ভ্যান গঘের সেই কাটা কানটি আসলে কাকে দিয়েছিলেন?
কিংবদন্তি ডাচ চিত্রশিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ নিজের কান নিজেই কেটে ফেলেছিলেন, এ কথা চিত্রশিল্প বা সাহিত্যের যারা খোঁজ খবর রাখেন সবাই জানেন। প্রচলিত আছে যে, তিনি সেই কেটে ফেলা কান তুলে দিয়েছিলেন বান্ধবীর হাতে, উপহার হিসেবে। কেউ কেউ বলে থাকেন, কানটি তিনি দিয়েছিলেন ফ্রান্সের এক পতিতালয়ের যৌনকর্মীকে। এমন ধারণা জোর পেয়েছে ভ্যান গঘের আত্মজীবনীকারদের কারণে।
আবার এ নিয়েও বিতর্ক আছে, আসলে কী সত্যি সতি ভ্যান গঘ তার পুরো কান কেটেছিলেন নাকি শুধু কানের লতি কেটেছিলেন?
তবে এসব বিতর্কে পানি ঢেলে দিয়েছেন চিত্রকলার ইতিহাসবিদ ও আয়ারল্যান্ডের বাসিন্দা বার্ণাডেট মারফি। ছয় বছরের দীর্ঘ গবেষণা শেষে ২০১৬ সালে মারফি এ নিয়ে একটি বই লেখেন, নাম ভ্যানগঘের কান ( ভ্যান গঘ’স ইয়ার)। সেই বইয়ে তিনি লেখেন, ভ্যান গঘ আসলে ফ্রান্সের কোনো যৌনকর্মীকে সেই কাটা কান তুলে দেননি। যাকে দিয়েছিলেন তিনি পতিতালয়ের একজন পরিচ্ছনতাকর্মী। আর তিনি শুধু লতি কাটেননি, কেটেছেন পুরো কানই।
১৮৮৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর রাতে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ভ্যান গঘ নিজের কান কেটে ফেলেন। তিনি তখন থাকতেন ফ্রান্সের অদূরে আর্ল নামের এক শহরে।
সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বার্ণাডেট মারফি বলেন, ইতিহাসবিদরা বলে থাকেন , ভ্যান গঘ তার কানের লতিটাই কেটেছিলেন। এ ব্যাপারে বিখ্যাত ফরাসি চিত্রশিল্পী পল সিগনেকের বক্তব্য প্রায় সব ঐতিহাসিকই সন্দেহাতীতভাবে মেনে নিয়েছিলেন।
তিনি যখন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি, তাকে দেখতে সেখানে গিয়েছিলেন পল সিগনেক। তিনি তার এক চিঠিতে লিখেছিলেন, ভ্যান গঘ তার কানের লতি কেটে ফেলেছেন, পুরো কান কাটেননি।
পরবর্তীতে ভ্যান গঘ যখন নিজেই নিজের প্রতিকৃতি আঁকতেন, সেইসব ছবিতে তিনি তার কান দেখাতেন না, কাপড়ের আবরণে ঢেকে রাখতেন।
ভ্যানগঘ অন্যদের কাছে লেখা তার চিঠিতে, হাসপাতালে কয়েক সপ্তাহ কাটিয়ে জ্বর ও সংক্রমণ থেকে কিভাবে সেরে উঠেছিলেন, সে প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছিলেন।
তবে আমস্টারডামের ভ্যান গঘ জাদুঘরে মারফি একটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র পান ১৯৫৫ সালে লেখা একটি চিঠির মাধ্যমে। ওই চিঠিতে ভ্যানগঘের কানের যে আসল ক্ষতটি ছিল , তার একটি ছবি থাকার কথার নির্দেশনা ছিল। ছবিটি আঁকেন ভ্যান গঘকে যিনি চিকিৎসাসেবা দিয়ে সুস্থ করেছিলেন সেই চিকিৎসক ফেলিকস রে।
চিঠিতে আরো লেখা হয়, এখন ওই ছবিটি আছে ভ্যানগঘের জীবনীকার আরভিন স্টোনের কাছে। এই আরভিন স্টোন লিখেছিলেন ভ্যানগঘের জীবনীগ্রন্থ ‘লাস্ট পর লাইফ’। এরপর শুরু হয়, মারফির সেই ছবিটি খোঁজার জন্য তোড়জোড়। ব্যানক্রফট লাইব্রেরিতে স্টোনের ব্যক্তিগত জিনিসপত্রের মধ্যে পুরাতন ও অদরকারী কাগজপত্রের মধ্যে অবশেষে মেলে বহু প্রতীক্ষিত সেই ছবিটি।
ডাক্তারের আঁকা চিত্রে পুরো কানটি কেটে নেওয়ার অবস্থা ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল। ভ্যান গঘ তারা পুরো কানটি কেটে ফেলেছিলেন। তার শরীরের সঙ্গে ঝুলে ছিল কানের লতির অংশবিশেষ।
ওই মুহূর্তের কথা স্মরণ করে মারফি বলেন, আমি যখন ওই ড্রয়িংটি প্রথমবারের মতো দেখি, আমি কান্নায় ভেঙে পড়ি। হঠাৎ করে আমার মাথায় এলো, ও ঈশ্বর! সে তাহলে সত্যিই এই কাজটি করেছিল।
এছাড়া সিগনেকের চিঠিটি ভালো করে খুঁটিয়ে দেখে মারফি তার আরো একটি প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যান, তা ছিল এক লাইনের একটি বাক্য, যা অনেকদিন কেউ খেয়াল করেনি। সেখানে সিগনেক লেখেন, আমি যখন হাসপাতালে যাই, ভিনসেন্ট অন্য সময়ের মতো স্বাভাবিক পোশাক পরেছিলেন। মুখ ও মাথা ফিতার মতো কাপড় দিয়ে ঢাকা ছিল এবং মাথায় ছিল ফারের টুপি। আসলে সিগনেকের তার বন্ধুর ক্ষত দেখার সুযোগই হয়নি।
যৌনকর্মী র্যাচেল নন, কানটি দিয়েছিলেন পরিচ্ছন্নতাকর্মী গ্যাভিকে
আবার অনেকদিন ধরে অনেকেই মনে করত, রক্তেভেজা কানটি ভ্যানগঘ তুলে দিয়েছিলেন র্যাচেল নামের এক যৌনকর্মীকে। ভ্যানগঘ যখন আর্লে থাকতেন নিয়মিত যেতেন ওই পতিতালয়ে। স্থানীয় একটি পত্রিকার রিপোর্টের সূত্র ধরে বলা হতো, পতিতালয়ের বাইরে ওই নারীকে সেই কাটা কান হাতে তুলে দিয়ে ভ্যানগঘ বলেছিলেন, তা যত্ন করে রেখে দেওয়ার জন্য। কিন্তু সেই কান হাতে তুলে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন র্যাচেল। কিন্তু মারফি তার বইয়ে লেখেন, ভ্যানগঘ যার হাতে সেই কানটি দিয়েছিলেন তিনি ছিলেন একজন পরিচ্ছনতাকর্মী। তার নাম গ্যাভি। মারফি ওই সময়কার আদমশুমারির রেকর্ডপত্র ঘেটে দেখেন আর্ল শহরে আসলে র্যাচেল নামে কোনো যৌনকর্মী ওই সময়ে ছিল না। কিন্তু তিনি নিশ্চিত গ্যাভি নামে ওই নারীকে সেই কানটি দিয়েছিলেন। গ্যাভির বয়স ছিল ১৮। ফ্রান্সে তখন পতিতাবৃত্তির জন্য ন্যূনতম বয়স হতে হতো ২১। তার ছিল তিন বছর কম বয়স।
মারফি গ্যাভির পূর্ববর্তী প্রজন্মের তালিকা বের করেন। এবং জানতে পারেন পাগলা কুকুরে কামড়ের কারণে তিনি অসুস্থ ছিলেন। নিজের চিকিৎসার বাড়তি টাকা যোগাড়ে পতিতালয়ের বাইরে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজ করতেন। এছাড়া গ্যাভি একটি ক্যাফেতেও খন্ডকালীন কাজ করতেন। মজার বিষয় হলো ভ্যানগঘ সেখানে নিয়মিত যেতেন কফি খেতে। এতেই বোঝা যাচ্ছে এই দুজনের মধ্যে আগে থেকেই একটি ভালো যোগাযোগ ছিল।
ভ্যানগঘের সবচেয়ে মূল্যবান ছবি ও একজন ড.পল গ্যাচেট
এখন পর্যন্ত ভ্যানগঘের ছবির মধ্যে সবচেয়ে বেশি দাম উঠেছে ‘ড. পল গ্যাচেট’স পোট্রেট’ । ১৯৯০ সালে ছবিটি যখন বিক্রি হয় এর দাম উঠেছিল ৮৩ মিলিয়ন ডলার। এই ছবিটির এখন আনুমানিক মূল্য হতে পারে ১৫২ মিলিয়ন ডলার। ভ্যানগঘ মূলত তার ঘনিষ্ঠ একজন বন্ধুর পোট্রেট আঁকতে চেয়েছিলেন, শেষ পর্যন্ত যার পোট্রেট আঁকেন, তিনি ড.গ্যাচেট। তিনি ছিলেন অলটারনেটিভ মেডিসিনে বিশেষজ্ঞ একজন চিকিৎসক। অনেক বোদ্ধার মতে, ভ্যানগঘের সঙ্গে ড. গ্যাচেটের গভীর সম্পর্কের কারণেই এই ছবিটির দাম এতো বেশি হয়েছে। ভ্যান গঘের জীবনের শেষের দিকে এই চিকিৎসক ছিলেন তার পাশে।
মজার বিষয় হলো, ভিনসেসন্ট ভ্যানগঘের ড. গ্যাচেটের প্রতি মনোভাব প্রথমদিকে মোটেও সুপ্রসন্ন ছিল না। থিও-ই ভাইয়ের চিকিৎসার জন্য ড, গ্যাচেটকে ঠিক করেছিনে। ভাইয়ের কাছে লেখা এক চিঠিতে তিনি লেখেন, আমি মনে করি, আমাদের আসলে ড.গ্যাচেটকে এতো গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নেই।প্রথম কথা তিনি আমার থেকেও তিনি রোগা।আমি মনে করি, একজন অন্ধ যদি আরেকজন অন্ধকে পথ দেখায় তারা দুজনই কী গর্তে পড়বে না? অবশ্য দু দিনই পর বোনের কাছে লেখা আরেক চিঠিতে ড, গ্যাচেটের ভূয়সী প্রশংসা করেন ভ্যানগঘ।
জীবদ্দশায় একটি নয়, অনেক পেইন্টিং বিক্রি করেছিলেন
অনেক গবেষকের মতে, জীবদ্দশায় শুধুমাত্র একটি পেইন্টিং বিক্রি করেছিলেন ভ্যানগঘ। আর তা হলো ‘ দ্য রেড ভিনইয়ার্ড’ । এই পেইন্টিংটি এখন শোভা পাচ্ছে মস্কোর পুশকিন জাদুঘরে। ভ্যান গঘের বাকি পেইন্টিং, যা ৯০০টিরও বেশি, তার তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বিক্রি হয়নি বা জনপ্রিয়তা পায়নি। তবে ভিনসেন্ট মিউজিয়াম.এনএল এর ভাষ্য, ‘আমরা একেবারে নিশ্চিত নই, ভ্যান গঘ তার জীবনে ঠিক কতোটি পেইন্টিং বিক্রি করেছেন। তবে যেকোনো বিচারে, দুটি ছবির বেশি হবে। ভ্যানগঘ জীবনের প্রথম কমিশন পেয়েছিলেন তার চাচার কাছ থেকে ১৮৮২ সালে। চাচা ছিলেন একজন আর্ট ডিলার, তাই তিনি নিজের মতো করে ভাইপোকে সাহায্য করতে চান। চাচার কাছ থেকে ফরমাশ পেয়ে হেগ শহরের ১৯ টি সিরিজ ছবি আঁকেন। ভ্যানগঘ প্রথম পেইন্টিং বিক্রি করেন আর্ট ডিলার জুলিয়ান টঙ্গুয়ের কাছে। লন্ডনের একটি গ্যালারির কাছে তার দ্বিতীয় ছবিটি বিক্রি করে দেন ভাই থিও। দ্য রেড ভিনইয়ার্ড ১৮৮৮ সালে ভ্যানগঘ তার এক বন্ধুর কাছে বিক্রি করেছিলেন।
ভিনসেন্ট ভ্যানগঘ তার তরুণ বয়সে একসময় নিজের চিত্রকর্ম অন্য চিত্রশিল্পীদের কাছে বিক্রি করতেন। আর এটি তিনি করতেন খাদ্য, ড্রইং ও পেইন্টিংয়ের উপাদানের বিনিময়ে। সে হিসেবে বলা যায়, ভ্যানগঘ তার জীবদ্দশায় তার অনেক চিত্রকর্ম বিক্রি করেছিলেন।
মৃত্যু এখনো রহস্যে ঘেরা
ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ ১৮৯০ সালের ২৯ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর বিষয়টি এখনো পর্যন্ত রহস্যের চাদরে মোড়া। তার মৃত্যু কী আত্মহত্যাজনিত নাকি তিনি হত্যাকা-ের শিকার হয়েছেনÑ এ নিয়ে এখনো চলছে বিতর্ক। চিত্রকলার ইতিহাসবিদগণ বিশ^াস করেন, তিনি আত্মহত্যা করেছেন। তার পেটে গুলির ক্ষত ছিল। গুলি লাগার ৩০ ঘণ্টা পর তার মৃত্যু হয়।
তার মৃত্যুর আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণাতেও বলা হয়েছে, গুলিতে নিজেকে আঘাত করে সৃষ্ট ক্ষতে তার মৃত্যু হয়েছে। মনে হচ্ছে তিনি আত্মহত্যা করেছেন।
তবে অন্য আরেকটি পক্ষ এই মৃত্যুকে হত্যাকা- বলে মনে করেন। তাদের মতে, এখন পর্যন্ত পাওয়া সকল পারিপাশির্^ক অবস্থা এমন ইঙ্গিত দেয়, ভ্যান গঘের পক্ষে গুলি করে নিজের মৃত্যু নিশ্চিত করার মতো ক্ষত সৃষ্টি সম্ভব নয়। তারা আরো দাবি করেন, যে মডেলের রিভলবার দিয়ে গুলি করা হয়েছে, সেই একই মডেলের রিভলবার দিয়ে বিভিন্ন এঙ্গেলে গুলি করে পরীক্ষা করে দেখা গেছে, তিনি নিজেকে নিজে গুলি করলে, তার শরীরে যে পরিমাণ গান পাউডার থাকার কথা ছিল, তা সেখানে ছিল না।
ভিনসেন্টভ্যানগঘ ডট ওআরজি’ জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে পাওয়া কিছু সাক্ষ্যপ্রমাণে, এই ধারণা দেয় যে, রেনে সেক্রেটান নামে এক কৃষকের গুলিতে ভ্যানগঘের মৃত্যু হতে পারে। ঘটনার দিন ওই এলাকায় রেনে সেক্রেটানকে দেখা গিয়েছিল এবং ভ্যানগঘের সঙ্গে তার পূর্ব শত্রুতাও ছিল।
গবেষকদের একটি পক্ষের মতে, কয়েকদিন ধরে বিভিন্নজনের কাছ থেকে মৃত্যুর হুমকি পাচ্ছিলেন ভ্যানগঘ। নিজের নিরাপত্তায় তাই সঙ্গে রাখতেন রিভলভার। আবার অস্ত্র চালানায়ও ছিলেন তিনি দক্ষ। যেতেন নিয়মিত শিকারে। তাই ধারণা করা হচ্ছে, যদি তিনি নিজের গুলিতে মারাও যান, তাহলে তা ছিল একেবারেই দুর্ঘটনাপ্রসুত। এছাড়াও তার বুকপকেটে পাওয়া চিঠিতে এই ধারণা দেয়, যদিও তার বিভিন্ন ধরনের মানসিক সমস্যা একসময় ছিল, কিন্তু তিনি সেই পরিস্থিতি থেকে উন্নতি করছিলেন এবং সেই চিঠিগুলোতেও তার নিজের ভবিষ্যত জীবন নিয়ে ইতিবাচক ভাবনা ছিল।
তথ্যসূত্র: বার্কলে লাইব্রেরি, ভিনসেন্টভ্যানগঘ ডট ওআরজি, ভিনসেন্ট মিউজিয়াম.এনএল ও নিউ ইয়র্ক টাইমস।
লিখেছেন- পলাশ সরকার