দ্য সাইলেন্স ওয়েব সিরিজ রিভিউ
মুক্তি পেয়েছে ভিকি জাহেদ পরিচালিত প্রথম ওয়েব সিরিজ ‘দ্য সাইলেন্স’। সাইকো থ্রিলার জনরার এই সিরিজটির চিত্রনাট্য করেছেন লেখক নাজিম-উদ-দৌলা ও ভিকি জাহেদ। ছয়টি পর্বে সাজানো সিরিজটির প্রতি পর্বের দৈর্ঘ্য ২৯ থেকে সর্বোচ্চ ৪৪ মিনিট যা ঘন্টার হিসেবে প্রায় ৩ ঘন্টা। বেশ বড় লেন্থের সিরিজ হলেও দেখতে বোরিং লাগার সুযোগ নেই। প্লট গুলো স্টেপ বাই স্টেপ সাজানো হয়েছে দক্ষ ভাবে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত রহস্য ধরে রাখতে পেরেছে সিরিজটি যেটা ছিলো সব থেকে বড় প্লাস পয়েন্ট।
নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের আগ্রহ অধিক থাকে। শুরু সেই গন্ধম ফলের সময় থেকে। ‘দ্য সাইলেন্স’ গল্পটি তার একটি বাস্তব প্রতিফলন এই সময়ের প্রেক্ষাপটে। ছয় পর্বের ওয়েব সিরিজটি প্রায় তিনঘন্টা দৈর্ঘ্যের। প্রথম এপিসোড গল্প বিল্ডাপে সময় নিয়েছে। আর পরের এপিসোড গুলো সমান তালে এগিয়েছে সাথে সাসপেন্স, মিস্ট্রি এবং থ্রিল ছিল পরিমিত ভাবে।
মূল গল্প থেকে the twilight zone এর the silence অনেকটা পরিবর্তিত । চেখভের গল্প ছিল একজন ব্যাংকার এবং একজন আইনজীবীকে নিয়ে যেখানে ব্যাংকার তরুণ আইনজীবীর সঙ্গে ২ মিলিয়ন রুবলের বাজি ধরেন। ব্যাংকার বলেন তরুণ আইনজীবী যদি ১৫ বছর কারাগারে একাকী একটি কক্ষে থাকতে পারেন এবং কারও সাথে কথা বলা যাবে না তাহলে তিনি ১৫ বছর পরে ২ মিলিয়ন রুবল পেয়ে যাবেন।
আর the twilight zone এর the silence এ দেখানো হয়েছে একটি ক্লাবের সদস্য কর্নেল আর্চি টেলর ওই ক্লাবের আরেকজন বাচাল প্রকৃতির সদস্য জেমি টেনিসনের সঙ্গে বাজি ধরেন জেমি যদি একবছর কারও সঙ্গে কথা না বলে থাকতে পারেন, স্রেফ মৌনব্রত পালন করেন তাহলে একবছর পরে তাঁকে ৫ লাখ ডলার দেয়া হবে। এতগুলো টাকা পাবার লোভে জেমি রাজি হয়ে যান এবং তাঁকে সর্বক্ষণ চোখে চোখে রাখবার জন্য ক্লাবঘরের গেম রুমে কাচঘেরা একটি ঘরে তাঁর থাকার ব্যবস্থা করা হয়। জেমিকে কথা বলাবার জন্য বহু চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন কর্নেল আর্চি টেলর। এক বছর পরে জেমি বাজি জিতে গিয়ে টাকা দাবি করলে কর্নেল স্বীকার করেন তাঁর কাছে কোন টাকাই নেই। এক বছর পরেও যখন জেমি ইশারা- ইঙ্গিতে কথা বলছিলেন তখন এ ব্যাপারে তাঁকে জিগ্যেস করা হলে তিনি একটি কাগজে লিখে জানান, তিনি জানতেন টানা এক বছর তাঁর পক্ষে কথা না বলে থাকা সম্ভব নয় ।
নাজিম উদ দৌলা এবং ভিকি জাহেদ ভাই জুটি আবারও একসাথে কাজ করলেন। চিত্রনাট্যে দুজন মিলে নিজেদের নৈপূন্যতা ধরে রেখেছেন। দুজন একসাথে বরাবর ই ভালো কিছু নিয়ে আসেন এবারও আশাহত হইনি। বেশ কিছু সংলাপ ছিল মনে দাগ কাটার মতো। পাশাপাশি শিক্ষনীয় বেশ কিছু বিষয় তুলে ধরা হয় ছোট্ট ছোট্ট বার্তা দেওয়ার মাধ্যমে।
গল্পটি মূলত এক উচ্চাভিলাষী দম্পতির । অল্প সময়ে বহু অর্থের মালিক হতে চান তারা। এর সুযোগ চলেও আসে তাদের মাঝে। শুধু খেলতে হবে অন্য এক দম্পতির সাথে। আর খেলাটা ১০ কোটি টাকার! শুধু শর্ত একটাই এক বছর থাকতে হবে সাইলেন্স। শুরুতে শুনে সহজ গেইম মনে হলেও কতটা ভয়াবহ এই লড়াই তা দেখা যায় সিরিজের পরতে পরতে। জানতে হলে দেখতে পারেন সম্পূর্ণ ফ্রী তে Binge তে।
‘দ্য সাইলেন্স’ যেমন আবহের আদলে তৈরি হয়েছে সেখানে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কাজ টা দেখার পরে আসল কারিশ্মা বোঝা যাবে। এটার ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর অনেক সুন্দর।
টিভি নাটকের প্রিয়মুখ মেহজাবিন সেদিক থেকে একটু দেরিতেই কাজ শুরু করেন ওয়েব প্ল্যাটফর্মে।মেহজাবীন চৌধুরী আবারো যেনো প্রমাণ করলেন কেনো তিনি এই সময়ের সেরা অভিনেত্রী! পুরো সিরিজ জুড়ে যেভাবে নিজের শক্তিশালী অভিনয় প্রতিভার সাক্ষর তিনি রাখলেন তা অনবদ্য।
শ্যামল মাওলা তাকে যোগ্য সঙ্গ দিয়েছে। শ্যামল মাওলাকে অনেকেই ডাকেন ‘প্রিন্স অব ওটিটি’ নামে। ডাকার সঙ্গত কারণও আছে। বাংলাদেশে ওটিটি যখন থেকে রমরমিয়ে চলছে, তখন থেকেই স্ট্রিমিং সাইটগুলোতে সরব উপস্থিতি শ্যামল মাওলার। সদরঘাটের টাইগার থেকে শুরু করে ‘মানি হানি’ কিংবা ‘মহানগর’ই হোক, হোক ‘কন্ট্রাক্ট’ কিংবা ‘দ্য সাইলেন্স’- ভিন্ন ভিন্ন গল্পে নানামুখী অবতারে দারুণভাবে উপস্থিত থেকে শ্যামল মাওলা তাকে দেয়া উপাধি প্রমাণও করেছেন বারবার। স্বীয় অভিনয়ে। ওটিটিতে চঞ্চল-মোশাররফদের যুগ শুরুর আগে শ্যামল মাওলার যুগ শুরু হয়েছে, এই কথা যে কেউই স্বীকার করবেন।
নজর কেড়েছে সজল নূর। তার ভিলেন লুক টা দেখার মতো ছিলো সব মিলিয়ে অসাধারণ। সবকিছু ছাঁপিয়ে এই অরিজিনাল সিরিজে সজল এর অভিনয় চোখে পড়ার মতো। তার ডায়লগ ডেলিভারি, লুক সেট, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ,এক্সপেশন ছিলো খুব মেথড, খুব ক্লাসি। নিজেকে রোমান্টিক ইমেজ থেকে বের করে এনে অভিনেতা সজল নূর ডার্ক চরিত্রটি খুব সুচারুভাবে স্ক্রিনে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। তার নিয়মিত নেগেটিভ রোলে অভিনয় করা উচিত।
আজিজুল হাকিম ও বিজরী দম্পতি শুধু মুগ্ধ করেছেন অনেকটাই ।
আজিজুল হাকিম যেভাবে ওটিটি স্পেসে ব্যাক করলেন সেটা দেখে মনে হচ্ছে রাজা যেন তার রাজ্যপাটে আবার ফিরে এসেছেন। নিটোল প্রেমের নাটকগুলোতে দেখা আজিজুল হাকিমের সাথে রেডরাম, দ্য সাইলেন্সের আজিজুল হাকিমকে যেন মেলানো যায় না। ‘দ্য সাইলেন্স’ এর এই সিকুয়েন্সে স্লিপওয়াক করতে করতে জামান সাহেব একটানা ৩-৪ মিনিটের যে মনোলোগটা দিলেন সেটা অনেকদিন মনে রাখার মতো। তার প্রতিটি কথায় যেন গা শিউরে ওঠে, কাটা দিয়ে ওঠে হুট করে।
আলাদাভাবে বলতেই হয় বিজরী বরকতউল্লাহর কথা। অভিনয়ে নব্বই দশকের বিজরী বরকতউল্লাহ নিজের অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতার জানান দিয়েছেন নতুন করে।বয়সের সাথে মানানসই চরিত্র পেলে নিজেদের ভেঙ্গে সাবলীল উপস্থিতি দিয়ে মন্ত্রমুগ্ধ করতে পারেন তা আবারো দেখা গেলো এই সিরিজে। অভিনয়, বডি ল্যাংগুয়েজ এবং চোখের অভিব্যক্তি দিয়ে তিনি যতোটা সময় স্ক্রিনে ছিলেন আলো ছড়িয়েছেন অবিরাম। তার এভারগ্রীন সৌন্দর্য্য এমন একটি রহস্যময় এবং চ্যালেঞ্জিং চরিত্রে আলাদা মাত্রা যোগ করেছে।
অন্যান্য চরিত্রে যারা ছিলেন তারাও ভালো পারফর্ম করেছেন।
‘বিদ্রোহী দীপন’, যিনি এই ওয়েব সিরিজের সিনেমাটোগ্রাফি করেছেন। চিত্রগ্রাহক হিসেবে উনার আলাদা সুনাম রয়েছে, বিশেষ করে ভিকি জাহেদের সঙ্গে জুটিটা বেশ সমাদৃত। ভিকির একেবারে শুরুর দিকের শর্টফিল্ম,নাটক থেকেই দীপনের সাথে কাজ শুরু। তবে চরের মাস্টার ও চিরকাল আজের নান্দনিক ক্যামেরার কাজ দীপন কে আলাদা পরিচিতি কবরিয়ে দেয়,যেটা গত বছর ‘রেডরাম’তেও দেখা গিয়েছিল। ভিকির সাথের কাজ বাদেও বেস্ট ফ্রেন্ড ৩, সাদা প্রাইভেট’ আলোচিত প্রশংসিত প্রশংসিত হয়েছিল।
দ্য সাইলেন্স নিয়ে বিদ্রোহী দীপন আবার আলোচনায়,গল্পের সুবাদে কিছু লোহমর্ষক সিকুয়েন্স আছে যেটা যেকোনো দর্শককেই চমকে দিবে। ক্যামেরার আলো আঁধারের কাজ সহ বিভিন্ন সুন্দরতম কাজ ধরা পড়েছে ক্যামেরায়। যেটা চোখের শান্তি এনে দিয়েছে।
‘দ্য সাইলেন্স’ ওয়েব সিরিজের সবচেয়ে স্ট্রং পার্ট ছিল সিরিজের স্ক্রিপ্ট!
কিছু নজর আকৃষ্টকারী সংলাপ
-আমাদের আরও সতর্ক থাকতে হবে। ওরা এখন পাগল হয়ে যাবে বাজিতে জেতার জন্য। চোখ কান খোলা রাখবা সবসময়। যেকোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
-আর তো পারছি না!
-আর একটু ধৈর্য্য ধরো!
-শেষ পর্যায়ে চলে আসছি!
-শেষ সময়টা কিন্তু আরো বেশি ভয়ঙ্কর হবে!
-আর অল্প কিছুদিন!
-আমাদের সেকেন্ড কোন অপশন নাই। এই খেলায় আমাদের জিততেই হবে!
-ধোঁকা ইবলিশের কাজ!
আর মানুষের কাজ হচ্ছে,
ধোঁকা খাওয়া, ধোঁকা দেয়া নয়!
ওয়েব সিরিজটিতে ভালোবাসা, ঘৃণা, ভয়, দুঃসাহস সবকিছুই দেখা যায়। প্যারা সাইকোলজিক্যাল ওয়েব সিরিজটির প্লট ছিল একদমই ব্যতিক্রম। এইরকম কাজ আরও হোক। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আছে এই সিরিজে। কয়েকটা জায়গা ছিল বেশ অবাক করার মতো। বিশেষ করে সিরিজ যত শেষদিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো, জটিলতা তত বেড়েই চলছিলো। একটা সময় এমন মনে হচ্ছিলো সমাধান আদৌ হবে কি! এই সুক্ষ্ম জিনিস গুলোকে স্ক্রিনে ইন্টারেস্টিং করে তুলে ধরার জন্য পরিচালককে বাহবা দিতেই হবে। ওয়েব সিরিজটা মাস্ট ওয়াচ কনটেন্ট।
রিভিউ করেছেন- মোহাম্মদ রুদ্র