বলছে।”
“তারপর?”
“তারপর আর কি! বলো দেখি! এসব সহ্য করা যায়!”
“তা অবশ্য ঠিক,” সামছু মাথা নেড়ে সায় দিল।
“ওকে গলা টিপে মেরে ফেললাম রাগের মাথায়। লাশের কোন গতি করতে পারছিলাম না। দোতলা বাড়ি। চারপাশে সব উঁচু বিল্ডিং। বাড়ির পেছনে যে গর্ত করে মাটিচাপা দেবো, কারো না কারো চোখে ধরা পড়বে। গাড়ি নিয়ে বাইরে যাবো, সেটাও সম্ভব না। পুলিশ টহল দিচ্ছে। তাই যা করার করলাম।”
“কী করলেন?”
“বাসায় মাংস বানানোর সব যন্ত্রপাতি ছিল। কোরবানির ঈদে একটা গরু তো আমিই নামিয়ে ফেলি। তোমার ভাবিকেও আমিই নামালাম। একটা দিন পুরো লাগল কাটাকুটিতে, আরেকদিন রান্নাঘর পরিষ্কার করতে।”
“ভাবিসাহেবের মাংস সব ফ্রিজের ভেতরে?”
“হু। তুমি একটা প্যাকেট থেকে খুলে কিছুটা খেয়েছো। বাকি আর সাত প্যাকেট আছে। এছাড়া বড় অংশটা আছে ডিপ ফ্রিজে।”
সামছুর পেট আবার গুলিয়ে উঠল। কোন অচেনা ভাবিসাহেবার মাংস তার পেটে সহ্য হচ্ছে না।
“স্যার, আমারে ছাইড়া দেন। গরীব মানুষ। খাওয়া-খাদ্য নাই দেইখ্যা চুরি করতে নামছি।”
“অবশ্যই ছেড়ে দেবো। তবে তার আগে এই পুরো মাংসটা তোমাকে খেয়ে শেষ করতে হবে।”
“এইসব কি বলেন স্যার?”
“যা বলার তাই বললাম।”
“আমি পারমু না স্যার।”
লোকটা উঠে এলো সামছুর দিকে। ছুরিটা সামছুর পেটের উপর বসাল আস্তে করে। একটু একটু করে চাপ বাড়াল। এমনিতেই সামছু কাঁপছিল, সে লোকটার পায়ে পড়ল।
“স্যার, আমারে মাইরেন না!”
“মাংস খেয়ে শেষ করো, তাহলেই মুক্তি।”
“ঠিক আছে স্যার, কিন্তু আমি কাঁচা খাবো না। রান্না করে খাবো।”
“সেটা তোমার ইচ্ছা। তোমার ভাবিসাহেবাকে তুমি রান্না করে খাবে না কাঁচা খাবে সেটা তোমার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। এখানে আমি নাক গলাবো না। আমি ব্যক্তিস্বাধীনতায় খুব বিশ্বাস করি।”
“কিন্তু ভাবি প্রেম করে এইজন্য যে মাইরা ফেললেন?”
“ব্যক্তিস্বাধীনতা মানে পরকীয়া নয় রে পাগল! তার কাউকে ভালো লাগছে সেটা আমাকে বললেই পারতো। আমি তাকে যেতে দিতাম। কিন্তু আমার কাছে সাধু সেজে আমাকে ধোঁকা দেবে তা তো হবে না।”
লোকটার যুক্তিতে চমৎকৃত হলো সামছু। বোঝা যাচ্ছে নিজের স্ত্রীকে মারার পর সেটার পক্ষে-বিপক্ষে বেশ ভালো যুক্তি দাঁড় করিয়েছেন।
“আপনে কিন্তু কথা দিছেন, মাংস শেষ হইলে আমারে ছাইড়া দিবেন।”
“মরদকা বাত হাতিকা দাঁত।”
প্রায় মাসখানেক পার হয়েছে, লকডাউন এখনো চলছে। সামছু আজ দুপুরে বসে শেষ প্লেট মাংস শেষ করলো। আনন্দে তার চোখে পানি চলে এসেছে। আজ তার মুক্তি। লোকটাকেও বেশ আনন্দিত দেখা যাচ্ছে। সামছুকে একটা চেয়ারের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে এতোদিন। শুধু খাবার সময় হাত খুলে দেয়া হতো। মাংস রান্নাটা লোকটাই করেছে। তবে সেটা সামছুর কথামতো। ছোটবেলায় গুলশানের এক রেস্টুরেন্টে গরুর মাংস রান্না করা দেখতে দেখতে সেটা খুব ভালো শিখে গিয়েছিল সামছু। অনেকদিন পর সেটাই কাজে লাগাল। বেশ চমৎকার রান্না হয়েছিল। বিশেষ করে আজকের রান্নাটা ছিল সবচেয়ে সেরা।
সামছু’র হাতের বাধন খুলে দিলো লোকটা। তার হাতে ছুরিটা ধরা আছে।
“তুমি তোমার কথা রেখেছো, আমি আমার কথা রাখছি। আজ তুমি মুক্ত।”
“আপনে আসলে লোকটা তেমন খারাপ না,” সামছু বলল।
“বাইরে গিয়ে কাউকে কিছু বলো না, অবশ্য বললে আমার সাথে তুমিও জেলে যাবে,” সাবধান করে দিলো লোকটা।
“আপনের কী মাথা খারাপ! সাইধা জেলে যায় পাগলে! আমার মাথা ঠিক আছে।”
“ঠিক আছে, যাও তুমি। দরজা খোলা আছে। এই এলাকায় যেন না দেখি।”
“কোনদিনই দেখবেন না,” সামছু বলল। উবু হলো হঠাৎ করেই। তারপর আচমকা লোকটার হাত থেকে ছুরিটা কেড়ে নিলো। ঘটনাটা এতো দ্রুত ঘটলো যে লোকটা নড়ার সময়ই পেল না।
“কি করছো, কি করছো..” বলছিল লোকটা।
সামছুর সেদিকে খেয়াল নেই। সে লোকটার গলা বরাবর ছুরিটা চালিয়ে দিয়েছে। সরু একটা রেখা দেখা গেল শুরুতে, সেই রেখাটা বড় হয়ে গলগল করে রক্ত বেরুতে শুরু করল। লোকটা দুই হাতে গলা চেপে মেঝেতে শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ দাপাল, তারপর নিথর হয়ে গেল।
সামছু লোকটার টি-শার্টে ছুরির রক্ত মুছে নিলো। ড্রইং রুমের আয়নায় নিজের দিকে তাকাল।
“এই মাংসের মজা যে পাইছে, তার আর কোন মজার দরজার নাই, বুঝলেন ভাইজান!” লোকটার ঘাড়ে টোকা দিয়ে বলল সামছু। তারপর ছুরির একটান বসাল। “লকডাউন আমার ভালোই কাটবে।”
লিখেছেন- শরীফুল হাসান