সিনেমা: দ্য গ্রীন মাইল (১৯৯৯)- রিভিউ

তারিখ:

পোস্ট শেয়ার করুন:

সিনেমা: দ্য গ্রীন মাইল (১৯৯৯)

পরিচালক: ফ্র্যাঙ্ক ডারবন্ট

স্ক্রিপ্ট: Stephen King

অভিনয়ে: Tom Hanks, Micheal Duncan, David Morse প্রমূখ।

সিনামার ধরণ: ক্রাইম, ড্রামা আইএমডিবি রেটিংঃ ৮.৬/১০

গ্রীন মাইল
সংগৃহীত

Stephen King একজন বিখ্যাত লেখক। তাঁর অসংখ্য উপন্যাস থেকে তৈরি হয়েছে নানাবিধ চলচ্চিত্র। একইভাবে Tom Hanks হচ্ছেন এমন একজন অভিনেতা যিনি পুরো পৃথিবীতেই পরিচিত তাঁর অনবদ্য অভিনয়ের জন্য।

কিছু কিছু সিনেমা থাকে যেগুলো বাস্তবতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কল্পনার জগতকে আরো বেশি বাস্তব করে তোলে। বাস্তবতা ও কল্পনার কম্বিনেশনে একটা ঘোরের সৃষ্টি করে। তেমনই একটি সিনেমা নিয়ে আজ আমরা আলোচনা করব।

সিনেমাটিতে অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা থাকলে পৃথিবীটা কতটা সুন্দরভাবে সাজানো যেত তার প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে। কঠিন বাস্তবতার সাথে কল্পনার এক অসাধারণ মেলবন্ধন এই সিনেমা। সেইসাথে সুনিপুণ অভিনেতাদের অভিনয় দক্ষতা পুরো স্ক্রিনপ্লে জুড়ে এক মায়াময় আবহ তৈরি করে রাখে যা সিনেমা শেষ হলেও রেশ থেকে যায়। আর একটা সার্থক সিনেমা তো এমনই হয়! 

হ্যাঁ, এমনই এক সিনেমা- “দ্য গ্রিন মাইল”। যার সাবলীল ঘটনাপ্রবাহ আপনাকে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত স্ক্রিনে ধরে রাখবে; একসময় অনুভব করবেন- মনের মধ্যে মেঘের স্তুপ জমা হয়ে আপনার চোখে বৃষ্টির সতর্কতা!

গ্রীন মাইল
সংগৃহীত

Stephen King এর লেখা “The green mile” উপন্যাস অবলম্বনে Frank Darabont-এর পরিচালনা এবং সেইসাথে কিংবদন্তি Tom Hanks এবং Micheal Duncan-এর অনবদ্য অভিনয়ে সিনেমাটি পেয়েছে এক অনন্য মাত্রা।

যারা সিনেমাটির ব্যাপারে জানতেন না আজ জেনে নিতে পারবেন। আর যারা জেনেও অবহেলায় দেখেননি আশাকরি এই রিভিউ পড়ার পরে নিশ্চয় দেখার আগ্রহ পাবেন।

কাহিনি সংক্ষেপ:

মুভিটির কাহিনী মূলত ফ্লাশব্যাক ফরম্যাটে এগিয়েছে। সিনেমার কাহিনি শুরু হয় প্রধান চরিত্র Paul Edgecomb-কে দিয়ে। এই ক্যারেক্টারে অভিনয় করেছেন লিজেন্ডারি অভিনেতা Tom Hanks. সিনেমায় Paul Edgecomb হলেন Former Prison Officer। উনি একজন Death Row এবং একইসাথে তিনি স্ট্যাট-এর ইলেক্ট্রিক চেয়ারের দায়িত্বে ছিলেন যার মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। তার প্রধান দায়িত্ব ছিল Cold Mountain Penitentiary (গ্রিন মাইল) এর সবকিছু তত্বাবধান করা এবং সেই সাথে তার অধীনে থাকা চারজন সিকিউরিটি অফিসারকে তদারকি করা।

সিনেমার শুরুতেই দেখতে পাবেন,

প্রধান চরিত্র Paul Edgecomb অর্থাৎ Tom Hanks  বৃদ্ধ বয়সে একটি বৃদ্ধাশ্রমে সবার সাথে বসে টিভি দেখছেন। হঠাৎ টিভিতে এমন কিছু দৃশ্য চলে আসলো যা দেখে তিনি কেঁদে ফেললেন। দৃশ্যগুলো তার অতীতকে মনে করিয়ে দেয়। ঠিক যেন নিজেকে সেই পুরনো দিনে আবিষ্কার করলেন। উদ্বিগ্ন পল এজকম্বকে ক্রন্দনরত অবস্থয় খেয়াল করলেন বন্ধু ইলি। এরপর বন্ধু ইলির অনুরোধে তিনি পুরনো স্মৃতিচারণ করতে শুরু করেন। গল্পের মূল ঘটনাপ্রবাহ এখান থেকেই শুরু হয়।

সালটা তখন ১৯৩০, মি. পল তখন জেলার হিসেবে একটি জেলের E-block এ দায়িত্বরত ছিলেন। অফিসারগণ এই জেলটিকে ‘দ্য গ্রিন মাইল’ নামে ডাকেন। এই জেলের নামেই মূলত সিনেমার নামকরণ- দ্য গ্রিন মাইল। সেই জেলে মূলত মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত কয়েদীদের মানসিক স্ট্রেস কন্ট্রোলের জন্য রাখা হত এবং কিছুদিন পরে চেয়ারে বসিয়ে ইলেক্ট্রিক শক দিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হত।

গ্রীন মাইল
সংগৃহীত

একদিন জেলের ই-ব্লকে John Coffey নামক একজন ব্যক্তিকে নিয়ে আসা হয় দুটো বাচ্চা মেয়েকে খুনের অভিযোগে। যিনি একজন দৈত্যাকার নিগ্রো মানুষ, যাকে দেখতে ভয়ংকর! কিন্তু, আদৌতে তিনি অত্যন্ত নিরীহ, ভদ্র এবং ভীত মানুষ। তিনি শিশুসুলভ এবং বাধ্যগত আচরণ করেন, অন্ধকারে ভীষণ ভয় পান, ঝড়ের রাতে আতঙ্কিত হয়ে বেসামাল হয়ে পড়েন। ‘ডোন্ট জাজ আ বুক বাই ইটস কাভার’ এই উদাহরণ যথাযথভাবে Jhon Coffey এর সাথে মিলে যায়। যাকে বাইরে থেকে দেখে ভেতরটা বোঝার উপায় নেই।

তবে, ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হচ্ছে প্রকৃতি একদিকে কমতি রাখলে অন্যকোনো দিক দিয়ে তা পূরণ করে দেয়। জনের ক্ষেত্রেও তাই; এই শিশুসুলভ,  ভীত, নিরিহ ব্যক্তির মধ্যে আছে এক বিশেষ অলৌকিক শক্তি। যেই শক্তির সাহায্যে তিনি ভালো হোক বা মন্দ; মানুষের মনের ভেতরটা চিনে নিতে পারেন। শুধু তাইই না, এই শক্তি দিয়ে একবার সে একটি মৃত ইঁদুরের প্রাণ পর্যন্ত ফিরিয়ে দিতে সক্ষম হোন! অদ্ভুত এই অলৌকিক শক্তি দিয়ে তিনি অন্যদের জীবনধারা পালটে দিতে থাকেন। তার কর্মকাণ্ডে Coffey যে প্রকৃতি প্রদত্ত স্পেশাল গিফট তা আর কারো বুঝতে বাকী থাকে না।

কিন্তু, জনের এই ক্ষমতাই তার সবচেয়ে কষ্টের কারণ। জন পৃথিবীকে নির্মম অবস্থান থেকে চিনেছে। তাই পৃথিবীটা জনের কাছে একটি নিষ্ঠুরতম স্থান । সে নিজেকে এই নরকের কেন্দ্রে বাস করে বলে মনে করে। সে এই কেন্দ্রে বসে আপামর মানুষের মনের কলুষতা, মলিনতাকে অনুভব করতে পারে। মানুষেরা যখন একে-অন্যকে কষ্ট দেয় তখন সে নিজের ভেতরে ব্যথা অনুভব করে। আর এটিই তার বিচলতার প্রধান কারণ।

সিনেমার স্ক্রিনপ্লে গতিময় হয় মি. পল এবং জনের মধ্যে সৌখিনতার মধ্য দিয়ে। কমান্ডিং অফিসার মি. পলের এক কঠিন অসুখ অলৌকিক ক্ষমতা দিয়ে সারিয়ে দেবার ফলে দুজনের মধ্যে গড়ে ওঠে বন্ধুত্বসুলভ সম্পর্ক। মি. পল বন্দী জন কফের সম্পর্কে ব্যক্তিগত ইনভেস্টিগেশনের মাধ্যমে জানতে পারেন যে আদৌতে জন কফি খুনি নন। এরপর, তিনি জন কফিকে বাঁচানোর চেষ্টা শুরু করেন। শেষে কী হয় জানার জন্য আপনাকে এই মাস্টারপিস সিনেমাটি দেখতে হবে।

সিনামায় উঠে এসেছে সমাজের অনাচার, অন্যায় কীভাবে অন্যের উপর চাপিয়ে দিয়ে আসল অপরাধী পার পেয়ে যায়। সাজাপ্রাপ্ত সব আসামীই অপরাধী হয় না, কেউকেউ নির্মমতার হাতুড়ির আঘাত বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে মৃত্যুর কাঠগড়ায়! সিনেমাটিতে গুরুত্বপূর্ণ মেসেজ দেওয়া হয়েছে- আমরা সবসময় যা দেখি তা সত্য নাও হতে পারে, কখনোবা সত্যিটা জানতে অন্তর্দৃষ্টির ব্যবহারও করতে হয়।

এই সিনেমাটি আপনাকে নির্মমতা উপলব্ধি করাবে, আপনাকে কাঁদাবে, আপনার মনের মধ্যে একাই বলে উঠবে- আহারে! আহারে! 

গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ:

সবার অসাধারণ ও অনবদ্য অভিনয়, নিখুঁত পরিচালনার শৈল্পিকতা, সাবলীল স্ক্রিনপ্লে, মানানসই কালারগ্রেডিং এবং বিজিএম;  সবমিলিয়ে একটি পারফেক্ট প্যাকেজ।

অভিনয়:

অভিনয় এই সিনেমার প্রাণ। সবার অভিনয় এতটা নিখুঁত ছিল যে দেখে বাস্তব দৃশ্যের চিত্রায়ণ বলে মনে হবে। মূল চরিত্রে Tom Hanks নিয়ে তো নতুন করে কিছু বলার নেই। সবাইই জানেন তিনি কী লেভেলের অভিনেতা।

তবে, সবার অভিনয় ছাপিয়ে একজনের কথা না বললেই নয়; সিনেমার নেগেটিভ চরিত্রে অভিনয় করা অ্যামেরিকান অভিনেতা Doug Hutchison. তিনি সিনেমার সিকিউরিটি অফিসার Percy Wetmore নামে নেগেটিভ চরিত্রে অভিনয় করেছেন। একজনের অভিনয় লেভেল কতটা উচ্চ হলে একটি চরিত্রকে কীভাবে এতোটা জঘন্য ভাবে উপস্থাপন করা যায় তা উনার অভিনয় না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না! মানুষকে কাঁদানো, হাসানো কঠিন বটে কিন্তু ঘৃণার উদ্রেক ঘটানো আরও কঠিন! এই কঠিন কাজটিই সাবলীলভাবে Doug Hutchison করে দেখিয়েছেন।

ওহ, হ্যাঁ! সিনেমার আরেকজন অভিনেতার কথা না বললে অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তিনি হলেন Mr. Jingel.

Stephen King
সংগৃহীত

তবে ইনি কোনো মানুষ নন, একটি ছোট্ট ইঁদুর! হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন; ছোট্র ইঁদুর!

গ্রিন মাইলেরই একজন প্রিজনার এডুয়ার্ড ডেল-এর পোষা ইঁদুর হচ্ছে এই মিস্টার জিঙ্গেল।

Percy Wetmore তার স্বভাবত শয়তানীতে একবার এই ইঁদুরটিকে পা চাপা দিয়ে মেরে ফেলেন। কিন্ত, জন কফি তার ক্ষমতা ব্যবহার করে ইঁদুরটিকে বাঁচিয়ে তোলেন। আর এই ঘটনার মধ্য দিয়ে মিস্টার জিঙ্গেলের ভেতরেও কিছু ক্ষমতা চলে আসে ফলে দীর্ঘায়ু লাভ করে। যদিও মি. জিঙ্গেল-এর চরিত্রে চিত্রপ্রদর্শনী শেষ করতে মোট ৩০ টি মতো ইঁদুর লেগেছে। এ থেকেই বোঝা যায় কতটা ডেডিকেশন নিয়ে সিনেমাটি তৈরি!

সিনেমা দর্শন:

সমকালীন সমাজ ও আইনি ব্যবস্থার দূর্বলতা, লুপহোল, বিচিত্র মানবমনের গতিপ্রকৃতি ফুটে উঠেছে সিনেমাজুড়ে। তবে, সব মিলিয়ে একটা যুক্তিকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে- আমাদের দৃশ্যমান চোখেরও সীমাবদ্ধতা আছে। খালি চোখে যা দেখা যায় তা সবসময় সত্য নাও হতে পারে। বরং চোখের আড়ালেও থেকে যায় অনেক কিছু। সৃষ্টির সেরা জীব হতে গেলে সেই সত্যও গুলোও অন্বেষণও জরুরি।

পরিশিষ্ট:

যদিও সিনেমায় অভিনয় করেছেন Tom Hanks, তবুও Stephen King গ্রীন মাইলে মাইকেল ক্লার্ক ডানকানের কাজকে তাঁর সর্বকালের প্রিয় হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন এবং দাবি করেছেন যে ডানকান সেই পারফরম্যান্সের মাধ্যমে বাকি সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে।

৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সিনেমাটি মুক্তি পায় ১৯৯৯ সালের ১০ই ডিসেম্বর। মুক্তির পর থেকেই ক্রিটিকস মহলে বেশ প্রশংসা পেতে থাকে সেইসাথে বক্স অফিসে উপার্জন করে নেয় প্রায় ২৯০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার!

পরবর্তীতে মুভিটি Best Supporting Actor, Best Picture, Best Sound, Best Adapted Screenplay. চারটি ক্যাটাগরিতে  Academy Awards বা Oscar এর জন্য মনোনয়ন পায়।

সিনেমাটিকে বিশেষায়িত করতে আর কিছু বলার দরকার হয় না। তাই, যদি গতানুগতিক জীবনে বিরক্তি এসে যায় তাহলে কোনো এক ছুটির দিনে দেখে নিতে পারেন আইএমডিবির সেরার লিস্টে ২৪ নম্বরে থাকা মাস্টারপিস এই সিনেমাটি।

সবশেষে একটি সংলাপ দিয়ে শেষ করি,

“Please, boss, don’t put that thing over my face. Please don’t put me in the dark, don’t make me go into the dark, I’m afraid of the dark.”

রিভিউ করেছেন drishty rubayet

অন্যান্য রিভিউ…

গল্পসল্প ফেসবুক পেজ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

spot_img

সম্পর্কিত নিবন্ধ

জুতা (ছোট গল্প)- আফিন্দী

জুতাবিদ্যুৎ’এর গলার তেজে ফাঁকা মেসরুম গমগম করে উঠলো, “ভাই, তুমি যাবে পাঁচ ভাইয়ে? খিদেয় আমার জান যায়! খালা...

মৃত্যু পরবর্তী জগতের অভিজ্ঞতা 

মৃত্যু পরবর্তী জগতের অভিজ্ঞতা  মৃত্যু পরবর্তী জীবনের অভিজ্ঞতা কেমন? মানুষ তার অনিশ্চিত জীবনে শুধু একটি বিষয়ের নিশ্চয়তা নিয়ে জন্মেছে।...

বুক রিভিউ- হুমায়ূন আহমেদের ‘মেঘ বলেছে যাব যাব’

বুক রিভিউ- হুমায়ূন আহমেদের 'মেঘ বলেছে যাব যাব' বুক রিভিউ- হুমায়ূন আহমেদের 'মেঘ বলেছে যাব যাব'।বইয়ের নাম:মেঘ বলেছে যাব...

ডা. স্যাটান: সিরিয়াল কিলার ডা. মার্সেল পেটিওটের ভয়ংকর গল্প!

তাকে আখ্যা দেয়া হয়েছিল ডা. স্যাটান বলে। তিনি একই সাথে একজন সৈনিক, ডাক্তার, মেয়র, ভয়ঙ্কর অপরাধী এবং সিরিয়াল...