কেন ৬০ লক্ষ ইহুদি হত্যা করেছিলেন হিটলার?
এখন ২০২৩ সাল, এই সময়ে এসেও হিটলার এবং ইহুদি নিয়ে আলোচনা কেন? কারণ সময় বদলে গেলেও এসব নিয়ে আলোচনা যুগ যুগ ধরে চলতে থাকবে।
সময়ের পরিক্রমা পার হয়ে আমরা এসেছি আধুনিক সমাজের অনেকটা পথ। কিন্তু আধুনিক সমাজের এই রুপ, এমন সাজানো গোছানো মানব সভ্যতা, দেশে দেশে এমন শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক-এসব কি পৃথিবী সৃষ্টির প্রথম থেকেই ছিলো?
না, তা ছিলো না!
আদিম মানুষ থেকে শুরু হয়ে প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ এবং আজকের আধুনিক যুগ পর্যায়ে আসতে যুগে যুগে সংঘটিত হয়েছে অনেক ইতিহাস বিখ্যাত এবং কুখ্যাত সব ঘটনা ৷ কালের ভয়াবহতা অথবা কালের সুসময় দুটোই ভোগ করেছিলেন যুগে যুগে মানুষেরা।
প্রিয় পাঠক, ইতিহাস কখনো কাউকে ক্ষমা করেনা, আবার কখনো কারো অবদান অস্বীকার ও করার সুযোগ দেয় না! আর তাই বিশেষ করে দেশ চালাতে গিয়ে যুগে যুগে এসেছিলেন যত রাজা মহারাজা মহীরথী অথবা রাষ্ট্রপ্রধানেরা-তাদের কীর্তিগুলোও ইতিহাস বহন করে চলেছে সাদা খাতায় কালো কলমের কালির লেখার মতন।
ভাবছেন আজ আবার কি হলো? কেন এমন ফিলোসোফি আওরাচ্ছি?
আজ এমন একজন রাস্ট্রপ্রধানের কুকীর্তির কথা বলবো, যা শুধু একটা দেশ বা জাতি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকেনি। অন্য সকল কুখ্যাত হত্যাযজ্ঞকে হার মানিয়ে যায় যার নির্মমতা।
আজ বলবো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসী বাহিনীর প্রধান হিটলারের সেই কুখ্যাত,নির্মম, বর্বর হত্যাযজ্ঞের কথা।
হিটলার! প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সাধারণ এক সেনা থেকে যে একাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ হয়েছিলেন। সেই হিটলার ক্ষমতার অপব্যবহার করে হত্যা করেছিলেন ৬০ লক্ষ ইহুদিদের।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে পার হয়ে গেছে ১০০ বছরের ও বেশি। এখনো সাধারণ জনগণের মনে অনেক প্রশ্ন জাগে, কেন হিটলার এভাবে ৬০ লক্ষ ইহুদিকে হত্যা করেছিলেন?
তো, মুল পর্ব আরম্ভ করার আগে একটা কথা না বললেই নয়। হিটলার কেন ৬০ লক্ষ ইহুদিকে নির্মম ভাবে হত্যা করেছিল তা জানার জন্য আমাদেরকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ও আগে কিছুটা ফ্ল্যাশব্যাক এ যেতে হবে! পাশাপাশি কে ছিলেন এই হিটলার, কিভাবে সে এত বড় যুদ্ধের সরাসরি মুল হোতা হয়েছিলেন সেসব ও কিছুটা জানার চেষ্টা করতে হবে।
হিটলার কে ছিলেন?
পুরো নাম এডলফ হিটলার। জন্মগতভাবে ছিলেন অস্ট্রীয় জার্মানির নাগরিক ৷ পরিণত বয়সে হিটলার ছিলেন ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা ৷ তার নেতৃতেই একসময় জার্মানি দুনিয়াতে প্রচন্ড দাপুটে এক দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ৷ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হিটলার ছিলেন সামান্য এক সৈনিক।
পরবর্তীকালে হিটলার জাতীয়তাবাদ, ইহুদি নিধন ইত্যাদি জিনিসের উপরে ফোকাস করে সমাজে ইহুদি এবং সমাজতন্ত্রের বিরোধী ভাব ছড়াতে থাকেন । অবাক হলেও সত্যি শুধুমাত্র বিভিন্ন সভা সেমিনারে মোহনীয় সব জাতিবিদ্বেষী বক্তব্য দিতে দিতেই একসময় তিনি ফ্যাসিবাদ এবং প্রচন্ড স্বৈরাচারী এক রাষ্ট্রনায়কে পরিণত হন।
এক পর্যায়ে নাৎসী বাহিনীর কর্তৃক ক্ষমতায় আসার পরেই হিটলার অনেক বিরোধী দলের লোক হত্যা করে। পুরো দেশের অর্থনৈতিক অবস্থান ঢালাওভাবে নতুন করে সাজায়, এবং সামরিক বাহিনীকে নতুন নতুন অস্ত্রে সজ্জিত করে।
ক্ষমতার যাওয়ার পরে, হিটলার চালু করেন এক অন্যরকম নীতি, যেটা ”লেবেনস্রাউম দখল নীতি” নামেও পরিচিত । এই নীতি অনুযায়ী হিটলার প্রথম পোল্যান্ড দখল করেন যার ফলশ্রুতিতে ফ্রান্স ও ব্রিটেন হিটলারের বিরুদ্ধে তথা জার্মানির বিরুদ্ধে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঘোষণা দেয়।
হিটলার কেন ইহুদিদের প্রচন্ড ঘৃণা করতেন?
হিটলার কেন ইহুদিদের প্রচন্ড ঘৃণা করতেন তা আসলে সুনিপুণভাবে কেউই সেভাবে ব্যাখা দিতে পারেনি ৷ তবে বিভিন্ন সময়ে হিটলারকে নিয়ে গবেষণা করা ব্যাক্তিরা ইহুদিদের বিরুদ্ধে হিটলারের এরকম ঘৃণার কারণ হিসেবে যা উল্লেখ করেছিলেন, তা হলো-
প্রথমত, হিটলার ছোট বেলায় ছবি আঁকতে খুব পছন্দ করতেন। হিটলারের আঁকিয়ের ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। তো হিটলার সেই ছোট বেলাতেই ভর্তি হতে চেয়েছিলেন আর্ট স্কুলে। এবং তিনি ভর্তি হয়েছিলেন ভিয়েনার একটা বিখ্যাত আর্ট স্কুলে। আঁকাউকি নিয়ে হিটলারের স্বপ্ন ছিলো অনেক বেশী- সম্ভবত তিনি চেয়েছিলেন আর্ট নিয়ে ক্যারিয়ার গড়তে।
কিন্তু হিটলারের স্বপ্নের ছন্দপতন হয় শৈশবেই। ভিয়েনার আর্ট স্কুলে থাকা সংখ্যাগরিষ্ঠ ইহুদী ছাত্ররা সবার আগে হিটলারের স্বপ্ন পূরণের বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তাদের ক্রমাগত তিরস্কার সাথে ইহুদি রেক্টরের অসহযোগী মনোভাবের জন্য এক পর্যায়ে আর্ট না শিখেই ওই স্কুল থেকে বের হয়ে যেতে বাধ্য হন হিটলার। ধারণা করা হয় তখন থেকেই হিটলারের ইত্যাদি বিদ্বেষী ভাব এর সুচনা হয়।
হিটলারের জীবনে দ্বিতীয় ধাক্কা পান, সেটাও ইহুদিদের সজৌন্যে। হিটলারের মা ক্লারার মৃত্যু হয় এক ইহুদী ডাক্তারের তত্বাবধানে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায়। হিটলার তার মায়ের মৃত্যের জন্যও সবসময়ই দায়ী করতেন ওই ইহুদী ডাক্তারকে। হিটলারের মতে, ওই ইহুদী ডাক্তার গাফিলতি করে, চিকিৎসায় অবহেলা করে তার মাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিলো ৷ সেখান থেকেও হিটলার ইহুদিদের চরম ঘৃনা করতে থাকেন।
ইতিহাসবিদেরা এটা নিশ্চিত করেছেন যে, ছোট থেকেই হিটলার ইহুদিদের উপর বেজায় ক্ষেপে ছিলেন। এমনকি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরজয়ের জন্য ও ইহুদিদের দায়ি করতেন হিটলার৷ হিটলার তার বিভিন্ন বক্তৃতা সভা সেমিনারে এটাই বুঝাতে চাইতেন,জার্মানির রাজতন্ত্র বিলুপ্ত হওয়া,প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির শোচনীয় হার এবং জার্মানির তৎকালীন পুরো সামাজিক এবং রাজনৈতিক বিষাক্ত অবস্থার জন্য একমাত্র ইহুদিরা দায়ি। আর তারই ফলশ্রুতিতে প্রথমে হিটলার জার্মানির সভ্য সমাজ থেকে ইহুদিদের বের করেন এবং দ্বিতীয় ধাপে হত্যা করতে থাকেন সকল ইহুদিদের।
এখানে প্রশ্ন একটা আসে, ৬০ লক্ষ ইহুদি কে যে হিটলার এভাবে জঘন্যতম অত্যাচার করে মারলেন এর দায় কি একা শুধু হিটলারের? তৎকালীন জার্মানির কি কোন সমর্থন ছিল না হিটলারের প্রতি? যদি তৎকালীন জার্মানির জনগণের হিটলারের প্রতি সমর্থন নাই থাকে তবে কিভাবে হিটলার একাই এতো বড় জাতিগত বিদ্বেষ সৃষ্টি করতে পারলেন? তাছাড়া এখনো বেশিরভাগ জার্মানির নাগরিকের কাছেই হিরো হয়ে আছেন হিটলার। এমন কুখ্যাত কাজ কিরেও কিভাবে মানুষের শ্রদ্ধার পাত্র হতে পারে কোন মানুষ?
যাই হোক, আসলে হিটলার কেন ৬০ লক্ষ ইহুদি কে এভাবে হত্যা করলেন, প্রয়োজনটা কি হিটলারের স্বার্থ ছিল না কী জার্মানির জনগণের স্বার্থ এখানে জড়িত ছিলো এটা সুস্পষ্ট ভাবে কোন ইতিহাসবিদই আজ পর্যন্ত ব্যাখা দিতে পারেনি।
হিটলার এবং হিটলারের সৈন্যরা একদিনে এবং এক উপায়ে মারেনি এসব ইহুদিদের। যারা হলোকাস্ট নিয়ে ইতিমধ্যেই জানেন, তারা জানেন কিভাবে হিটলারের নাৎসী বাহিনি ইহুদিদের নিরপরাধ ৬০ লক্ষ মানুষকে পোকামাকড়ের মত বিভিন্ন উপায়ে হত্য করেছিল।
হিটলারের বাহিনী প্রথমে সংখ্যালঘু ইহুদিদের ধরে নিয়ে একটা বস্তিতে আটকে রাখতো। এই বস্তিতে যেসব ইহুদীর থাকতো-বস্তির নোংরা পরিবেশ, ঠিকমতো খাবার না পাওয়া, নাৎসী বাহিনীর দ্বারা প্রচন্ড অত্যাচার-ইত্যাদি কারনে এই বস্তির লোকগুলো অল্প সময়েই রোগে ভুগে মারা যেতো৷
আবার কোন কোন ইহুদিকে ছোট কাভার্ড ভ্যানে করে নিয়ে যাওয়া হতো বিষাক্ত গ্যাস চেম্বারে। নির্মমভাবে বিষাক্ত গ্যাস স্প্রে করে এদের নিমিষেই মেরে ফেলা হতো।
ইহুদী বন্দীদের যখন মালবাহী ট্রেনে গাদাগাদি করে নিয়ে যাওয়া হতো অন্য কোন শিবির অথবা গ্যাস ক্যাম্পের কাছে- রাস্তাতেই প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে যেতো অনেকে। টানা নির্যাতনের ধকল সইতে না পেরে, অভুক্ত,পিপাসার্ত অবস্থায় থেকে রাস্তাতেই মারা যেতো অনেক ইহুদি।
আর যাদের কে যুদ্ধবন্দী হিসেবে ধরা হতো। সেই ইহুদিদের অবস্থা হতো আরো মারাত্মক! তাদের পাঠিয়ে দেয়া হতো বিভিন্ন রাজনৈতিক শিবিরে। দিনের পর দিন প্রায় অভুক্ত রেখে, নিয়মিত কঠোর পরিশ্রমের মধ্যে রেখে, এই যুদ্ধ বন্দিদের তিলে তিলে শেষ করা হতো।
হিটলারের হলোকাস্টের বর্বরোচিত হত্যা হামলা থেকে রেহাই পায়নি আবাল, বৃদ্ধ, বনিতা, নারী পুরুষ। এমনকি প্রতিবন্ধী, পাগল থেকে শুরু করে এমন কোন ইহুদি নেই, যারা হিটলারের বাহিনীর সামনে পরেছে এবং বেঁচে ফিরেছে।
হিটলারের বাহিনির মিশন ছিলো সকল ইহুদিদের সমুলে উৎপাটন করা, পাশাপাশি দুনিয়া জুড়ে নাৎসী তথা জার্মানি বাহিনীর কর্তৃত্ব জাড়ি করা।
হিটলার সরকারিভাবে আইন করে জার্মানের ভদ্র,সভ্য সোসাইটি থেকে সকল ইহুদিদের দূরে রাখার ব্যবস্থা করেন। সভ্য সমাজ থেকে দূরে, নিজের কষ্ট করা উপার্জিত টাকা পয়সা, বাড়িঘড়, ব্যাবসা বানিজ্য সব ফেলে-ইহুদিরা নিজেদের জীবন বাঁচাতে বাধ্য হতেন নির্বাসিত এবং করুন এক জীবনযাপন করতে। তবুও শেষ রক্ষা হতোনা তাদের।
পরিশেষে,
দেশের অথবা জাতির ভালোর জন্য একজন রাষ্ট্রনায়কের অনেক কিছু করার ক্ষমতা থাকে, ইন ফ্যাক্ট অনেক কিছু করতেও হয়।
হিটলার ও কি তাহলে জার্মানির কোন অন্ত:র্নিহিত স্বার্থ হাসিলের জন্যই নিজেকে এভাবে ইতিহাস কুখ্যাত রাষ্ট্রনায়কের ভুমিকায় রেখে গিয়েছে?
হিটলার ছিলেন একজন উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন দানবীয় দেশপ্রধান। তিনি ব্যাক্তি স্বার্থ আর দেশের স্বার্থ মিলিয়ে এমন এক নারকীয় হত্যাযজ্ঞ এই দুনিয়াতে করে গেছেন, ইতিহাসে যার কোন ক্ষমা কোনদিন হবে না!
ধন্যবাদ সবাইকে।