ছোটগল্প: নিয়তি
রিফাত রায়হান
ভজা মিয়া কুজো হয়ে বসে আছে। সাধারণত লম্বা মানুষেরা কুজো হয়। কিন্তু ভজা মিয়াকে আর যা হোক লম্বা বলা যাবে না। টেনেটুনে পাঁচ ফুট ২-৩ হবে। তার হাত পিছমোড়া করে বাঁধা। সে খুব মনোযোগ দিয়ে তার পায়ের কাছে একটা পিঁপড়ের সারি লক্ষ্য করছে। পিঁপড়েগুলো কোত্থেকে যেন একটা মড়া ঘাসফড়িংয়ের পাখা টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
বুটের ঠক ঠক আওয়াজ করে রুমে ঢুকলো র্যাব ১৪ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মুহিত মাহমুদ। ভজা মিয়া মাথা না তুলেই বললো, ” বাইচ্চা থাকতে না জানি ইলা কতলা পিরফা হাইছে! অহন ইলার ঠ্যাং লইয়া পিরফা টানাটানি করে। বুঝলেন স্যার ইডা অই নিয়তি!”
একটা চেয়ার টেনে ভজা মিয়ার মুখোমুখি বসলো লে. কর্নেল মুহিত। চোয়াল শক্ত করে জিজ্ঞেস করলো,
“খুনটা কেন করেছো?”
মাথা তুললো ভজা মিয়া। ছোটখাটো মুখ, থুতনিতে কাঁচাপাকা খোচা খোচা দাড়ি, চোখের চাহনিতে সরলতা মিশে আছে। পান খাওয়া দাঁত বের করে বললো, “ট্যাহা পাইছি স্যার!”
“কত টাকা?”, কঠিন সুরে জিজ্ঞেস করলো অধিনায়ক।
“তিরিশ হাজার দেওয়ার কথা আছিলো। দশ হাজার পাইছি। বাকি বিশ হাজার পাওয়ার আগেই আফনেরা পকাৎ কইরা দিলেন!”, হাসছে সে।
“কে টাকা দিয়েছে তোমাকে?”, নরম হলো না অধিনায়ক।
“সেকথা আফনেও ভালো জানেন স্যার। জিগানের দরকার কি?”, আবারো হাসলো খানিকটা।
অবাক হলো অধিনায়ক।
“এহন আমারে নিয়া কি করবেন স্যার? উপ্রেত্তে কি অডার আইছে? আমারে তো কোর্টে তোলা যাইবো না বসদের কথা সব কইয়া ফালামু। ছাইড়া দিলেও সমিস্যাতে পরবেন আফনেরা!”
অধিনায়ক লক্ষ্য করলো কিছুটা উপহাসের ভঙিতে কথাটা বললো ভজা মিয়া। সজোরে তার গালে একটা চড় বসালো সে। উঠে চলে যাচ্ছে রুম থেকে। আসলেই তার ভাবতে হবে এখন কি করা যায় একে নিয়ে।
“পারলে একটা মশার কয়েল দিয়েন স্যার। এনে বুইত্তা মারা সব মশা। হাতও থুইছেন বাইন্ধা। রক্ত চুইশ্যা লাল অইয়া বইয়া থাহে মারতে পারি না। বড়ই পেরেশানি অয়!” স্বাভাবিক গলায় বললো ভজা মিয়া। চড় খেয়ে তার কিছু আসে যায় নি বুঝা গেছে।
অধিনায়ক পেছনে ফিরে তাকালো। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ভজা মিয়া। ভয় বা অপরাধবোধ নয় নির্লিপ্ত চাহনি তার। কেমন যেন অস্বস্তি হয় তাকাতে।
বের হয়ে এলো অধিনায়ক। বসেছে তার চেয়ারে। এপ্রিলের ভ্যাপসা গরমে সে হালকা ঘামছে। ভালো ঝামেলায় পরা গেলো। একে ছেড়ে দেওয়া যাবে না। এখনও মিডিয়া জানে না ওর গ্রেপ্তারের ব্যাপারটা। তবে তাকে ছেড়ে দিলে দেশের সবচেয়ে আলোচিত, মোস্ট ওয়ান্টেড তকমা পাওয়া খুনির আটক আবার ছাড়া পাওয়ার ঘটনা যে মিডিয়া খুঁজে বার করবে না তা হতে পারে না। মিডিয়া সব সময়ই মুখিয়ে থাকে আর্মি,পুলিশ, র্যাবের কার্যক্রমের ব্যবচ্ছেদ করতে।
আবার একে কোর্টেও তোলা যাবে না। উপর থেকে কড়া নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এ ব্যাপারে। স্থানীয় এমপির খুনের সাথে যোগসাজশ বেরিয়ে পরবে তাহলে।
সে ভেবেছিলো এমন একজন ওয়ান্টেড ক্রিমিনালকে ধরতে পারলে তার খ্যাতি বাড়বে, প্রমোশন পেয়ে যাবে। কিন্তু ধরার পর মনে হচ্ছে যেন মাছের কাঁটা গলায় বিধেছে । না পারছে গিলতে না পারছে উগড়ে দিতে।
ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি গলায় ঢাললো সে। ডিসিশন নেওয়া হয়ে গেছে।
ভজা মিয়ার ঘরে একটা মশার কয়েল জ্বালানো হয়েছে। তবে এই কয়েল মশারা কোন ভ্রুক্ষেপ করছে বলে মনে হচ্ছে না। সে তো কয়েলের উপরও একটা মশা বসে থাকতে দেখলো।
দুপুরের দিকে গ্রেপ্তার হয়েছিলো ভজা মিয়া। এখন রাত প্রায় বারোটা। এতক্ষণে কিচ্ছু খেতে দেয় নি ওরা। খিদে পেয়েছে তার। ভাবছে এর পর রুমে কেউ এলে খাবারের ব্যাপারে কিছু বলবে। খুনী বলে যে খিদে থাকবে না তা তো না!
কিছুক্ষণ পরই দুজন সৈনিক এলো। হাতের বাঁধন খুলে হ্যান্ডকাফ পরানো হলো। রাগী রাগী চেহারা দেখে খাবারের কথা বলতে পারলো না তাদের। অধিনায়কের রুমে এনে দাড় করানো হলো ভজা মিয়াকে। আয়নার দিকে তাকিয়ে ব্যারেট ঠিক করলেন অধিনায়ক।
“স্যার খিদা লাগছে । কিছু খাওন দেওয়া যাইবো? সক্কালতে পেট্টা ভুখা!” আকুতির স্বরে বললো ভজা মিয়া!
কিছুটা বিরক্ত হলো অধিনায়ক, ” জানো কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তোমায়?”
“জি স্যার চরে নিয়া যাইবেন আর তারপরেই ফুট্টুস!”
অবাক হলো অধিনায়ক। নিজের মৃত্যুর কথা এতো নির্লিপ্তভাবে বলা যায় জানতো না। আর ইনকাউন্টারের কথাটাও ভজা মিয়ার জানার কথা না। মাত্রই প্ল্যানটা সাজিয়েছে সে।
চুপ রইলো অধিনায়ক। ভজা মিয়ার চোখের দিকে সরাসরি তাকাতে পারছে না । একজন সৈনিককে চোখের ইশারায় কিছু খাবার আনতে বললো সে।
গাড়িতে বসে আছে ভজা মিয়া। তার হাতে একটা নাটি বিস্কুটের প্যাকেট। হ্যান্ডকাফ থাকায় বিস্কুট মুখে দেওয়ার সময় একসাথে দুইহাত তুলতে হচ্ছে তার। কাভার্ড ভ্যানের মতো একটা ভ্যানে বসে আছে তারা। গাড়ির ইঞ্জিনে কি সমস্যা, তা সারানোর জন্যই দেরি হচ্ছে। সামনে ড্রাইভারের পাশে বসেছে অধিনায়ক। লুকিং গ্লাসে তার চিন্তিত মুখটা দেখা যাচ্ছে।
“স্যার কি পেরেশানিতে আছেন? টেনশন নিয়েন না সব ঠিক হইয়া যাইবো গা সময় হইলে। When going gets tough then tough gets going!” স্বাভাবিকভাবে বললো ভজা মিয়া।
এবার দারুন বিস্মিত হলো অধিনায়ক। চকিতে পেছনে ফিরলো। “একথা কোত্থেকে শিখেছো? ” কন্ঠে বিস্ময় ভাব স্পষ্ট।
‘ক্যান স্যার ইংলিশ শুইনা কি ডরাইছেন? ‘ সবগুলো দাঁত বের করে হাসলো সে। ‘ আমেরিকান প্রেসিডেন্টের বাপের কথা স্যার এইডা!’
একটা পেশাদার খুনীর পক্ষে ইংরেজি উক্তি জানাটা কেমন যেন ঠেকল অধিনায়কের কাছে। আবার জিজ্ঞেস করলো “কোথায় শোনেছ? ”
“ইংলিশ লিটারেচারে অনার্স স্যার। মাস্টার্স করতে পারি নাই।” দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো ভজা মিয়া। চোখগুলো যেন দূরে তার অতীত হাঁতরে ফিরছে।
বিস্ময়ে চোয়াল ঝুলে পড়েছে অধিনায়কের। এই পেশাদার খুনীটার প্রতি আগ্রহ বোধ করছে সে। ” ইংলিশে অনার্স করে এমন কাজে ঢুকলে কিভাবে? ” আগ্রহ চেপে রাখার কোন চেষ্টাই করছে না।
“ম্যালা কাহিনী স্যার!” মুখ বিকৃত করলো সে। অতীত যে সুখকর নয় তা অনুমিতই। “গাড়ি ঠিক হইছেনি দেখেন। সময় তো বেশি নাই। ”
বাইরে তাকিয়ে দেখে নিলো অধিনায়ক। গাড়ি ঠিক হবার কোন লক্ষণ নেই। দুজন লোক বনেট খুলে প্রাণপনে চেষ্টা চালাচ্ছে। একজন সৈনিককে ডাকলো অধিনায়ক। ভজা মিয়াকে গাড়ি থেকে নামাতে বলে নিজে দড়জা খুলে বাইরে এসে দাড়ালো। কিছুক্ষণের মধ্যে ভজা মিয়াও হাজির হলো বাইরে। দুহাত অবশ্য পেছন থেকে আটকানো। অধিনায়কের চোখের ইশারা পেয়ে হ্যান্ডকাফ খুলে দিলো একজন । তবে সতর্ক অবস্থায় দাঁড়িয়ে রইলো কিছুটা দূরে।
হাত রগড়িয়ে অধিনায়কের মুখের দিকে তাকালো। বুঝতে পারছে গাড়ি সারানোর সময়ে তার অতীত সম্পর্কে জানতে চান তিনি। নিজেই বলতে শুরু করলো, ” নাম ছিলো আমার বজলুর রশীদ। কলেজ থেইকা মাত্র বার হইছি। কিছুটা অভাবের সংসার। টিউশনি কইরাই পড়াশোনা চালাইতাম। একটা ভার্সিটিতে ইংরেজিতে ভর্তি হইলাম। মোটামুটি রেজাল্ট নিয়া বার হইলাম অনার্স শেষে। ইচ্ছা ছিলো মাস্টার্স শেষে বিসিএস দিয়া পুলিশে যামু। মাস্টার্সে ভর্তি হবার কদিন আগে একটা টিউশনি শেষে রিকশা কইরা মেসে ফিরতেছিলাম। রাইত হইয়া গেছিলো কিছুটা। রাস্তার মধ্যে পুলিশ রিকশা থামাইলো। নাম ঠিকানা জিগাইলো, আমার পকেট টকেট চেক করলো। হের পর কথা নাই বার্তা নাই আমারে থাপরানো শুরু করলো। টান দিয়া রিকশা থেইকা মাটিত ফালায় দিলো। আর কইতেছিলো আমি নাকি পকেটে মাদক নিয়া ঘুরি। আমি নাকি মাদক পাচারকারি। “, চোখ ছলছল হয়ে উঠলো ভজা মিয়ার। একটু বিরতি নিলো সে। অধিনায়ক তাকিয়ে আছে উৎসুক দৃষ্টিতে।
আবার শুরু করলো, ” বিশ্বাস করেন স্যার, আমি কিছুই জানতাম না। আমার পকেটে কয়ডা টাকা আর একটা কলম ছাড়া আর কিচ্ছু ছিলোও না। আমারে রাতেই নিয়া গেলো থানায়। হাজতে ঢুকায়া রাখলো। পরদিন আমারে চালান কইরা দিলো কোর্টে। অভাবের সংসার, বাড়িত বুড়া মা ছাড়া কেউ নাই। আমারে এ অবস্থা থেইকা বার করারও কেউ নাই। মা খবরটা পর্যন্ত পায় নাই স্যার, আমার ৪ বছরের জেল হইয়া গেলো “, তার দৃষ্টি অনেক দূরে যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে তার অতীত। কিছুটা ঝাপসা তবে ক্ষত হিসেবে এখনো দগদগে।
একজন সেন্ট্রি অধিনায়ককে সেলাম ঢুকলো। গাড়ি ঠিক হয়ে গেছে। অধিনায়কের নির্দেশ পেয়ে ভজা মিয়াকে গাড়িতে তোলা হলো। তার সাথে দুজন সেন্ট্রি বসলো ভ্যানের পিছনে। ড্রাইভারের পাশে বসলো অধিনায়ক। এখান থেকে গন্তব্য আধ ঘন্টার পথ। গাড়ি চলা শুরু করলো। ভজা মিয়াকে কাহিনী চালিয়ে যেতে বললেন তিনি। লুকিং গ্লাস ঘুড়িয়ে দিলেন যেন স্পষ্ট দেখা যায় ভজা মিয়ার মুখটা। গল্প শোনার সময় বক্তার মুখ দেখা না গেলে গল্পের ষোল আনাই মাটি।
কিছুটা আক্ষেপের সুরে শুরু করলো ভজা মিয়া,” বুঝলেন স্যার, সবই নিয়তি। পুলিশ হওয়ার কথা ছিলো হইলাম চোর। পরে শুনলাম মাদক অভিজানের ক্রেডিট নেওয়ার জন্যই নাকি আমারে ধরা হইছিলো। চাইরটা বছরে জীবনের সব উলট পালট হইয়া গেলো। জেলে পরিচয় হইলো শামসু নামের একজনের সাথে। পেশাদার খুনী। জেলের অন্যান্য আসামীদের জ্বালাতন, অত্যাচার থেইকা আমারে বাঁচাইত। একদম বড় ভাইয়ের মতো হইয়া গেছিলো। আমারে ডাকতো ভজা নামে। আর কইতো বার হইয়া তার লগে থাকতে , তার লগেই কাম করতে। আমি তখন কিছু কইতাম না , তার লগে খুন খারাবিতে যোগ দেওয়ার কোন ইচ্ছাই ছিলো না। চাইরটা বছর কোমরকমে কাটাইলাম “, তার চোখে মুখে হাফ ছেড়ে বাঁচার অভিব্যাক্তি।
গাড়ি চলেছে সামনে। শহরতলী ছাড়িয়ে সদ্য পিচ ঢালা নতুন রাস্তায় উঠেছে গাড়ি। কিছুক্ষণ পরেই দুপাশে নদী শুরু হবে। বর্ষাকালে একদম সাগর মনে হয়, দুই ধারে নদী আর মাঝে রাস্তা। এখন বর্ষার মতো পানি না থাকলেও পানি আছে ভালোই। সবচেয়ে বড় যে কথা, জায়গাটা শুনশান। রাস্তার পাশে গাছের সারি কিছুটা ভুতুরে পরিবেশও সৃষ্টি করেছে। ক্রসফায়ারের জন্য উপযুক্ত স্থান।
গাড়ি চলছে। ভজা মিয়া আবার শুরু করলো,” বার হইয়াই বাড়িত গেলাম স্যার। মা মরার খবর পাইছিলাম জেলে থাকতে। গিয়া দেখি আমার ভিটামাটি অন্যরা দখল কইরা বাড়ি তুইলা বইছে। আমি গিয়া জিগাইতেই আমারে লাঠি লইয়া তেইড়া আইলো। গ্রামের লোকেরাও জেলখাটা আসামী হিসাবে আমার লগে দাঁড়ায় নাই। বরং সবার একটাই কথা , জেলখাটা আসামীরে গ্রামে যায়গা দিওন যাইবো না। গ্রাম ছাড়লাম স্যার। যেই বন্ধুবান্ধব ছিলো , তাড়াও এতদিন পর দেখে আজবভাবে তাকাইতেছিলো। একটা জেলখানার আসামীরে বন্ধু হিসাবে স্বীকার করতে তাদের গায়ে লাগলো। ভার্সিটিতেও মাস্টার্সে আর ভর্তি হইতে পারি নাই স্যার। দুনিয়ার সবাই জাইনা গেলো আমি জেলখাটা আসামী। কিন্তু কেউ জানলো না, আমার লগে কি হইছে। কোথাও কোন চাকরীটাও পাই নাই। ২-৩ মাস কাটলো এখানে ওইখানে লাত্থি গুতা খাইয়া। একদিন শুনলাম শামসু ভাই ছাড়া পাইছে। তার এলাকার ঠিকানা ছিলো আমার কাছে। তার কাছেই গেলাম। সবাই ফিরায় দিলেও তিনি আমারে ফিরায় দিলেন না। দুনিয়ার সব মাইনষ্যের উপ্রে বিতিষ্ণা আইয়া পরছিলো।
একদিন শামসু ভাই আমারে একটা কাম দিলেন। মানুষ মারার কাম। হাতে পিস্তল দিলেন। এক বড়লোকের ছাওয়ালরে মারতে হইব। বিশ্বাস করেন স্যার আমি চোখ খুইলা গুলি করতে পারি নাই। ২ ফুট দূরেত্তে মারতেও ৩ টা গুলি করতে হইছে। এরপর থেইকা শামছু ভাইয়ের লগেই আছি। উনি নিজ হাতে আমারে কাম শিখাইলেন। কবছর আগে কে জানি উনারেই মাইরা দিলো। এরপর থেইকা এই এরিয়ার সব কাম আমিই করতে লাগলাম। আমার হাত এখন আর একটুও কাপে না। শেষ কামডা করার পরেই ধরা পরলাম। জীবনে র দ্বিতীয়বারের মতো। কিন্তু দুইটা ধরা পড়ায় কত্ত তফাত! দুইটা আলাদা মানুষ ধরা পরলো স্যার। এবার আর খারাপ লাগে নাই। মরনরে ডর নাই স্যার আর। ” থামলো ভজা মিয়া। তার কাহিনী শেষ হয়েছে।মাথা নিচু করে আছে সে।
অধিনায়ক একমনে শুনে যাচ্ছিলেন তার কথা, কিছুটা কৌতূহল আর অনেকটা বিস্ময় নিয়ে। গাড়ি গাছ আর নদীতে ঘেরা রাস্তায় ঢুকে পরেছে। গন্তব্য কয়েক মিনিট দূরত্বে। মাথায় ব্যারেট পড়ে নিলেন অধিনায়ক। হাতের পিস্তলটা পরীক্ষা করলো এক সেন্ট্রি। চোখ মুদলো ভজা মিয়া। কিছুটা আক্ষেপের সুরেই বললো সে, “সবই নিয়তি স্যার। সবই নিয়তি। হায়াত মউত, রিযিক সব উপরওলার হাতে। কার যে কি অয়, কেউ জানে না। হিউম্যান লাইফ ইজ দ্যা গ্রেটেস্ট মিস্ট্রি।”
সবাই চুপ। বাতাসের শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। নিকষ অন্ধকারের ফাঁকে ফাঁকে চাঁদের আলো জাল তৈরি করেছে গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে এসে।বাইরে তাকিয়ে আছে অধিনায়ক। চোখ বন্ধ করে মাথা নিচু করে আছে ভজা মিয়া।
চারপাশে কোথাও কোন প্রাণের চিহ্ন নেই৷ চাঁদের আলোয় এক মায়াময় পরিস্থিতির জন্ম হয়েছে৷ হঠাতই রাস্তার পাশে একটা বটগাছকে পাশ কাটানোর সময় কোত্থেকে যেন একটা শিয়াল দৌড়ে বের হলো গাছের ছায়া থেকে৷ শিয়ালটা কিছু বুঝে উঠার আগেই গাড়ির সাথে ধাক্কা লেগে ছিটকে পরলো কয়েক হাত দূরে৷ এদিকে আচমকা শেয়ালটাকে পাশ কাটাতে গিয়ে স্টিয়ারিংয়ের কন্ট্রোল হারালো ড্রাইভার৷ গাড়িটা কেমন যেন শূন্যে লাফিয়ে উঠলো। সজোরে ধাক্কা খেলো গাছটির সাথে। ভেতরের সব কিছু ছিটকে গেলো যেখানে যা সম্ভব। ভজা মিয়ার হ্যান্ডকাফ খুলে ছিটকে গাড়ির বাইরে রাস্তার ঢালে এসে পড়লো। বা পায়ে দারুন চোট লেগেছে। মাথা ফেটে গেছে , শরীর ছড়ে গেছে বেশ ক জায়গায়। সে গাড়ির দিক তাকালো। ড্রাইভারের পাশের সিট থেকে অর্ধেক বেড়িয়ে আছে অধিনায়কের শরীর। ব্যারেটটা নিচে পরে আছে, বিক্ষত আর রক্তাক্ত । ড্রাইভার গাড়ির ভেতরে সেঁধিয়ে গেছে। পেছনে বসা সেন্ট্রি দুজন হয়তো গাড়িতেই আটকে গেছে।
খোঁড়া পায়ে গাড়ির দিকে এগুলো ভজা মিয়া। সাবধানে পরীক্ষা করলো অধিনায়কের রক্তাক্ত শরীর। প্রাণস্পন্দন পেলো না। সেন্ট্রিদুজনকে খুঁজার মতো অবস্তায় নেই গাড়িটা। বুঝা গেলো গাড়ির ভেতরে থাকা কোন প্রাণীই আর জীবিত নেই। মুচকি হাসলো ভজা মিয়া। অস্ফুট সুরে উচ্চারণ করলো, ‘সবই নিয়তি’! সে খোঁড়াতে খোঁড়াতে হেঁটে যেতে লাগলো। ভরা জোছনায় তার শরীরের ছায়া ঢেকে দিচ্ছিল রক্তাক্ত পথটাকে। দুপাশে নদী, তার মাঝখান দিয়ে রাস্তা ধরে রক্তাক্ত অবস্থায় হেঁটে যাচ্ছে এক ভাগ্যবান কিংবা হতভাগা খুনি। প্রতি কদমে তার হাঁত থেকে ঝুলতে থাকা ভাঙা হ্যান্ডকাফটা ধাতব শব্দ করছে যা আড়াল হয়ে যাচ্ছে বাতাসের শব্দে। যেমন ভাবে তথাকথিত সভ্যতার পেছনে আড়াল হয়ে যায় লাখো ভজা মিয়ার গল্প।
হেঁটে যাচ্ছে ভজা মিয়া। আপন মনেই সে বলে উঠলো ‘ এ মাইলস টু গো বিফোর আই স্লিপ, এ মাইলস টু গো বিফোর আই স্লিপ!’