শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও নিষিদ্ধ পল্লী!

তারিখ:

পোস্ট শেয়ার করুন:

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও নিষিদ্ধ পল্লী!

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় একজন বাঙালি লেখক, ঔপন্যাসিক এবং গল্পকার। দারুণ জনপ্রিয়তার কারণে তিনি ‘অপরাজেয় কথাশিল্পী’ নামে খ্যাত। এক দরিদ্র ব্রাক্ষণ পরিবারে তাঁর জন্ম। পরবর্তীকালে জীবিকার সন্ধানে তিনি পাড়ি জমান তৎকালীন রেঙ্গুনে। সেখান থেকে একসময় ফিরে আসেন কলকাতায়। শুরু হয় তাঁর সাহিত্যিক জীবন। বিখ্যাত এই ঔপন্যাসিক যেমন তাঁর লেখার জন্য পূজনীয় ছিলেন, তেমনি তাঁকে নিয়ে নানা রকম গল্পগুজবেও চলতো। বিশেষ করে নিষিদ্ধ পল্লীতে তাঁর আনাগোনা নিয়ে সমালোচনা ছিল। তাঁর চরিত্রের সেই অজানা দিক নিয়েই এই নিবন্ধ।   

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় শেষ বয়সে বালিগঞ্জ এ বাড়ি তৈরি  করেছিলেন । জাদবপুর থেকে একজন ভদ্রমহিলা মাঝে মাঝে শরৎচন্দ্রের বাড়িতে আসতেন । ভদ্রমহিলা শরৎচন্দ্রকে দাদা বলতেন আর তিনি তাকে ছোটো বোনের মতো খুবই স্নেহ করতেন । একদিন ভদ্রমহিলা শরৎচন্দ্রকে তার জাদবপুরের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করলেন।

নিমন্ত্রণ শুনে তিনি বললেন আমি শিঙ্গি মাছের ঝোল ভাত খাই তুমি যদি তাই খাওয়াতে পারো তাহলে নিশ্চয় যাবো। ভদ্রমহিলা রাজি হলেন আর শরৎচন্দ্র নিমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন। সেদিন ভদ্রমহিলার বাড়িতে সকাল সকাল যথারীতি বেশ ঘটা করে রান্নাবান্না শেষ হলো ঠিক সেসময় ভদ্রমহিলার ননদ তার মায়ের কাছে গিয়ে অর্থাৎ সেই ভদ্রমহিলার শাশুড়ির কাছে গিয়ে বললেন মা বৌদি কাকে নেমন্তন্ন করে খাওয়াবে শুনেছ? মা’তো অবাক। ননদ বললেন লেখক শরৎচাটুজ্জ্যে গো শুনেছি লোকটা যেমন মাতাল তেমনি চরিত্রহীন। বাজে মেয়েছেলেদের মধ্যে সবসময় পরে থাকে। মেয়ের মুখে এই কথা শুনে শাশুড়িতো রেগে আগুন। চিৎকার করে বৌমার কাছে শুটে গেলেন বললেন বৌমা এইটা গৃহস্ত বাড়ি। গৃহস্ত বাড়িতে এইসব একদম চলবেনা। ভদ্রমহিলা এইসব শুনে আকাশ থেকে পড়লেন। তিনি শাশুড়িকে যতই বুঝান শাশুড়ি ততই বেঁকে বসেন। অগত্যা তিনি শুটে গেলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি।

সেখানে কেঁদে কেটে তিনি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে সমস্ত কথা খুলে বললেন । ফলস্বরূপ সেদিন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সেই রাত্রে নেমন্তন্ন খেতে গেলেন না । তিনি নিজের সম্পর্কে বলেছেন সজ্জন সমাজে আমি অপাংক্তেয়। কথাটা কিন্তু কখনো অতিরঞ্জিত ছিল না । সেসময়ে তথাকথিত ভদ্রসমাজে বহুক্ষেত্রে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ অবাঞ্ছিত। রেঙ্গুন শহরে তিনি একবার তার কয়েকজন বন্ধূকে নিয়ে সেখানকার একজন নামকরা নিষিদ্ধ নারী একজন পতিতার কাছে গিয়েছিলেন । সবাই গিয়ে দেখলেন মেয়েটির কঠিন বসন্ত রোগ হয়েছে আর তা দেখে শরৎচন্দ্রের বন্ধুরা ভয়ে সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে পালিয়ে গেলেন ।

কিন্তু তিনি মেয়েটিকে একা ফেলে সেখান থেকে চলে আসেননি । নিজের টাকা খরচ করে ডাক্তার ডাকলেন।মেয়েটিকে ঔষধ দিলেন খুব সেবাযত্ন করলেন। কিন্তু অতো চেষ্টা করেও মেয়েটিকে বাঁচানো গেল না। মেয়েটি মারা যাওয়ার পরে তিনি যথারীতি তার সৎকার করে তবেই বাড়ি ফিরলেন । এই ছিলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বন্ধু গিরিন্দ্রনাথ সরকার তার ‘বর্মদেশে শরৎচন্দ্র’ বইটিতে বলেছেন তিনি একদিক দিয়ে ছিলেন এক উচ্ছৃঙ্খল যুবক দিনরাত মদের নেশায় চূড় হয়ে থাকতেন। মদ না পেলে আফিমের নেশাতেও ভূত হয়ে থাকতেন । আর অধিকাংশ সময় কাটাতেন রেঙ্গুন শহরের নিষিদ্ধ পল্লীতে। 

আপনারা সকলেই জানেন যদি কেউ দিনের পর দিন পতিতা পল্লীতে পরে থাকে সামাজিক মানুষজন তাকে কখনোই ভালো চোখে দেখে না। দুশ্চরিত্র অসভ্য ইত্যাদি বলে সমাজ তার পিঠে বড়সড় লেভেল এঁটে দেয়। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রেও তার কোনও বিন্দুমাত্র বাতিক্রম ঘটেনি। রেঙ্গুন শহরে পেয়েছিলেন দুশ্চরিত্র বা চরিত্রহীনের বিশেষণ।

আর তা ঘাড়ে করে তিনি নিয়ে এসেছিলেন কলকাতায়। বাকী জীবনের জন্য সেই  বিশেষণগুলি হয়ে উঠেছিল তার চিরস্থায়ী এক অলংকার । বলাবাহুল্য সেই অলংকার খুলে রাখার কোনো চেষ্টা বা দায় তার কোনোদিনই ছিল না। ১৯১২ সালে এইবার রেঙ্গুন থেকে এক মাসের ছুটি নিয়ে তিনি এসে উঠেছিলেন হাওড়ার খোলাডাঙা এলাকার নিষিদ্ধ পতিতা পল্লীতে। তখন সেখানে তিনি থাকতেন একদিন সেখানে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন তার মামা ভূপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় ওরফে ভূপেণ বাবু। সেদিন বহু কষ্টে বাড়ি খুঁজে বের করে সেই বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন ভূপেণ বাবু ।

বাড়ির সামনে একটি মেয়ে সুদৃশ্য চুলের বিনুনি করে অদ্ভুত ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। ভূপেণ বাবু বেশ ইতস্তত করে মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন আচ্ছা শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নামে কেউ কী এইখানে থাকে? প্রশ্ন শুনে মেয়েটি বেশ বিনম্র হয়ে জবাব দিয়েছিলেন ওহ দাদা ঠাকুর! তিনি তো উপেরে থাকেন। আপনি পাশের সিঁড়ি দিয়ে উপরে চলে যান । ভূপেণ বাবু উপরে গিয়ে দেখলেন তিনি তন্ময় হয়ে চরিত্রহীন উপন্যাস লিখছেন। সেদিন বাড়ি ফিরে আসার সময় ভূপেণ বাবু লক্ষ করেছিলেন সেই নিষিদ্ধ পল্লীর মেয়েদের কাছে তিনি কারোর কাছে বাবা ঠাকুর কারো কাছে দাদা ঠাকুর।

১৯২৩ সালে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘আঁধারের আলো’ গল্পটি নিয়ে তৈরি হয়েছিলো নির্বাক চলচ্চিত্র। শরৎচন্দ্রের কাহিনী নিয়ে সিনেমা সেই প্রথম। পরিচালক শিশির কুমার ভাদুড়ীর অনুরোধে তিনি কয়েকবার ‘আঁধারের আলো’ ছবিটি দেখতে এসেছিলেন। সিনেমা শেষ হলে প্রতিবারই ক্যামেরাম্যান ননী স্যানাল তাঁকে বাড়ির পথে একটু এগিয়ে  দিতেন। ননী স্যানাল বলেছেন সে সময় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সরাসরি হাওড়ার বাড়িতে যেতেন না । তিনি সিনেমা দেখে বেড়িয়ে কাছেই রামবাগানের নিষিদ্ধ পল্লীতে পতিতা পল্লীতে চলে যেতেন । সেখানে গিয়ে তিনি অসহায় দুস্থ মেয়েদের আন্তরিকভাবে খোজ খবর নিতেন এবং সবশেষে তাদের হাতে টাকা গুঁজে দিয়ে বাড়ির পথ ধরতেন।

তার রেঙ্গুন শহর বলুন বা হাওড়া বা কোলকাতা বলুন যেখানেই গেছেন সেখানেই তিনি দিনের পর দিন কাটিয়েছেন নিষিদ্ধ পল্লীতে। তবে তিনি কখনেই মেয়েদের খদ্দের হয়ে পতিতা পল্লীতে আনাগোনা করেননি। যখনই সুযোগ পেয়েছেন পতিতা মেয়েদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। কাউকে কলেরা থেকে বাঁচিয়ে তুলেছেন কারোর ওষুধের ব্যবস্থা করেছেন। কার ঘরের চালা ঠিক করে দিয়েছেন কাউকে বা ভাত জুটিয়ে দিয়েছেন আর তাকে শ্রদ্ধার স্থানে বসিয়েছিলেন নিষিদ্ধ পল্লির সব নষ্ট মেয়েরা। তিনি কিন্তু খাতা কলমে লিখে রাখতেন সেইসব পতিতা মেয়েদের ইতিহাস। কে কখন কিভাবে কোথা থেকে নিজেকে দেহ বাবসায় জড়িয়ে ফেলেছেন সেই ইতিহাস লিখে রাখাই ছিলও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অন্যতম কাজ। এভাবেই একটা জাব্দা খাতাই তিনি লিখে রেখেছিলেন ৭০০ পতিতার কাহিনী।

কিন্তু দুর্ভাগ্য এইটাই রেঙ্গুনে থাকাকালীন আগুনে পুড়ে বাড়ি ভস্মীভূত হওয়ার  কারণে সেই মহামূল্যবান খাতাটি চিরকালের জন্য নষ্ট হয়ে যায় । তা নিয়ে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবনে একটা চাপা কষ্ট  ছিল দীর্ঘদিন । তবে তিনি তাঁর সাহিত্যে পতিতা মেয়েদের দিয়েছিলেন অমরত্ব। রূপের পশরা সাজিয়ে দেহের আবেদন নিয়ে পাঠকের সামনে হাজির হয়েছিল তার দেবদাস উপন্যাসের চন্দ্রমুখী চরিত্র কিংবা শ্রীকান্ত উপন্যাসের পিয়ারী বাঈটির চরিত্র অথবা আঁধারের আলো গল্পের বিজলি চরিত্র। 

তাঁর লেখনীতে এইসব  নিষিদ্ধ পল্লির মেয়েদের এমন নিপুনাভবে চিত্রায়ন করেছেন যে পাঠকের কাছে অলক্ষে তারা পতিতা থেকে হয়ে উঠেছিলে সম্পূর্ণ সার্থক নারী চরিত্র । সাহিত্যিক বনফুল শরৎ সাহিত্যের পতিতা প্রবন্ধের ভূমিকাতে যথার্থই বলেছিলেন প্রবন্ধের নাম শরৎ সাহিত্যের পতিতা  না হইয়া শরৎ সাহিত্যের নারী হইলেই অধিকতর শোভন হইত বলিয়া মনে করি। কারণ শরৎ বাবুর পতিতা গুলিতে পতিতা চরিৎ ততটা পরিস্ফুট হয় নাই যতটা হইয়াছে নারী চরিত্র। আর সেই নারী চরিত্রের মূল্যায়ন করে তিনি লিখেছিলেন তাঁর অসামান্য বই ‘নারীর মূল্য’। প্রত্যেকের বিশেষ করে মেয়েদের অবশ্যই পড়া উচিৎ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বই ‘নারীর মূল্য’।

এখন প্রশ্ন হল শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কেন পতিতা পল্লিতে দিনের পর দিন পড়ে থাকতেন? কেন তিনি চরিত্রহীন অপবাদ নিয়ে ওদের সাথে সময় কাটাতেন? দেখুন এইসব প্রশ্নের উত্তর কারোর কাছে সহজসাধ্য নয়। তিনি ছিলেন অনন্য সাধারণ একজন সাহিত্যিক, একজন স্রষ্টা। সৃষ্টিশীল মানুষের মনের হদিস পাওয়া বাস্তবিকই এক দুঃসাধ্য ব্যাপার। তবে একথা অনস্বীকার্য যে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অবচেতন মনে একজন শাশ্বত নারী ছিল তার প্রতি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সহানুভূতি ছিল অপরিসীম। জীবনের বিভিন্ন স্তরে বিশেষ করে নিষিদ্ধ পল্লিতে তিনি সেই নারীকে পরম মমতাই আবিষ্কার করে গেছেন। সত্যিকারের  সাহিত্য সৃষ্টি করতে গিয়ে তিনি কখনো পরের মুখে ঝাল আদৌ খাননি। পরোক্ষ নয় প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার জন্য তিনি দিনের পর দিন ঘুরে বেরিয়েছেন নিষিদ্ধ পল্লিতে। নিষিদ্ধ নারীদের সাথে সময় কাটিয়েছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা । 

আসলে নিষিদ্ধ পল্লির মেয়েরা তার জীবনে ছড়িয়ে দিয়েছিল অন্য এক ভুবনের বহুমাত্রিক রং। পতিতাদের মধ্যে এক শাশ্বত নারীকে তিনি যেমন ভালবেসেছিলেন বিনিময়ে সীমাহীন কলঙ্ক কিনেছিলেন। দুঃখের ভার বহন করেছিলেন সারা জীবন। 

গল্পসল্প আড্ডা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

spot_img

সম্পর্কিত নিবন্ধ

জুতা (ছোট গল্প)- আফিন্দী

জুতাবিদ্যুৎ’এর গলার তেজে ফাঁকা মেসরুম গমগম করে উঠলো, “ভাই, তুমি যাবে পাঁচ ভাইয়ে? খিদেয় আমার জান যায়! খালা...

মৃত্যু পরবর্তী জগতের অভিজ্ঞতা 

মৃত্যু পরবর্তী জগতের অভিজ্ঞতা  মৃত্যু পরবর্তী জীবনের অভিজ্ঞতা কেমন? মানুষ তার অনিশ্চিত জীবনে শুধু একটি বিষয়ের নিশ্চয়তা নিয়ে জন্মেছে।...

বুক রিভিউ- হুমায়ূন আহমেদের ‘মেঘ বলেছে যাব যাব’

বুক রিভিউ- হুমায়ূন আহমেদের 'মেঘ বলেছে যাব যাব' বুক রিভিউ- হুমায়ূন আহমেদের 'মেঘ বলেছে যাব যাব'।বইয়ের নাম:মেঘ বলেছে যাব...

ডা. স্যাটান: সিরিয়াল কিলার ডা. মার্সেল পেটিওটের ভয়ংকর গল্প!

তাকে আখ্যা দেয়া হয়েছিল ডা. স্যাটান বলে। তিনি একই সাথে একজন সৈনিক, ডাক্তার, মেয়র, ভয়ঙ্কর অপরাধী এবং সিরিয়াল...