তিব্বতঃ এক নিষিদ্ধ দেশের ইতিহাস
পৃথিবীতে কতো দেশই তো আছে, কতো দেশ নিজেদের রাষ্ট্র, সমাজ, সংস্কৃতির জন্য বিখ্যাত। এমনও কিছু দেশ আছে যেখানে অদ্ভুত কিছু কারণে বিখ্যাত হয়ে পৃথিবীর বুকে চিরকাল রাজ করছে এবং করবে। তেমনই এক অদ্ভুত দেশের গল্প জানতে যাচ্ছি আমরা, দেশটির নাম তিব্বত। এই দেশটি মূলত নিষিদ্ধ দেশ নামেই পরিচিত। তবে কেন নিষিদ্ধ তার পেছনে রয়েছে হাজার হাজার বছরের পুরনো ইতিহাস। আজকে আমরা জানবো এই দেশটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ার পেছনে লুকিয়ে থাকা কিছু অজানা তথ্য বা ইতিহাস।
তিব্বত দেশটি সাধারণত মধ্য এশিয়ায় অবস্থিত। তিব্বত অঞ্চলটি গড়ে উঠেছে তিব্বতীয় জনগোষ্ঠীকে নিয়ে। এই দেশটিকে বলা হয়ে থাকে পৃথিবীর সুউচ্চ ছাদ, কেননা এর উচ্চতা প্রায় ১৬০০০ ফুট। চীনের অতি প্রাচীন ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, এই দেশটি বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস এবং সংস্কৃতির সাথে জড়িয়ে আছে। এই দেশটিতে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত এবং চীনের মতোই দুইটি অতি প্রাচীন সভ্যতার বিস্তার ঘটে। তিব্বত সাধারণত চীনের মধ্যকার সীমান্ত হিসেবে বেশ কয়েক বছর ধরে অবস্থান করে আসছে। বিভিন্ন ইতিহাস থেকে উঠে এসেছে যে, ১৯১২ সালের দিকে চীনের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে তিব্বতকে একটি স্বাধীন দেশ বা রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষিত করা হয়। তিব্বতের রাজধানী লাসা। লাসা নামের অর্থ দেবতাদের ভূমি। এর বর্তমান পরিচয় চীনের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল। আর যার কারণে তিব্বতীয়দের ভাষা চীনা ভাষা। এর আয়তন সম্পর্কে ধারণা করা যায় যে, এটি প্রায় ১২,২৮,৪০০ বর্গ কিলোমিটার।
যদিও এটিকে সবাই বৌদ্ধ ধর্মের সংস্কৃতির দেশ হিসেবেই জেনে থাকেন, কিন্তু শুধুমাত্র তিব্বতীয় সংস্কৃতি নয়, বরং মঙ্গোল ও মাঞ্চু জাতীর সংস্কৃতিতেও এরা বেশ এগিয়ে।
তিব্বতীয়দের সাম্রাজ্য নিয়ে হাজার হাজার ইতিহাসের কথা চলে আসলেও এর বেশ কিছু ইতিহাস বেশ আলোচিত।
যে কারণে তিব্বত একটি নিষিদ্ধ দেশ
এতো এতো ইতিহাস কিংবা সংস্কৃতির মাঝেও এই দেশটি নিষিদ্ধ দেশ হিসেবেই পরিচিত। পৃথিবীর সব দেশই কোন না কোন কারণে আলোচিত বা সমালোচিত হয়ে থাকে। আর একেক দেশের বেশ কিছু রহস্যময় ব্যপারও জড়িয়ে থাকে। আমরা মানুষরা রহস্যই পছন্দ করে থাকি। রহস্যের বেড়াজালে ঘেরা এই তিব্বত দেশটি এক অদ্ভুত কারণেই নিষিদ্ধ দেশ হিসেবে সারা বিশ্বে রাজ করে চলেছে। তবে এই দেশটির পুরো অংশটিই নিষিদ্ধ নয়, কেবল মাত্র দেশটির রাজধানী লাসাকেই নিষিদ্ধ বলা হয়ে থাকে। তবে বিশ্বের সবাই পুরো তিব্বতকেই নিষিদ্ধ বলে জেনে এসেছে। এদেশের লোকজনেরা নিজেদের নিষিদ্ধ দেশের নাগরিক হিসেবে বেশ গর্ববোধও করে থাকেন। এই দেশটি অন্যান্য দেশ থেকে অনেক বেশি শান্তিপ্রিয়। হিমালয়ের বরফে ঢাকা তিব্বতের নাগরিকেরা নিজেদের দেশ সম্পর্কে বাইরের কোন জগতে বলতে তেমন স্বাচ্ছন্দ্যবোধও করেন না। এরা সাধারণত রহস্যের বেড়াজালে থাকতেই বেশি পছন্দ করে থাকেন। আর তাই প্রায় শত শত বছর ধরেই আড়ালে থেকে গেছে এই দেশের নাম, দেশটির অন্যান্য ইতিহাস। যেহেতু এটি চীনের একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল, তাই এটিকে কোন নির্দিষ্ট করে আলাদা দেশ হিসেবেও কোন স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। এখানকার লোকজন, সংস্কৃতি সবকিছুই অন্য দেশ থেকে বেশ আলাদা। রোমাঞ্চকর এই দেশটির নাগরিকদের জীবনও তাই অনেক বেশি রোমাঞ্চকর এবং এদের জীবনযাত্রা বেশ ভিন্ন।
যদিও এটি চীনেরই একটি অংশ, তবুও এটা অনেকেই মানতে নারাজ। আর এই কারণেই ১৯৬৯ সাল নাগাদ তিব্বতিরা দালাইলামা’র ( তিব্বতি ধর্মগুরু) নেতৃত্বে চীনের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য প্রস্তুত হতে থাকেন। যদিও সেটা আন্দোলন হিসেবেই চালানো হয়। আর তাদের এই আন্দোলনও শেষ পর্যন্ত সফল হতে পারেনি। এতকিছুর পরে তিব্বত নিষিদ্ধ হওয়ার পেছনে মূলত এর প্রাকৃতিক পরিবেশ, এদের জীবনযাত্রা, ইত্যাদিই প্রধান কারণ হিসেবে ধরা হয়।
এছাড়া এদেশের নিষিদ্ধ হওয়ার পেছনে আরও একটি সূক্ষ্ম কারণ খতিয়ে দেখেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, তিব্বত বছরের প্রায় ৮ মাস বরফে ঢাকা থাকে। যার কারণে এটি ধীরে ধীরে দুর্গম স্থান বলেই বিবেচিত হয়। এই দেশটি আসলে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি উচু স্থানে অবস্থিত, আর এতো উচ্চতার কারণে এখানে নিশ্বাস নেয়াও বেশ কষ্টকর ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। এই দেশের উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে আনুমানিক ১৬ হাজার ফুট উপরে! প্রচণ্ড ঠাণ্ডা এবং এই উচ্চতার জন্যে এই দেশে বসবাস করা বেশ কষ্টেরও।
বিভিন্ন কারণে এদেশে পর্যটকরা প্রবেশ করতে পারেন না। এর পেছনে প্রধান কারণ হচ্ছে, এদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা বেশ খারাপ এবং এদেশের আবহাওয়াও তেমন সুবিধার না। ঠাণ্ডার কারণে প্রায় সারা বছরই এটি বরফে ঢাকা থাকে, আর তাই পর্যটকেরা এলেও সুবিধা করে উঠতে পারেন না। আর তাই অন্যান্য দেশে পর্যটকদের ভীর থাকলেও এখানে পর্যটকেরা আসতে তেমন আগ্রহ দেখায় না। এইসকল কারণে এদেশে এক সময় ভ্রমণের উপর নিষেধাজ্ঞাজারী করা হয়। যদিও ১৯৮০ সালে এই নিষেধাজ্ঞা তুলে দেয়া হয়। আর এই সিদ্ধান্তের পরপরই বিশ্বের অনেকেরই এই দেশ সম্পর্কে আগ্রহ জন্মাতে শুরু করে। তিব্বতের অদ্ভুত এই ব্যপার গুলোই যেন অন্যান্য দেশের নাগরিকদের দৃষ্টি কেড়ে নিতে সক্ষম হয়। তবে এক সময় পর্যটক সহ সাংবাদিক পর্যন্ত প্রবেশে বেশ কড়াভাবেই নিষেধাজ্ঞা ছিল। আর নিষিদ্ধ দেশের জনপ্রিয়তা যেন আরও বাড়তেই থাকে!
তিব্বতের রাজধানী লাসায় দীর্ঘদিন বাইরের নাগরিকদের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ ছিল, যার কারণে বিশ্বে এদেশের ইতিহাস বা পুরো রাজ্যটিই রহস্যের আড়ালে থেকে যায়। কি আছে লাসা কিংবা তিব্বতে তা জানার জন্য মানুষ দিনদিন কৌতূহল প্রকাশ করতে থাকেন। জানা যায়, লাসা শহরে “পোতালা” নামক এক বিশাল প্রাসাদ আছে, যা বাইরের নাগরিকেরা প্রথম দেখার সুযোগ পান ১৯০৪ সালে। এই প্রাসাদটি এতোটাই জনপ্রিয়তা লাভ করে যে এর ছবি এবং এর টুকটাক ইতিহাস সম্পর্কে কিছু লেখা ছাপানো হয় আমেরাক্র এক বিখ্যাত পত্রিকায়। নিষিদ্ধ দেশের খেতাব পাওয়া এই দেশটি এক সময় পুরো পৃথিবীতেই রহস্যময় ইতিহাসের জায়গা করে নিতে সক্ষম হয়।
তিব্বতকে নিয়ে একটি কথা প্রচলন হয়। জানা যায়, তিব্বতে কারো মৃত্যু হলে তাকে তার মৃত্যুর সাথে সাথেই সৎকার করা হয় না! তিব্বতীয়রা আত্মায় প্রবল বিশ্বাসী, তাদের ধারণা মতে তাদের মৃত মানুষের আত্মা মরে যাওয়ার পরেও এই জগতে বিচরণ করতে থাকে। আর তাই যে পর্যন্ত তাদের আত্মা জগৎ ত্যাগ না করে সে পর্যন্ত তারা সেই মৃতের সতকার সম্পন্ন করেন না! আর ততক্ষণ সেই মরদেহ তাদের বাসাতেই অবস্থান করে। এবং তাদের মধ্যে এটিও প্রচলিত আছে যে, তাদের প্রধান দালাই লামা এক অলৌকিক ধ্যানে তাদের নতুন দালাই লামার ছবি আঁকতে পারেন। আর এরপরই শুরু হয় তিব্বতের প্রতিটি ঘরে গিয়ে সেই নতুন দালাই লামা অর্থাৎ নতুন শিশুকে খুঁজে বের করতে থাকেন। এদের কেউ মারা গেলে এরা সাধারণত আত্মার সৎকার হিসেবে এক ভিন্ন পূজা করে থাকেন। তাদের ধারণা, সেই মৃত ব্যক্তিটি মরে যাওয়ার পর যেকোনো রূপে যে কারো উপর ভর করতে পারে। আর এ থেকেই বোঝা যায়, তিব্বতীয়রা সংস্কৃতি বা কুসংস্কারের দিক থেকে বেশ বিশ্বাসী।
তবে তাদের এই অদ্ভুত সংস্কৃতি বা তাদের পরিবেশ, আবহাওয়া ইত্যাদি ছাড়িয়ে গেছে তাদের একটা ইতিহাসেই আর সেটা হচ্ছে “নিষিদ্ধ দেশ”! এই চমৎকার হিমালয়ের দেশে কার না ঘুরে বেড়াতে মন চাইবে? এতো সুন্দর, মনোরম দেশটি আজও বইয়ের ইতিহাসে তাই আজও পরিচিত এক নিষিদ্ধ দেশ হিসেবেই!
রেফারেন্স- উইকিপিডিয়া