১৯৪৬ এর নোয়াখালী দাঙা এবং লীলা রায়ের ভুমিকা
নোয়াখালী দাঙা আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের এক দুঃখজনক অধ্যায়।
তো, দেশভাগ নিয়ে বলতে গেলে খুব গুরুত্ব দিয়ে যে তিনটা জিনিস এর বিশ্লেষণ করা লাগে-
কোলকাতা দাঙ্গা
নোয়াখালী দাঙা
এবং বিহার দাঙ্গা
দেশভাগ! ভাগ মানে খন্ডিত হওয়া, ভাগ হয়ে কয়েকটা অংশ হয়ে যাওয়া!
খণ্ডিত হওয়া জিনিস কোনকালেই ভালো না। আর যেখানে একটা মানচিত্রের খন্ডিত হওয়ার ব্যাপার-শুধু তো আর মানচিত্র ভাগ হয়নি,ভাগ হয়েছে অজস্র মানুষের আত্মার বন্ধন, নিজের ভিটা, নিজের সাজানো গোছানো সংসার, ব্যাবসা বানিজ্য, আরো কতকিছু!
ইংরেজ রা যখন বুঝতে শুরু করেছিলো এউ ভারত উপমহাদেশে তাদের সময় আর নেই, তারা ইতিহাসের সবচেয়ে কুখ্যাত কাজ টা সুকৌশলে করে এখান থেকে সরেছে। অসাম্প্রদায়িক এই ভারত উপমহাদেশে লাগিয়ে গেছে হিন্দু মুসলিম দাঙা- করে দিয়ে গেছে একটা বড় দেশের কয়েকটা টুকরো। ব্রিটিশরা জানতো, এই ভারত উপমহাদেশ কে খন্ডিত না করতে পারলে এই ভারত উপমহাদেশই একসময় অপরাজেয় শক্তি হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াবে। আর তাই ব্রিটিশ রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে তারা হিন্দু মুসলিম বিদ্বেষ সৃষ্টি করে, এবং বাধ্য করে যেন ভারত উপমহাদেশ ভেঙে ছোট হয়। বিশ্বের বুক থেকে ভারত উপমহাদেশ নামক এক দুর্বার পরাশক্তিকে রোধ করার দারুণ নীলনকশা করে গিয়েছিলো রানী এলিজাবেথ এর ব্রিটিশ শাসকরা।
প্রিয় পাঠক, চলে এলাম আমাদের আজকের খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, লীলা রায় এবং ১৯৪৬ এর নোয়াখালী দাঙা নিয়ে। নোয়াখালী দাঙায় লীলা রায় নামক এই হিন্দু মহিলা কি ভুমিকা রেখেছেন, জানতে হলে আগে আমাদের জানতে হবে নোয়াখালী দাঙাতে আসলে কি হয়েছিল!
নোয়াখালী দাঙা/ নোয়াখালী হত্যাযজ্ঞ/ নোয়াখালী গণহত্যা:
দেশভাগের ঠিক অল্প সময় আগে, ১৯৪৬ সালে ব্রিটিশ শাসন তখনো এই ভারত উপমহাদেশে চলমান-ঠিক তখনি অক্টোবর থেকে নভেম্বর মাসে নোয়াখালী তে সংঘটিত হয় এক বিশাল দাঙা। এই দাঙ্গা মুলত লাগিয়েছিল তৎকালীন পূর্ববঙ্গ এবং আসাম এর কিছু স্থানীয় মুসলমানেরা। এর মদতে ছিল মুসলমান কিছু উঠতি নেতা। এই দাঙ্গা মুলত কলকাতা দাঙ্গার রেশ ধরে গঠিত হয়৷ দাঙ্গায় হিন্দুদের জোর করে ধর্ম ত্যাগ করা, গণহত্যা, ধর্ষন,লুটপাট, অগ্নিসংযোগ করে সহ আরো নানা ধরনের অপকর্ম ঘটানো হয়েছিল৷ যদিও স্মরণকালের ভয়াবহ এই দাঙ্গায় কলকাতা দাঙা এবং বিহার দাঙা থেকে ক্ষয়ক্ষতির পরিমান কম, কিন্তু তবুও প্রায় ৫০০০ মানুষকে পুড়িয়ে মেরে ফেলা হয়েছিল। আর ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল ২০০০ বর্গ কিলোমিটারের ও বেশি এলাকা।
অন্যসব দিনের মতোই ১৯৪৬ সালের ১০ই অক্টোবর নোয়াখালী এবং ত্রিপুরা জেলার সাধারণ মানুষের দিন শুরু হয়েছিল সেদিন। উপরন্তু সেদিন ছিলো কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোর দিন, তাই নোয়াখালীর হিন্দু জনগণেরা উৎসব আনন্দ নিয়েই ব্যস্ত ছিলো।
এক্টু স্টাডি করে জানতে পারি, হিন্দুদের কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি নিজের এলাকার পাড়াপ্রতিবেশি ভাইয়েরা এইরকম জঘন্যরকম একটা ঘটনা ঘটাতে পারে। হ্যাঁ, হিন্দু মুসলিম সবাই তো তখন পাড়াপ্রতিবেশি ভাই ভাই হিসেবেই মিলেমিশে থাকতো।
অক্টোবরের ১০ তারিখ থেকে আরম্ভ হয়ে এই দাঙা ৪ সপ্তাহ টানা চলেছিল।৪ সপ্তাহ পরে দেখা যায়, প্রায় ৫০০০ হিন্দুকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। ধর্ষণের স্বীকার হয়েছে বহু হিন্দু নারী ও শিশু।এছাড়াও অসংখ্য হিন্দু নারী পুরুষ কে ধর্মান্তরিত করতে বাধ্য করা হয়েছিল। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল প্রায় ৫০,০০০ থেকে ৭৫,০০০ হিন্দু নরনারী এবং শিশু-যাদের পরে আশেপাশের বিভিন্ন আশ্রয় শিবির গুলোতে আশ্রয় প্রদান করা হয়েছিল।
আরো প্রায় ৫০,০০০ হিন্দু যারা বাপ দাদার ভিটামাটির উপর মায়া কাটাতে পারেনি,খুবই মানবেতর জীবন যাপন করে গেছে নিজেদের এলাকায়, নিজেদের ভিটাতে।
আসলে এতটুকু লিখার পরে একটা কথাই মনে ভাসছে-হিন্দুরা শখ করে নিজের ভিটা ছেড়ে বাংলাদেশ ত্যাগ করে ভারতে যায়নাই। আসলেই কলকাতাতে যেমন টা হয়েছিল মুসলিমদের উপরে, তার প্রায় সেইম হয়েছিল এদেশের নোয়াখালীর হিন্দু সাধারণ নিরীহ মানুষের উপরে। আর তাই তো দেশভাগের আগে থেকেই অনেক হিন্দুরা এই দেশ ত্যাগ করে, নিজের জন্মস্থান ছেড়ে চলে গিয়েছে ভারতে শুধুমাত্র একটু নিরাপদ আশ্রয়ের আশায়!
ফিরে আসি আবার মূল টপিকে, সবচেয়ে কষ্ট লেগেছে এটা জেনে যে তৎকালীন হিন্দুরা শুধুমাত্র নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে একই এলাকায় মুসলিম লীগকে ‘জিজিয়া ‘ নামক চাঁদা ও দিতেন।
আদতে নোয়াখালী দাঙা কে এক সাধারণ সাম্প্রদায়িক দাঙা মনে হলেও এটা ছিল কোলকাতা বা বিহার দাঙার মতোই, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর সংখ্যাগুরু সম্প্রাদায়ের সুপরিকল্পিত আক্রমণ।
নোয়াখালী দাঙার শেষ পরিনতি খুব খারাপ ছিলো৷ যদিও মহাত্মা গান্ধী নোয়াখালী তে আসেন,এবং অনেক চেষ্টা করেন হিন্দু মুসলিম সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পুনঃস্থাপন করার, কিন্তু হিন্দু যারা জীবিত ছিলেন, কেউই আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে নি৷ তাদের সবার মনের মধ্যে প্রচন্ড ভয় এবং হতাশা ঢুকে গিয়েছিল,যার ফলশ্রুতিতে বেশিরভাগই এ দেশে তাদের সবকিছু ফেলে দিয়ে ত্রিপুরা এবং আসামে চলে যেতে বাধ্য হোন।
নোয়াখালী দাঙা কেন হয়েছিল?
এই দাঙ্গা কি শুধুই কলকাতা দাঙ্গার রেশ? নাকি এখানে জড়িয়ে ছিল গভীর কোন সাম্প্রদায়িক ইস্যু? নোয়াখালীর দাঙ্গায় ভুক্তভোগী যদিও সাধারণ মানুষেরা, কিন্তু এই দাঙা পর্যন্ত আসতে তখনকার মুসলমানদের কিন্তু অনেক সময় লেগেছিল। ঘটনার তটপথ যদি বিশ্লেষণ করতে যান, দায়ী ইংরেজি শিক্ষা এবং হিন্দুদের সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এ অনেক এগিয়ে যাওয়া। আপনারা জানেন হয়তো মুসলমানেরা প্রথমেই ইংরেজি ভাষা শিখতে চায়নি, মুসলমানেরা ধরেই নিয়েছিল ইংরেজি ভাষা শিখলে ধর্ম অবমাননা হতে পারে৷
যাই হোক হিন্দুরা ইংরেজি ভাষা শিখেছিলো এবং মুসলমানদের তুলনায় অনেক এগিয়েও গিয়েছিল সর্বক্ষেত্রে। হিন্দু মুসলিম রেশারেশি মুলত তখন থেকেই শুরু হয়েছিল৷ দেখে গেছে হিন্দু শিক্ষকেরা মুসলিম ছাত্রদের পরীক্ষার খাতায় কম নাম্বার দিতেন, চাকরিতে মুসলমানদের কম সুযোগ দিতেন অথবা মুসলমানদের চাকরির সুযোগ দিতেন ই না৷ এছাড়াও হিন্দু প্রধান অঞ্চলে মুসলমানদের খুব নাজুক অবস্থা পার করতে হতো।
এবং সর্বোপরি মুসলিম অধ্যুষিত ঢাকাতে ঢাকা ইউনিভার্সিটি নির্মানে হিন্দুদের বিরোধী অবস্থান-এসকল বিভিন্নরকম নাজুক কারনে হিন্দুদের উপরে পূর্ববঙ্গের মুসলিমদের রেশ কমেই বেড়ে যাচ্ছিলো৷
ফাইনালি যখন কলকাতা দাঙাতে হিন্দুদের কতৃক হাজার হাজার মুসলমানদের হতাহত হওয়ার ঘটনা ঘটে, পুরো ব্যাপারটা একেবারে আগুনে ঘি ঢেলে পরিস্থিতি অনেক ভয়াবহ করে তোলে।প্রথমত ইংরেজ আমলে মুসলমানদের উপর হিন্দুদের দীর্ঘ বঞ্চনা, সাথে কলকাতায় হাজার হাজার মুসলমানদের হত্যা করা, এবং এখানে আরো গুজব রটে যে ততকালীন জমিদার রাজেন্দ্র লাল চৌধুরী তার বাড়িতে পুজোতে এক মুসলমান বালক কে বলি দিয়েছেন- সব মিলিয়ে নোয়াখালীর মুসলমানেরা একই এলাকার হিন্দুদের উপর ক্ষেপে উঠেন, এবং প্রতিশোধ নিতে হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে আগুন লাগিয়ে হতাহতের ঘটনা ঘটান।
নোয়াখালী দাঙায় লীলা রায়ের ভুমিকা:
১৯৪৬ এর নোয়াখালী দাঙায় লীলা রায় নামক এক হিন্দু নারী একাই ১৩০৭ জন হিন্দু নারীকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
তো কে ছিলেন এই লীলা রায়? লীলা নাগ ( রায়) ছিলেন এক অভিজাত পরিবারের সন্তান, ছিলেন অবিভক্ত ভারত উপমহাদেশের মেধাবী বিপ্লবী ও দেশনেত্রী।প্রচন্ড ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এবং সুন্দরী এই বিপ্লবী নেত্রি ১৯২১ সালে বেথুন কলেজ থেকে প্রথম স্থান অর্জন করে অনার্স পাস করেন ইংরেজি বিষয়ে। এরপর তিনি এম এস করেন।
পড়াশোনা শেষ করে লীলা রায় আরো ১২ জন সাথী নিয়ে দীপালি সংঘ নামের এক জনহিতকর প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেন।বলা বাহুল্য, ঢাকার শিক্ষা ব্যাবস্থায় এই লীলা রায়ের ভুমিকা অপরিসীম। বর্তমানের কামরুন্নেসা গার্লস স্কুল, শেরেবাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয়, আরমানীটোলা বালিকা বিদ্যালয় সব এই দীপালী সংঘের অবদান। লীলা রায় ঢাকার অলিতে গলিতে বিশেষ করে নারী শিক্ষা ছড়িয়ে দিতে অসামান্য ভুমিকা রেখেছিলেন। তিনি একাধারে প্রতিস্থাপন করেছেন বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র, ১২ টি প্রাইমারি স্কুল এবং ছোটবড় বেশ কিছু শিশু শিক্ষাকেন্দ্র!
ক্রমান্বয়ে তিনি সুভাষ বসুর নীতির প্রতি অনুরক্ত হোন এবং বিপ্লববাদে নিজের নাম জড়ান। বিপ্লবী দলে যোগদানের পরেই বিভিন্ন সময়ে তিনি দীর্ঘ কারাবাস ও ভোগ করেন।
বিপ্লবী এই নারী নোয়াখালীর দাঙ্গায় অসামান্য ভুমিকা রেখেছিলেন।১৯৪৬ সালের নোয়াখালী দাঙার ঘটনায় লীলা রায় তার কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে ১৪ ই অক্টোবর নোয়াখালী পৌছান এবং উদ্ধার কাজে ঝাপিয়ে পরেন। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ঘুরে ঘুরে তিনি একাই মরণাপন্ন অনেক নারী পুরুষ এবং শিশুদের রক্ষা করেন।
এখানে উল্লেখ্য লীলা রায় ছিলেন দেশভাগের প্রবল বিরোধী৷ যেহেতু তিনি ছিলেন নেতাজী সুভাসচন্দ্রের অনুসারী -আর তাই যখন ১৯৪৭ সালের দেশভাগ ঠেকাতে পারেন নি- নিজের স্বামী সংসার নিয়ে একেবারে তল্লিতল্লা গুটিয়ে তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন। ঢাকায় ফিরে এসেও এই মহিয়সী নারী বসে থাকেন নি। আমৃত্যে তিনি দুস্থ এবং অসহায় মহিলাদের পুনর্বাসনের জন্য কাজ করে গেছেন ‘ন্যাশনাল উইমেন সলিডারিটি কাউন্সিল ‘ নামক প্রতিষ্ঠান গঠনের মধ্যে নিয়ে।
নেতাজী সুভাসচন্দ্র দাসের চরম অনুসারী, বিপ্লবী নেত্রি দেশবরেণ্য এই নারীর জীবন অবসান ঘটে ১৯৭০ সালের ১১ই জুন।
তো আজ তাহলে এই পর্যন্তই! ভালো থাকবেন,সুস্থ থাকবেন।
তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া