নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর রহস্যময় অন্তর্ধান!
১৯৪৫ সালে জাপানের তাইহুকু শহরের সেই প্লেন দুর্ঘটনা!
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু বলেছিলেন,
“সবাই বলে রাজনীতি নোংরা-আবর্জনা। কিন্তু ঐসব মানবসন্তান ঐ নোংরা পরিষ্কার করতে আসে না। তাই নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে তাদের এই বড় বড় কথা মানায় না। আমি
রাজনীতির এই জঞ্জাল পরিষ্কার করতে এসেছি।”
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু! ভারত উপমহাদেশের এক মহাবরেণ্য নেতা! ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর ভয়াল থাবা থেকে পরাধীন ভারতবর্ষকে স্বাধীনতার দরজায় নিয়ে যাওয়ার পেছনে যে মানুষগুলোর ভুমিকা অনন্য-নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু তাদের মধ্যে অন্যতম একজন।
কিন্তু, ভারত উপমহাদেশের মহান এই নেতার মৃত্যু নিয়ে রয়েছে অনেক রহস্যের ঘনঘটা! কথায় আছে- ”The Truth is strenger than fiction!” নেতাজির অন্তর্ধান বিষয়ে বিস্তারিত ঘাটতে গিয়ে বারবার ইংরেজি এই লাইনটাই মনে আসছিল! সেই ১৯৪৫ সালে নেতাজি হুট করে নেই হয়ে গেলেন! আর এরপর থেকেই কী এক রহস্যের ধূম্রজাল তৈরি হয়েছে তাঁর এভাবে নেই হয়ে যাওয়াকে কেন্দ্র করে! আসলে কী হয়েছিল নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর? তিনি কি সত্যিই মারা গিয়েছিলেন ওইদিন? মারা যদি গিয়েই থাকবেন, তাহলে তাঁর পক্ষে শক্তিশালী প্রমাণই বা নেই কেন!
যাই হোক, যদিও সরকারি পর্যায়ে দাবি করা হয়েছিল ১৯৪৫ সালে জাপানের তাইহুকু শহরে এক প্ল্যান ক্রাশে মারা যান মহান সুভাষচন্দ্র বসু, কিন্তু আসলে এই ঘটনার পক্ষে-বিপক্ষে অনেক যুক্তি প্রমাণও দাঁড় করা হয়েছে বিভিন্ন ব্যক্তিগত এবং সাংগঠনিক পর্যায় থেকে।
যাই হোক মহান এই নেতার রাজনৈতিক অথবা সংগ্রামী ইতিহাস নিয়ে আজকে আর আমরা আলোচনায় যাবো না।বিদেশী ঔপনিবেশিক শক্তিকে বিনস্ট করার জন্য নেতাজি যেভাবে এক সংগ্রামী দলের প্রধান বিপ্লবী নেতা হলেন, সেই ইতিহাস আলোচনা করবো অন্য কোন দিন। আজকে আমরা আলোচনা করবো নেতাজির অন্তর্ধানের বিষয় নিয়ে-
১৯৪৫ সালে সুভাষচন্দ্র বসু আসলেই কি মারা গিয়েছিলেন?
কথিত আছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ সময়ে জাপানে যান নেতাজি এবং সেখানেই তাইহোকু বিমানবন্দরে ১৯৪৫ সালের ১৮ ই আগস্ট বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান।
ততকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রীসহ অনেক রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ বলেছিলেন যে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু এই প্লেন দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। এমনকি ভারতের ইতিহাস বইয়েও এটাই লেখা রয়েছে যে সুভাষচন্দ্র ১৯৪৫ সালে প্লেন দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন।
এমনকি আপনি এখনি উইকিপিডিয়াতে সার্চ করে আসুন, দেখবেন সেখানে লিখা রয়েছে-
“ভারতীয় জাতীয়তাবাদী নেতা সুভাষচন্দ্র বসুর ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ১৮ অগস্ট জাপানি–অধিকৃত ফরমোজা দ্বীপে (বর্তমান তাইওয়ান) তাঁর অধিক যাত্রীবাহিত বিমান দুর্ঘটনায় মারাত্মকভাবে পুড়ে গিয়ে দেহাবসান হয়।“ (www.wikipedia.com)
ভারত সরকারের স্বীকৃতি যদিও এইভাবেই নেতাজির মারা যাওয়াকে দেওয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায় থেকে নেতাজির মারা যাওয়া বিষয়ক ৩ টি তত্ত্বকে আমরা রিসার্চ করে পেয়েছি।
নাম্বার এক:
নেতাজি জাপানের তাইহুকু বিমানবন্দরে বিমান দুর্ঘটনায় মারা গেছেন।
নাম্বার দুই:
নেতাজিকে রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক গ্রেফতার করা হয়েছে,অত:পর রাশিয়ার স্তালিনের একটি কারাগারে রেখে অমানবিক নির্যাতনের মাধ্যমে মেরে ফেলা হয়েছে।
নাম্বার তিন:
নেতাজি আবার সন্ন্যাসী হয়ে ভারতে ফিরে এসেছিলেন এবং অনেকদিন বেঁচে ছিলেন।
কেন নেতাজির অন্তর্ধান নিয়ে এমন রহস্য:
এর কারণ আসলে অনেক। প্রথমেই যদি বলি ভারত সরকার কর্তৃক স্বীকৃত নেতাজির প্লেন দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার খবর নিয়ে। তাহলে এই বিমান ক্রাশ তত্ত্বের বিপক্ষের কথা গুলো দেখি-
ভারত স্বাধীন হয় ১৯৪৭ সালে। ভারত স্বাধীন হবার পরে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু এক সংবাদ সম্মেলনে করেন। সেখানে শিকাগো ট্রিবিউনের এক সাংবাদিক এক বিস্ফোরক তথ্য দেন। তিনি জানান তার একজন কলিগ ১৯৪৫ সালের ২১ আগস্ট নেতাজিকে দেখতে পান সায়গন-এ।
বলা বাহুল্য নেতাজি মারা যাওয়ার পর থেকেই এ ধরনের বহু দাবী বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পর্যায় থেকে আসতে থাকে।
আর এসব দাবীর ভিত্তিতেই নেহেরু সরকার নেতাজির মৃত্যু রহস্য খোলাসা করার জন্য গঠন করেন শাহনেওয়াজ কমিটি৷ এই কমিটির একজন সদস্য ছিলেন নেতাজির বড় ভাই সুরেশ চন্দ্র বসু৷ এই কমিশনের তদন্ত শেষে তারা এটাই প্রতিবেদন দাখিল করে নেতাজি তাইহুকু বিমানবন্দরে বিমান দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। তদন্তের এই রিপোর্ট এর সাথে দ্বিমত পোষণ করেন নেতাজির বড় ভাই এবং তিনি তদন্ত রিপোর্ট এ স্বাক্ষরও করেননি৷ বরং তিনি একেবারে নিরপেক্ষ এক তদন্ত দাবী করেন আরেক বিচারক ড. রাধাবিনোদ পালের অধীনে।
এরপর ১৯৭০ সালে ইন্দিরা গান্ধী গঠন করেন খোসলা কমিটি৷ এ কমিটি ও শাহনেওয়াজ কমিটির মত একই তদন্ত রিপোর্ট দাখিল করে।
ইন্দিরা গান্ধীর পরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন বিখ্যাত মোরারাজি দেশাই৷ ক্ষমতায় আসার পরেই নেতাজি প্রসঙ্গে আগের দুই সরকারের দুই কমিটির তদন্ত রিপোর্ট তিনি নাকোচ করে দেন।এবং সরাসরি তিনি জানান যে নেতাজির মৃত্যু সংক্রান্ত তাইহুকু বিমান দুর্ঘটনার তত্ত্ব মিথ্যা প্রমাণ করার যথেষ্ট তথ্যাদি তাঁর সরকারের কাছে রয়েছে।
কিন্তু এরপর উনি হঠাৎ করেই নেতাজির মারা যাওয়া প্রসঙ্গ চেপে যান। অনেক বছর পরে আবার ১৯৯৯ সালে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর অন্তর্ধান বিষয় নিয়ে জট খোলার জন্য নতুন কমিশন গঠন করা হয় অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মনোজ কুমার মুখার্জির অধীনে।
মুখার্জি কমিশনের তদন্তে চমক আসে তখনি, যখন তাইওয়ান সরকার জানায়-
”১৯৪৫ সালের ১৮ আগস্ট তো দুরের কথা, সারা বছরে কেবল তাইহুকুতে নয়, পুরো তাইওয়ানে কোন উড়োজাহাজ ক্রাশ হয়নি!”
১৯৪৫ সালের আগস্টের ১৮ তারিখে তাইওয়ানের কোন হাসপাতালের কোন লগবুকে বিমান দুর্ঘটনায় আহত কারো চিকিৎসার কোন তথ্য পাওয়া যায়নি৷ এমনকি নেতাজিকে বহন করা বোমারু বিমানে অন্য যে সকল সঙ্গীদের হতাহত ওয়ার কথা বলা হয়েছে তাদের ও কোন তথ্য পাওয়া যায়নি।
যারা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর অন্তর্ধান এর দ্বিতীয় তত্ত্ব বিশ্বাস করেন,অর্থাৎ নেতাজি রাশিয়ার কারাগারে মারা গেছেন, তারাও কিন্তু নেতাজির মাঞ্চুরিয়া হয়ে রাশিয়া যাবার প্রমাণ দেখাতে পারলেও মারা যাবার প্রমাণ দেখাতে পারেনি৷ বরং ১৯৬১ সালে ভারতের এক ইঞ্জিনিয়ার, অর্ধেন্দু সরকার মস্কোয় ভারতীয় দূতাবাসে দেখা করে জানান তার প্রতিষ্ঠানের একজন জার্মান ইঞ্জিনিয়ার নেতাজিকে দেখেছেন স্ত্যালিনের গুলাগ নামক এলাকায়। ভদ্রলোক এ ব্যাপারে মুখার্জি কমিশনের কাছে সরাসরি সাক্ষ্যও দেন।
এরপরে নেতাজিকে নিয়ে গবেষণাকারী পুরবী রায় রাশিয়ায় যান৷ সেখানে এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রমাণ জোগাড় করেন যেসব দিয়ে প্রমাণ হয় ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত নেতাজি রাশিয়ায় অবস্থান করছিলেন। পুরবী রায় তার সকল নথি সংসদ সদস্য চিত্ত বসুর কাছে সোপর্দ করেন। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি চিত্ত বসু এসব গুরুত্বপূর্ণ নথি নিয়ে দিল্লিতে যাওয়ার সময় রহস্যজনকভাবে নিহত হন। আর নেতাজির সব নথিগুলো সেখান থেকে হাওয়া হয়ে যায়।
নেতাজিকে নিয়ে তিন নাম্বার তত্ত্ব হলো পঞ্চাশের দশকে সন্ন্যাসী হয়ে নেতাজির ফিরে আসা।এই সন্ন্যাসী ভক্তদের মাঝে মহাকাল, ভগবানজি এসব নামে প্রচলিত ছিলেন। ১৯৮৫ সালের সেপ্টেম্বরে মারা যান এই সন্ন্যাসী। এই সন্ন্যাসীর জীবতদ্দশাতেও অনেকে দাবী করেন প্রকৃতপক্ষে তিনিই নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু। ১৯৮৬ সালে সুভাষ চন্দ্র বসুর ভাইজি ললিতা বসু নেতাজির রামভবনে যান, এবং বিভিন্ন ব্যবহৃত জিনিসপত্র, চিঠিপত্র, অন্যান্য নথি দেখে নিশ্চিত হোন যে ইনিই নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু।মুখার্জি কমিশনের দাবীর ভিত্তিতে এই সন্ন্যাসীর ঘর থেকে পাওয়া দাঁত নিয়ে ডিএনএ ম্যাচিং টেস্ট করা হয় কলকাতার সরকারি ল্যাবে, যেখানে রিপোর্ট আসে দাঁতের ডিএনএ ম্যাচিং হয়নি নেতাজির আত্মীয়দের ব্লাড স্যাম্পলের সাথে।অদ্ভুত বিষয় হলো, আসলেই এই ডিএনএ রিপোর্ট সত্যি না মিথ্যা সেটাও কেউ প্রমাণ করতে পারেনি।
নেতাজির মৃত্যুর খবর কীভাবে নিয়েছিলেন তার সহধর্মিণী এমিলি শেঙ্কেল?
নেতাজির মৃত্যু সংক্রান্ত প্রায় ৬৪টি নথি আছে ভারত সরকারের পুলিশের কাছে। এর মধ্যে একটি নথি হচ্ছে নেতাজির স্ত্রী এমিলি শেন্কেলের নিজ হাতে লিখা একটি চিঠি।জানা যায় এমিলি’র লেখা ওই চিঠি নেতাজির বড় ভাই-শরৎচন্দ্র বসুকে উদ্দেশ্য করে লেখা৷ চিঠিটি সংরক্ষণ করা হয়েছে প্রায় ছিড়ে যাওয়া অবস্থায়।
সমস্যা হচ্ছে চিঠিটি পুরোপুরি পাওয়া যায়নি। এর গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো ছেঁড়া রয়েছে। অনেকেই মনে করেন এমিলির লেখা চিঠির ছেঁড়া অংশেই রয়েছে নেতাজির এভাবে অন্তর্ধান হওয়ার রহস্য।
যেমন-
”এমিলি শেঙ্কেল কোয়াইট” — এটা লিখার পরে চিঠির অংশ টুকু ছেড়া। আবার ছেঁড়া কিছু অংশের পরে লেখা ”লি বিলিভস দ্যাট সুভাষ ইজ ডেড–”
এর পরে আবার ছেঁড়া।
তবে এই লেখার অংশটুকু পর্যালোচনা করলে কিন্তু এটাই মনে হয় এমিলি বিশ্বাস করতেন নেতাজি মারা গেছেন। নেতাজি মারা যাওয়ার পরেও এমিলি কিন্তু আরো অনেক বছর জীবিত ছিলেন। জীবিত থাকা অবস্থায় এমিলি কখনো কোথাও বলে যাননি যে তিনি বিশ্বাস করেননি নেতাজি মারা গেছেন। বরং এমিলির চিঠির সূত্র ধরে এটাই বোঝা যায়, এমিলি নিজেকে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর বিধবা স্ত্রী হিসেবেই মেনে নিয়েছিলেন।
তাছাড়া খুব সহজ হিসেব, নেতাজি বেঁচে থাকলে উনার স্ত্রী-কন্যার খবর এত বছরে একবারও নিতেন না, এতোটাই অবিবেচক নিশ্চয়ই ভারত উপমহাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের এই নক্ষত্র ছিলেন না!
Sources:
(bn.wikipedia.org, 2023)
(www.bbc.com, 2023)