ভাইকিংস: প্রাচীন এক বর্বর আর বিচিত্র জাতি যারা আবিষ্কার করেছেন আমেরিকা!
ভূমিকা:
ইদানীং অনেক স্পোর্টস টিমের নাম এ ভাইকিংস রাখার বিষয় টা বেশ ইন্টেরেস্টিং, তাই না? আচ্ছা কখনো কি ভেবেছেন কেন স্পোর্টস টিমে এই শব্দটা আসে?
ভাইকিংস শব্দটা এসেছে মুলত সমুদ্র যোদ্ধা বা সমুদ্রের দুর্বার দস্যু থেকে৷ প্রাচীন কালে এই নামে এক জাতি ছিলো। প্রাচীনকাল বলতে সময়কালটা আবার খ্রীস্টপূর্বও না, এই সাতশো শতক থেকে এদের উৎপত্তি আর কি।
ভাইকিংসরা ছিলো খুব শক্তিশালী এক জাতি। এরা ছিল সমুদ্রযোদ্ধা, জলদস্যু এবং ভয়ংকর লুটতরাজ। এরা এতোটাই ভয়ানক ছিলো, সাধারণ মানুষ এদেরকে মৃত্যুর সাথে তুলন করতো।
ভাইকিংসদের এই অসাধারণ শক্তিশালী বৈশিষ্ট্যের জন্যেই এই আধুনিক যুগে এসেও কোন কোন খেলার দলের নামের আগে ভাইকিংস শব্দটা অর্নামেন্টাল হিসেবে লাগানো হয়! মানে বুঝলেন না? নামেই দলকে সেই পাওয়ারফুল বানানো হয়! নাম শুনেই ধামাকা টাইপ আর কি!
তো এই জাতীর সাথেই ইদানীং শোনা যায় আমেরিকা আবিস্কারের ইতিহাস। ইতিহাসবিদেরা এটা প্রমাণ করেছেন যে, কলম্বাস নয়, ভাইকিংসরাই উত্তর আমেরিকার মাটিতে প্রথম অভিযাত্রীদল হিসেবে পা রাখে।
যাই হোক, এই জাতির বিস্তারিত ইতিহাস আমরা বলবো আমাদের আজকের মুল সেশনে।
প্রিয় পাঠক, কেমন আছেন সবাই? চলে এলাম আজকে আবার খুবই দারুণ এবং গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় নিয়ে, আর সেটা হলো, ভাইকিংস এবং তাদের আমেরিকা আবিস্কার এর বিষদ নিয়ে।
চলুন বিস্তারিত শুরু করা যাক-
কলোম্বাস কি আসলেই আমেরিকা আবিস্কার করেছিলেন?
বাচ্চা থেকে বুড়ো যাকেই জিজ্ঞেস করেন, আমেরিকা সর্বপ্রথমকে আবিস্কার করেছে-চোখ বন্ধ করে সবার আগে কলোম্বাস এর নাম বলে দিবে!
আর বলবেই না কেন? বই পুস্তক সবখানে তো এটাই লিখা রয়েছে! অথচ এটা অনেক বড় একটা ভুল ইতিহাস বছরের পর বছর ধরে দুনিয়াজুড়ে প্রকাশ হয়ে আসছে!
মজার ব্যাপার হচ্ছে, কলম্বাস এর আমেরিকা জয়ের বহু আগেই ( অন্তত ৫০০ বছর আগেই) ভাইকিংস নামক এক বর্বর ইউরোপীয়ান জাতি আমেরিকা আবিস্কার করেছিল!
রাশিয়া, গ্রিনল্যান্ড এবং স্ক্যান্ডিনেভিয়ার বহু প্রাচীন পুথি-পত্র এবং গাঁথায় তাঁদের ইউরোপ জয় থেকে শুরু করে রাশিয়া, গ্রীনল্যান্ড, স্ক্যান্ডিনেভিয়া, আমেরিকাসহ আরো অনেক জয়গায় প্রথম পদার্পণ এবং অন্যান্য শৌর্য-বীর্যের কথা বেশ রুপক অর্থে বলা হয়েছে৷ এসব গাথা,প্রাচীন পুথি-পত্র গবেষণা করে ইতিহাসবিদেরা এটাই প্রমান পেয়েছেন যে কলোম্বাস নয়, ভাইকিংসরাই প্রথম আমেরিকা মহাদেশ আবিষ্কার করে।
ভাইকিংস কারা আসলে?
ভাইকিংস! বলতেই চোখের সামনে ভেসে উঠে একদল জলদস্যু-আদতে এরা জলদস্যু বা সমুদ্র পথের ব্যবসায়ী অথবা সমুদ্র পথের যোদ্ধা ও বলতে পারেন। বর্তমান রাশিয়ানদের আদি পুরুষ হচ্ছে এই ভাইকিংসরা৷ এদের আদি বসতি ছিলো সুইডেন, নরওয়ে আর ডেনমার্ক জুড়ে। ক্রমান্বয়ে এরা এদের বসতি ছড়িয়ে দেয় ইউরোপ এর বিরাট এলাকা জুড়ে।
পুরো ৮ম শতক থেকে শুরু করে প্রায় ১১শ শতক পর্যন্ত ইউরোপীয় এই জাতিরা খুব প্রভাব আর প্রতিপত্তির সাথে ইউরোপের সবচেয়ে বড় এক এলাকা জুড়ে এদের বসতি স্থাপন করে।
যদিও এদেরকে অনেকে যোদ্ধা নামে অভিহিত করেন, কিন্তু এদের মুল কাজ ছিল লুটতরাজ আর ত্রাস করে নিজেদের সম্পদ আর শক্তি বাড়ানো। এরা দেখতে যেমন সুঠাম ছিলো তেমনি ছিলো প্রচন্ড মেধাবী! এরা পড়াশোনা তেমন করতো না কিন্তু যুদ্ধবিদ্যায় এরা ছিল অদ্বিতীয়!
লুটপাট আর নানাবিধ অন্যায় কাজে এরা এতোটাই ভয়ংকর হয়ে উঠেছিল যে পুরো ৮০০ শতক থেকে শুরু করে ১১০০ শতক পর্যন্ত এদের ত্রাসের রাজত্ব চলমান ছিলো। মানুষ এদের নাম শুনলেই ভয় পেতো৷ এরা এতোটাই অসভ্য নির্মম আর স্বার্থপর ছিলো যে মানুষ ভাইকিং মানেই স্বাক্ষাৎমৃত্যু ধরে নিতো। ওদের সামনে পরলে নিরীহ পুরুষ, মহিলা এমনকি শিশু বাচ্চারাও রক্ষা পেতো না।
যাই হোক, এই জাতির লোকজন ইউরোপে তাদের বসতি থেকে ক্রমান্বয়ে ছড়িয়ে পরে চারদিকে। ইউরোপ, আমেরিকার অনেক জায়গার এরা কলোনি বানায়, এবং নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করে।
এরা পূর্বদিকে রাশিয়া, পশ্চিম দিকে গ্রীনল্যান্ড আবিষ্কার করে এবং প্রায় ১০০০ শতকের দিকে এরা সর্বপ্রথম আমেরিকা মহাদেশ আবিষ্কার করে।
ভাইকিংসরা কি প্রথমেই জলদস্যু ছিলো?
নাহ! ভাইকিংসরা আর দশটা প্রাচীন সভ্য মানুষের মতই কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতো। যেহেতু তারা ছিলো উত্তরের অধিবাসী, আর উত্তরে ছিলো প্রচন্ড ঠান্ডা, সাথে রুক্ষ আবহাওয়া। এইরকম আবহাওয়ায় সাধারণ ভাবে কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করা একপ্রকার অসম্ভব হয়ে পরেছিলো। আর এরা ছিলো প্রচুর স্বাধীনচেতা জাতি এদের কোন রাজা ছিলো না। এরা কোন রাজার অধিনস্থ না থেকে গোত্র করে থাকতো। এজন্য এদের সুন্দর ভাবে টিকে থাকার জন্য বড় পরিসর থেকে এরা তেমন কোন সাপোর্ট ও পেতো না।
একসময় এরা পরিস্থিতিতে পরে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে লুটপাট চালাতে আরম্ভ করলো! যেহেতু এরা ছিলো অশিক্ষিত জাতি তাই এরা ভাবলো এভাবে অন্যের সম্পদ লুট করে জীবন চালানোই তুলনামূলক সহজ এবং আরামদায়ক। আর এভাবেই আস্তে আস্তে তারা ভয়ানক জলদস্যু আর লুটতরাজ-এ পরিনত হতে লাগলো।
জলদস্যু হিসেবে এরা ছিলো সবচেয়ে শক্তিশালী আর সবচেয়ে ভয়াবহ।
ভাইকিংসরা আমেরিকা আবিস্কার করেছিলো কেন?
সোজা বাংলায় তাদের লুটপাট এর সুবিধার জন্য ৷ বুঝলেন না? দাঁড়ান, বুঝিয়ে বলছি! ভাইকিংসরা সমুদ্র পথে লুটপাট করার জন্য কিছু নিয়ম মেনে চলতো। যেমন তারা তাদের ভিন্ন ভিন্ন গোত্রকে সমুদ্রের ভিন্ন ভিন্ন পথে পাঠিয়ে দিতো ৷ তো এভাবে যেই দলটা সফল হয়ে আসতো, মানে বেশি করে টাকাপয়সা সোনাদানা লুটপাট করে আনতো, সেই দল থেকে তারা সমস্ত তথ্য উপাত্ত নিতো৷ এরপর আবার আরেক বড় কোন দল পাঠিয়ে দিতো আগের সেই সফল হওয়া পথে!
কোথায় লুটপাট বেশি করা যাবে এবং আরামদায়ক জীবনযাপন করা যাবে এই উদ্দেশ্যে সবসময়ই তারা সমুদ্রপথে এদিকে সেদিকে বহুদূর পর্যন্ত জাহাজ চালিয়ে যেতো৷ এবং এভাবেই তারা এক সময় গ্রীনল্যান্ড, রাশিয়া, আমেরিকা সহ আরো অনেক দেশ আবিস্কার করে সম্পুর্ণ নিজের সুবিদার্থে।
ভাইকিংসরা আমেরিকা আবিস্কার করেছিলো কি দিয়ে?
এরা অশিক্ষিত ছিলো, দেখতে সিনেমার নায়কদের মত সুদর্শন হলেও এরা বিদ্যা আহরণে ছিলো আমড়া কাঠের ঢেকির। তবে এরা জন্মগতভাবে তীক্ষ্ণ মেধার অধিকারী ছিলো। লম্বা চওড়া গড়নের এই জাতির লোকজন যে কোন জাহাজ বানানোতে খুব পারদর্শী ছিলো৷
এরাই বানিয়েছিল এদের সিগনেচার শীপ, যেটা ড্রাগন জাহাজ অথবা ভাইকিংসদের জাহাজ নামেও পরিচিত।
ওদের নিয়ে নির্মিত কোন সিনেমা যদি ইতিমধ্যে কেউ দেখে থাকেন, তাহলে ওদের জাহাজ নিয়েও ইতিমধ্যেই ধারণা পেয়ে গেছেন।
দেখতে চমৎকার এই যুদ্ধজাহাজ এর সামনের দিকে থাকতো একটা ড্রাগনের মাথার কাঠামো। চিকন অথচ লম্বা করে বানানো এই জাহাজ গুলো খুব দ্রুত চলতে পারতো এবং যে কোন আবহাওয়ার সাথে তাল মিলিয়ে সমুদ্র পারি দিতে পারতো৷ প্রতিটি ভাইকিং জাহাজে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ জন যোদ্ধা থাকতো। আর দু পাশে বৈঠা চালানোর জন্য প্রতিটি জাহাজে আরো থাকতো ১৬+১৬= ৩২ জন।
তো এই জাহাজ করেই ওরা আমেরিকা আবিস্কার করেছিল। ওরা তো গোত্র করে যে কোন অভিযানে যেতো এবং বেশিরভাগ সময়েই তাদের অনেক গোত্র ফেরত আসতো না । হয়তো সমুদ্রে দিক নির্ণয়ে ভুল অথবা খাদ্য ও পানীয়জল এর অভাবে মারা যেতো সমুদ্রের মাঝেই । তবে কোন অভিযানে যদি এদের একজন যোদ্ধা ও ফেরত আসত–এদের সবার জন্য উৎসব শুরু হয়ে যেতো ৷ এরা পরের মৌসুমে দ্বিগুণ যোদ্ধা আর বড় জাহাজ নিয়ে রওনা দিতো আরো বেশি করে সহায় সম্পদ লুট করে আনার উদ্দেশ্য নিয়ে।
ভাইকিংস সভ্যতার শেষ কবে হয়?
ভাইকিংসদের প্রথম আক্রমণ এর কথা জানা যায় ৭৯৩ সালের দিকে । ব্যাপারটা ছিলো এমন, এরা এটা বের করেছিল সে সুর্যাস্ত যেদিকে যায় সেদিক থেকে জাহাজ চালালে ৭ দিন পরে একটা ধনী দেশ পাওয়া যায় ৷ আর তাই তারা এই দেশ আক্রমণ এর জন্য অনেকবার চেষ্টা ও করতে থাকে৷ অবশেষে ৭৯৩ সালে তারা এই দেশ এ যাওয়ার দিক নির্ণয়ে সক্ষম হয়। আর এই দেশটি হলো ইংল্যান্ড। এভাবেই ওদের প্রথম আক্রমণ শুরু হয়।
আস্তে আস্তে তারা ইংল্যান্ড দখল নেওয়ার পরে ছড়িয়ে পরে চারদিকে । একের পর এক নতুন জায়গা আবিস্কার, নতুন নতুন কলোনি বানানো-এভাবেই এই সাম্রাজ্য ছড়িয়ে পরতে থাকে ইউরোপ ছাড়িয়ে আমেরিকা জুড়ে।
১১০০ শতাব্দীর শেষ দিকে যখন দুনিয়াব্যাপি অর্থনৈতিক অবস্থা সমৃদ্ধশালী হতে শুরু করে, এবং বিভিন্ন ধর্মের এক অভুতপুর্ব মিশ্রণ হতে থাকে- ওরা আস্তে আস্তে তাদের লুটপাট ছেড়ে সভ্য পথে চলে আসতে থাকে । ক্রমান্বয়ে খ্রিস্টান ধর্মের প্রতি তাদের অনুরাগ বাড়তে থাকে, আর তারা নিজেদেরকে সভ্য এবং শিক্ষিত করার প্রয়াসে লুটপাট বাদ দিয়ে পুরোপুরি সিভিলাইজড হতে থাকে।
সর্বোপরি, রোমান সভ্যতা যেভাবে ইতিহাসকে পরিচালিত করেছে এক প্রভাবশালী পথে, ওদের সভ্যতা কিন্তু তা পারেনি। সরাসরি এই জাতি হয়তো প্রাচীন মানব সভ্যতায় তেমন কোন পজিটিভ ভুমিকা রাখেনি, কিন্তু এটা স্বীকার করতেই হবে রোমান সভ্যতার পরে একমাত্র ওরাই প্রাচীন সভ্যতার ভিত সজোরে নাড়িয়ে দিয়েছিলো।
লুটপাট,হত্যা, অত্যাচার ইত্যাদি কাজ করে ওরা একটা সময় নিজেদের বর্বর আর অসভ্য হিসেবে পরিচিত করেছে এটা ঠিক । তবে এটাও ঠিক এই বর্বর আর অসভ্য জাতিই আবার আবিস্কার করেছে সমুদ্র যাত্রার বিভিন্ন উপায়, আবিস্কার করেছে আমেরিকা নামক এক মস্ত মহাদেশ এবং উপহার দিয়েছে শতশত নতুন নতুন কলোনি।
পরিশেষে,
কালের গহব্বরে ভাইকিংসদের মত অপারেজয় শক্তিশালী আর হিংস্র জাতি হারিয়ে গিয়েছে এটা ঠিক ! কিন্তু এরাই আবার রচনা করে গেছে এমন এক ইতিহাস, যেখানে তাদের নাম সবাই মনে করতে বাধ্য থাকবে সারাজীবন।
ধন্যবাদ সবাইকে। শীগগিরই আসবো অন্য কোন ইন্টেরেস্টিং টপিক নিয়ে।
সূত্র :
লিখেছেন- রোজী আরেফিন রুমী