মৃত্যু পরবর্তী জগতের অভিজ্ঞতা
মৃত্যু পরবর্তী জীবনের অভিজ্ঞতা কেমন? মানুষ তার অনিশ্চিত জীবনে শুধু একটি বিষয়ের নিশ্চয়তা নিয়ে জন্মেছে। আর তা হলো মৃত্যু। তাহলে মৃত্যুর পর কী আছে? মৃত্যু কি মানুষের সকল অনুভূতি এবং অভিজ্ঞতার শেষ? নাকি এরপরও ‘আরও কিছু’ রয়েছে?
এই ‘আরও কিছুর’ অর্থ হলো মানুষের ইন্দ্রিয়জাত অভিজ্ঞতা। যেমন, মৃত্যুর পর জান্নাতের সুখ অথবা জাহান্নামের কষ্ট, পুনরুত্থান, পুনর্জন্ম বা এর মাঝামাঝি সময়। কেমন হতে পারে এ সময়? আমরা ধর্মীয় গ্রন্থগুলো থেকে অবশ্য এর কিছু বিবরণ পাই যেগুলো আমাদের মৃত্যু পরবর্তী জীবন সম্পর্কে ধারণা দেয়। তবে যদি এমন হতো যে যারা মরে গিয়েছে তাদের কাছ থেকে শুনতে পাই মৃত্যুর পরের সময় সম্পর্কে!
হ্যাঁ, এমনটাও সম্ভব। এমন অনেক মানুষ আছেন যারা মরে গিয়েছিলেন। তবে তা কিছু সময়ের জন্য এবং পরে বেঁচে ফিরেছেন। এমন অভিজ্ঞতাকে বলা হয় Near Death Experience বা প্রান্তিক মৃত্যু অভিজ্ঞতা। আরও এক ধরনের অভিজ্ঞতা আছে তাকে বলা হয় Shared Death Experience বা মৃত্যু পথযাত্রী ব্যক্তির অভিজ্ঞতা নিজে অনুভব করা।
তাহলে জেনে নেওয়া যাক এমন কিছু ব্যক্তির অভিজ্ঞতা বর্ণণা।
Don Piper এর মৃত্যু পরবর্তী নব্বই মিনিটঃ
ডন পাইপার, একজন ব্যপটিস্ট চার্চের মন্ত্রী। একদিন সম্মেলন থেকে ফেরার পথে একটি ১৮ চাকার ট্রাক তার গাড়িকে ধাক্কা দেয়। দুর্ঘটনার প্রতিবেদনে বলা হয়, ট্রাকটি ১১০ মাইল বেগে ডন পাইপারের গাড়িকে ধাক্কা দেয়। ঘটনাস্থল পরিদর্শনকারী মেডিকেল টিম পরীক্ষা করে জানান, তার কোন পালস খুঁজে পাওয়া যায়নি এবং দুর্ঘটনার কারণে ডন পাইপারের তাৎক্ষণিকভাবে মৃত্যু হয়েছে বলে ঘোষণা দেন।
কিন্তু ডন পাইপার ৯০ মিনিট পর জীবিত হয়ে ওঠেন। তার ভাষ্যমতে, এই সময়টুকুতে তিনি স্বর্গে ছিলেন।
সেখানে তিনি চারপাশে অবাক হয়ে সব দেখছিলেন আর অনেক আনন্দিত হচ্ছিলেন। বিশাল মানুষের ভিড় তাকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছিলো। সেখানে প্রত্যেক ব্যক্তি হাসছিল, চিৎকার করছিল এবং ঈশ্বরের প্রশংসা করছিল।
এছাড়াও তিনি সেখানে তার পরিচিত মৃত্ ব্যক্তিদের সাথে দেখা করেন, কথা বলেন। সেখানে তিনি অনেক ধরনের সংগীত শুনতে পান। শুধু যে মানুষের কণ্ঠ সংগীত ছিলো তাই নয় তার মনে আছে সেখানে যন্ত্র সংগীতের সুরও শুনতে পেয়েছেন।
এছাড়াও তিনি ফেরেশতাদের ডানা ঝাপটানোর শব্দ শুনেছিলেন তবে তাঁদের দেখতে পাননি। তিনি ঈশ্বরকেও দেখতে পাননি। তবে তিনি অনুভব করেছিলেন স্বর্গের মূল ফটকের ভেতরে ঈশ্বর উপস্থিত ছিলেন। সেখান থেকে অনেক উজ্জ্বল আলো ভেসে আসছিলো।
Bubba Bay এর পরলোক দর্শনঃ
Bubba Bay একজন সাধারণ চাকুরিজীবী। তাঁর দুই সন্তান কিশোর জেমস এবং শিশু রবার্ট এর অকাল মৃত্যু হয় এবং স্ত্রীর সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায়। এসব ঘটনার কারণে খুব ভেঙে পড়েন। খুব একটা ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন না তিনি। তবে তাঁর মনে বার বার প্রশ্ন জাগতো, যদি ঈশ্বর থেকেই থাকেন, তিনি কেন পৃথিবীর সব কষ্ট, হিংসা, বিদ্বেষ দূর করে দিচ্ছেন না?
এসবই ভাবতে ভাবতে একদিন রাতে তিনি হাটতে বের হন। হাঁটার সময়, Bubba পা পিছলে গিয়ে ১৪ ফুট কংক্রিটের কালভার্টের নিচে পড়ে যান। তার মাথার খুলি এবং কাঁধের ব্লেডে ফেটে যায়। এছাড়াও পাঁজরের ১১ টি হাড় এবং ১০টি কশেরুকা ভেঙে যায়। তিনি একেবারে অসহ্য যন্ত্রণার মধ্যে ছিলেন।
ঠিক সে সময় একটি আলো দেখতে পান তিনি। সে আলো তাঁর চারপাশকে আলোকিত করে তুলছে এবং তিনি সব কিছু স্পষ্ট দেখতে পেতে শুরু করছেন। আলোর ভেতর থেকে একজন লোক হেঁটে হেঁটে এগিয়ে আসছে তাঁর কাছে। লোকটার চেহারা বেশ দয়ালুগোছের এবং মুখে লম্বা দাড়ি ছিল।
লোকটির আগমনের সাথে সাথে Bubba’র সকল ব্যথা কমে গেল। লোকটি কিন্তু একা ছিল না। সঙ্গে ছিল একটি কিশোর এবং একটি শিশু। জেমস আর রবার্ট! তাঁর পুত্ররা! কিভাবে? এটা কিভাবে সম্ভব হল?
উত্তরের জন্য মরিয়া হয়ে উঠে Bubba। তার চারপাশের বাতাস তখন উন্মত্ততায় চকচক করছে।
বাতাস শান্ত হয়ে গেল। জঙ্গল একেবারে স্থির হয়ে গেল। Bubba চিৎকার করে উঠলো, “আমি তোমার কাছে আসতে প্রস্তুত, ঈশ্বর!” কিন্তু তাঁর ভিতর থেকে একটা কন্ঠ কথা বলে উঠল। “এটা তোমার সময় নয়, Bubba।’’
কিছুক্ষণ পর আলো ম্লান হতে থাকে। সেই দাড়িওয়ালা লোকটা এবং তাঁর ছেলেরাও চলে গেলো। অন্ধকার ফিরে এল এবং তাঁর সাথে যন্ত্রণাদায়ক ব্যথা। তারপর Bubba Bay নিজেকে হাসপাতালে আবিষ্কার করেন।
মৃত্যু যন্ত্রণার অংশীদারঃ
ডব্লিউ ইলিয়াম পিটার একজন স্বেচ্ছাসেবক। তিনি রন নামের একজন অসুস্থ ব্যক্তির সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। রন একজন প্রাক্তন মার্চেন্ট মেরিন ছিলেন। তিনি পেটের ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন।
পিটার দিনে তিন ঘন্টা পর্যন্ত রনের সেবায় কাটাতেন। রনের সাথে কথা বলতেন এবং তাকে এডভ্যাঞ্চার গল্প পড়ে শোনাতেন। খুব অল্প দিনই রনের পরিবারের মানুষ বা বন্ধুরা রনকে দেখতে আসতেন।
পিটার একদিন দুপুরে রনের পাশে বসেছিল। দুর্বল রন তখন আধঘুমে। পিটার তাকে জ্যাক লন্ডনের “কল অফ দ্য ওয়াইল্ড” থেকে গল্প পড়ে শোনাচ্ছিলেন। কিন্তু পিটার বুঝতে পারেনি রন তখন মৃত্যুর সাথে লড়াই করেছিল। এরপরে যা ঘটেছিল, পিটারের ভাষায় তা বর্ণনাতীত ছিল।
পিটার জানান যে, তিনি হুট একটি ঝাঁকুনি অনুভব করেন। কেউ যেন প্রবল শক্তিতে তাঁর আত্মাকে দেহ থেকে উপরের দিকে টেনে তুলছে। তারপর পিটার নিজেকে রনের বিছানার উপরে ভেসে থাকতে দেখলেন। ভাসমান অবস্থায় তিনি মৃত ব্যক্তির দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। পাশে তাকাতে রনকেও ভাসমান দেখতে পান। রনও নিচে তাকিয়ে একই দৃশ্যটি দেখছিলেন।
পিটার কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার অনুভব করেন যে তার আত্মা আবার তার শরীরে নেমে গেছে। ঘটনাগুলো এক পলকের মধ্যেই শেষ হয় আর রন খুব শীঘ্রই মারা যান। কিন্তু সেই দিন সম্পর্কে পিটারের অনেক প্রশ্ন ছিল। তিনি সেই মুহূর্তটিকে কী বলবেন তা জানতেন না। যেটুকু জেনেছিলেন যে এটি অলৌকিক নয় বরং তাঁর “শেয়ার-ডেথ অভিজ্ঞতা” হয়েছিলো।
হাম্বারতো কাসাসের “ঐশ্বরিক আলো”ঃ
অসুস্থ, ঠান্ডা, ব্যথা এবং ভয় – হাম্বারতো কাসাস এক শীতের দিনে বাইক চালানোর সময় বুকের ভেতর এসবই অনুভব করেছিলেন। তারপর শুধু অ্যাম্বুলেন্সের জন্য অপেক্ষা।
তাকে দ্রুত উইসকনসিনের সেন্ট ক্যাথরিন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ মাইকেল রোজেনবার্গ জানান হাম্মবারতো কার্ডিয়াক এরেস্ট হয়েছেন।
হাম্বারতো তখন অনুভব করেছিলেন যে তার জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছে। ডাঃ রোজেনবার্গ নিশ্চিত করেন এটা জীবন মৃত্যুর ঝুঁকিপূর্ণ কেস।
এরপর যা ঘটেছিল তা হল হাম্বারতোর মৃত্যু এবং মৃত্যু পরবর্তী জীবনে প্রবেশের অবিশ্বাস্য অভিজ্ঞতা। তিনি অনুভব করেন মৃত্যু, আর সেই আলোকিত পথ যা সবাইকে মৃত্যুর জগতে নিয়ে যায়।
হাম্বারতো জানান তিনি হুট করেই অকল্পনীয় শান্তি এবং স্বস্তি অনুভূব করেন। একটা সাদা আলো দেখতে পান তিনি। তিনি জানান, “এটি একটি সুন্দর অনুভূতি,”। আত্মা সেই আলোকে অনুসরণ করতে থাকে। হাম্বারতো সে আলোটিকে “ঈশ্বরের আলো” বলে অভিহিত করেন।
আরও জানান তিনি যখন স্বর্গে ছিলেন, তখন নিচের দিকে তাকিয়ে তার বাচ্চাদের সোফায় বসা দেখতে পাচ্ছিলেন।
সুস্থ হওয়ার পর হাম্বারতো যখন সন্তানদের গল্পটি বলেছিলেন তাঁর স্ত্রী আর বাচ্চারা জানান, তারা সেখানেই সারাক্ষণ বসে ছিলেন আর প্রার্থনা করছিলেন।
বিখ্যাত সাহিত্যিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের যুদ্ধক্ষেত্রে যখন একটি বিস্ফোরণ শেল দ্বারা গুরুতরভাবে আহত হন তখন বাড়িতে একটি চিঠিতে লিখেন। সেখানে তিনি জানান যে “মৃত্যু একটি খুব সাধারণ জিনিস। আমি মৃত্যুর দিকে তাকিয়েছি, এবং সত্যিই আমি জানি। আমার যদি মরে যাওয়া উচিৎ হতো তাহলে আমার জন্য খুব সহজ হতো। আমি যেসব কাজ করেছি তাঁর ভেতর সবচেয়ে সহজ কাজ হতো মৃত্যু।”
বছরের পর বছর পর হেমিংওয়ে তার নিজের মৃত্যু অভিজ্ঞতাকে খাপ খাইয়ে নেন একটি আফ্রিকান সাফারি সম্পর্কে তার বিখ্যাত ছোট গল্প “দ্য স্নোস অফ কিলিমাঞ্জারো” এর মধ্যে দিয়ে।
নিয়ার-ডেথ এক্সপেরিয়েন্স বা প্রান্তিক মৃত্যু অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গেছেন এমন ব্যক্তিদের গল্পগুলি থেকে দেখা যায় অভিজ্ঞতা শুরুর সময় তাদের ব্যথামুক্তি ঘটে , উজ্জ্বল সাদা আলো দেখতে পান এবং অন্যান্য চাক্ষুষ ঘটনা যেমন নিজ শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া এবং আত্মা হিসেবে শরীরের উপরে ভেসে বেড়ানো। আবার তারা তাঁদের জীবিত বা মৃত প্রিয়জন বা আধ্যাত্মিক প্রাণী যেমন ফেরেশতাদের সাথে দেখা করেন। অনেক সময় ব্যক্তির জীবন তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠে।
আবার নিজ নিজ ধর্মবিশ্বাসের সাথেও অনেক ঘটনা জড়িত। যারা ধর্মে বিশ্বাস করেন না এমন কিছু ব্যক্তির উপর গবেষণা করে দেখা গেছে তারা কোন ব্যক্তি বা কোন ফেরেশতার দেখা পাননি তবে বাকি বিষয়গুলো মোটামুটি একই ছিলো।
প্রান্তিক মৃত্যু অভিজ্ঞতা সময় এবং স্থানের একটি বিকৃত উপলদ্ধিও হতে পারে। এই উপলব্ধিগুলোর কিছু শারীরবৃত্তীয় ব্যাখ্যা রয়েছে। যেমন ধীরে ধীরে সংকীর্ণ টানেল এর মধ্যে দিয়ে আলো দেখতে পাওয়াকে রেটিনার ভিজ্যুয়াল পেরিফেরিতে রক্তের প্রবাহ কমে যাওয়া মানে প্রথমে দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া হিসেবে ব্যখ্যা করা যায়।
প্রান্তিক মৃত্যু অভিজ্ঞতা একটি অপ্রতিরোধ্য অনুভূতি। এই অনুভূতি কিছু সময় ঐশ্বরিক বা অনন্য হতে পারে। তবে যাই হওক, মৃত্যু অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যক্তিদের একটি ঝাঁঝালো সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা শরীরের বিশাল ট্রমা এবং মহাবিশ্বের সাথে শান্তি ও একত্বের অনুভূতি নিয়ে সারা জীবন চলতে হয়। সমস্ত প্রান্তিক মৃত্যু অভিজ্ঞতা সুখী হয় না। কিছু ভীতিকর হতে পারে, তীব্র যন্ত্রণা, একাকীত্ব এবং হতাশাজনক হতে পারে।
তানভীর আল আজাদ
সূত্রঃ
- https://guideposts.org/angels-and-miracles/angels/don-pipers-angelic-experience/
- https://guideposts.org/angels-and-miracles/miracles/gods-grace/bubbas-miraculous-encounter-with-god/
- https://abc7chicago.com/near-death-experiences-experience-story-heaven-round-lake-il/12550824/
- https://www.scientificamerican.com/article/what-near-death-experiences-reveal-about-the-brain/