জুতা
বিদ্যুৎ’এর গলার তেজে ফাঁকা মেসরুম গমগম করে উঠলো, “ভাই, তুমি যাবে পাঁচ ভাইয়ে? খিদেয় আমার জান যায়! খালা আসে নি আজকে।”
বিদ্যুৎ’এর কথার ঝাঁঝে ফারাজের নাকে জ্বলন উঠে, খালি পেট থেকে নির্গত ঢেঁকুরও এমন তীব্র ঝাঁঝালো হয় না। ফারাজ জিজ্ঞেস করলো, “তোর ঘটনা কি? এমন মুখ বানিয়ে রেখেছিস কেনো? যাবো তো খেতে। আধ-ঘণ্টা সময় দে, গোসল করে নেই। গরমে তো পাগল হওয়া বাকি!”
বিদ্যুৎ তার মাইকের মতো তীক্ষ্ণ গলা আরো একধাপ উপরে তোলে বলে, “তুমি এখন যাবে আমার সাথে। নাহলে আমি একাই যাচ্ছি। মেজাজ এমনিতেই খারাপ তারমধ্যে পেটের এই অনবরত ভিক্ষা চাওয়া সহ্য করতে পারবো না।”
ফারাজ তার এই ছোটভাই’কে বিশেষ স্নেহ করে। ছ’বছর আগে মেসেই পরিচয় হয় বিদ্যুৎ’এর সাথে। ধর্ম আর বিশ্ববিদ্যালয় ভিন্ন হলেও আচার-আচরণে দু’জনেরই বেশ মিল আছে। ছোটভাইয়ের প্রতি স্নেহ থেকে হোক আর নিজের পেটের কল্যানে হোক, ফারাজ আর কথা লম্বা না করে টিশার্ট গায়ে দিয়ে নেয়, টু-কোয়ার্টার প্যান্ট পরনেই ছিলো। গরম’কে একহাত দেখে নিতে এই আউটফিট দারুন কাজের, বিশেষত ঘরের বাহিরে।
মেস থেকে বড় রাস্তা অনেকটা দূর। গলি’তে রিক্সার তালাশে অতিরিক্ত সতর্কতায় দুজনের মধ্যে তেমন কথা জমে না। এরমধ্যে একটা রিক্সা পা-ফসকে চলে গেছে। মুরুব্বি একজন মসজিদ থেকে বেরিয়েই বাগিয়ে নিয়েছেন। নিত্য ঘটনা, কিন্তু ফারাজের মেজাজও চড়ে গেলো। খালি পেটে মেজাজ মা-বাপ ছাড়া এতিম!
বড় রাস্তায় এসেও রিক্সা পাওয়া যাচ্ছে না। খালি রিক্সা চোখের সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে কিন্তু জিন্দাবাজার যেতে নারাজ। ক্ষুদার্ত অবস্থায় এতটুকু পথ হেঁটেই ক্লান্ত, তার উপর রিক্সা পাওয়া যাচ্ছে না। ফারাজ বুঝলো, আজকের রাত মেজাজ খারাপের। বিদ্যুৎ’কে দেখে নিলো এক ঝলক, ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে। ফারাজের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো, “তুই ফাজলামো রাখ। আমাকে না দেখে রিক্সা দেখ। মেজাজ খারাপটা তো সাকসেসফুলি ট্রান্সফার করেই দিলি, বাল।”
অবশেষে একজন রিক্সাওয়ালা’র দয়া হলো। বিদ্যুৎ তড়িঘড়ি করে চেপে বসলো রিক্সায়। ফারাজ গলির মুখের দোকান থেকে সিগারেট ধরিয়ে নিলো। মেজাজ খারাপ ভাবটা চলে গেছে। শুকনো মুখে সিগারেটের ধোঁয়া তিতকুটে লাগছে, মুখের ভেতরে শুষ্কতা। ঠোঁট চাটতে চাটতে ফারাজ রিক্সায় উঠলো। আয়েশি ভঙ্গিতে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে জিজ্ঞেস করলো, “তোর মেজাজের সমস্যা কি? কার উপরে চড়েছে?”
বিদ্যুৎ প্রশ্ন শুনতে পায় নি। রিক্সা ছাড়ার পরপরেই ওর তালগোল পাকানো মন, খিচড়ে থাকা মেজাজ সিলেটের নরম তুলতুলে বাতাসে ভেসে গেলো। রিক্সায় চড়লেই ওর অন্যরকম ভালো লাগে। বিদ্যুৎ ভাবে, উড্ডীনের অপেক্ষায় জীবন। জন্মের পর থেকেই মাটির কাছাকাছি অথচ উড্ডীনের অপেক্ষা তখন থেকে শুরু। উড়ে যাওয়া বলতে আকাশে ভাসা বুঝালেও কবর বলতে একটা শব্দ আছে! রিক্সায় বসলে নিজেকে পাখি মনে হয়। চোখ বন্ধ করলেই বিমান ছাড়াই হাওয়ায় ভাসা যায়। পাছার নিচ থেকে সিট নাই হয়ে যায়, বসে বসে উড়ছে, উড়তে উড়তে গন্তব্যের দিকে যাওয়া। খাটিয়ার বদলে রিক্সা নিয়ে কবরে! খারাপ না…
ফারাজ দেখলো বিদ্যুৎ চোখ বন্ধ করে আছে। ক্ষীণ সন্দেহ হলো ওর, ঘুমিয়ে পরলো নাকি! মৃদু ধাক্কা দিলো ফারাজ, “এই বোকাচোদা, ঘুমাচ্ছিস? কথা বল…”
ধাক্কায় বিদ্যুৎ’এর চোখের নিশানা গেলো প্রথমে ফারাজের দিকে তারপর গেলো ফুটপাতের দেয়ালে যেখানে বড় বড় হরফে লেখা, “অনো মুতা নিষেধ”। লেখাটা ওদের পেছন দিকে হেঁটে চলে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ এর হাসি পেলো, গভীর বিশ্বাস থেকে জিজ্ঞেস করলো— “আচ্ছা ভাই, আমাদের কপাল এত্তো খারাপ কেনো?”
বিদ্যুৎ’এর কথাবার্তা নিজের সবচেয়ে দুর্বল দিকে যেতে পারে তা ধারনারও বাহিরে ছিলো ফারাজের। তাও হাল ছাড়লো না, “হেঁয়ালি রাখ বিদ্যুৎ। মেসে কোনো ঝামেলা হয়েছে আবার? ফুরকান এই সপ্তাহেও বাজার করে নাই, না?”
বিদ্যুৎ বললো, “আরেহ ভাই নিজের সমস্যাতেই বাঁচা দায় আর তুমি বলতেছো ফুরকান ভাই কি করলো না করলো নিয়ে! ঘটনা যা ঘটেছে তা কাউকে বলার মতো না। বেপারটা কিছুটা লজ্জার। তবে আমার রাগ উঠতেছে অনেক, কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে মন চাচ্ছে। ফারাজ সিগারেটে শেষ টান দিতে দিতে বললো, “তুই বলে যা, আমি শুনছি।”
ঘটনা এমন—
টাকা বাঁচিয়ে গেলো বছর শীতের শেষ দিকে বিদ্যুৎ তার অনেক শখের বুটজুতা কেনে; এংকেল বুট। অনেক ঘুরাঘুরি করে বাছবিচার করে শেষমেশ বাটা’র অরিজিনাল লেদারে মন গলে ওর। বটলগ্রীন রঙের বুট দেখতে আসলেই বেশ সুন্দর, পায়ে মানিয়েছেও ভালো। তবে মন উজার করে পরা হয়নি। ধুপ করে শীত চলে গিয়ে গরমকাল তার থাবা বসিয়েছিলো শহরে। বিদ্যুৎ বাক্সবন্দি করে বুটজোড়া সু-র্যাকে সাজিয়ে রেখেছিলো সামনের বছর পরবে বলে। এখন শীত নামি-নামি করছে। তাই আগেভাগে জুতার বাক্স খোলেই দেখলো অসংখ্য টুকরো কাগজের সাগর হয়ে আছে আর ভেপসা গন্ধ। তারমধ্য থেকে এংকেল বুটের এংকেল উঁকি দিচ্ছে শুধু।
অবাক হয়ে বিদ্যুৎ কাগজ আর গন্ধের সমুদ্র থেকে বুটজোড়া বের করে আনতে যাবে তখন’ই কয়েকটা বামন-চিকা চিকচিক করে প্রতিবাদ করে উঠলো। চিকার ভাষা বিদ্যুৎ জানে না, বাক্সে হাত গলিয়ে দিলো। চিকাদের সর্দার বোধহয় মহা ক্ষেপে গেছে। এতো দিনের আরামের সম্রাজ্যে কোন সে পাপিষ্ঠ হানা দিলো? কার এতো বড় সাহস?
বড় সাহস কার সেটা দেখতেই কি-না বামন-চিকাগুলো বিদ্যুৎ’এর হাতের উপরে উঠে গেলো, কয়েকটা টুকরো কাগজের গহীনে হারালো আর কয়েকটা অতিউৎসাহী চিকা আছড়ে পরলো মেঝেতে। চিকা হাতে উঠা মাত্রই বিদ্যুৎ লাফ দিলো। হাত থেকে বাক্স পরে গেলো। আকস্মিক এই আক্রমণ ঠেকাতে মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো ‘শাওয়ার চিকা’ শব্দদুটো। বামন-চিকা মানুষের ভাষা বুঝে না; তবে বিপদ বুঝে। ঘরের চিপা-কোণায় ছড়িয়ে গেলো চোখের নিমিষেই। বামন-চিকা সর্দারের সাহস দেখা আপাতত ইতি।
বাক্স ডাস্টবিনে ফেলে জুতা নিয়ে বসলো বিদ্যুৎ। শখের বুটের ক্ষয়ক্ষতি যাচাই করতে গিয়ে দেখলো বুটের গায়ে একটা আঁচড়ও নাই তবে বাম-পায়ের বুটের ফিতা জায়গায় জায়গায় কাটা। চিকাদের এহেন শিল্পকর্ম রেখে বিকেলে দৌড়ালো জুতার দোকানে। জিন্দাবাজারে বাটা-এপেক্স-লটো, ব্লু-ওয়াটার শপিং মলের জুতার দোকানগুলো দেখে ছুটলো বন্দর হকার্স মার্কেটে। গলি-ঘুপচি ঘুরেও এংকেল বুটের ফিতা পাওয়া গেলো না; কিন্তু বাকি সব ধরনের জুতার ফিতা আছে। বিদ্যুৎ তখন বুঝতে পারে না, তার মাথায় রাগের জন্মটা বামন-চিকার শিল্প কর্মের জন্য নাকি নিজে খুব বাছবিচার করে এংকেল বুট নামের আপদ কিনেছিলো সেজন্যে। রাগে নিজের হাত নিজে কামড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছিলো ওর।
মেসে ফিরে লম্বা দম নিলো। ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করতে লাগলো ফিতা কিভাবে মিলানো যায়। সময়ের নৌকায় চড়ে রাগ বাদ দিয়ে বিদ্যুৎ নোঙর ফেল্লার চেষ্টা করলে শীতল মস্তিষ্কের গভীরে। হাত খরচের টাকা জমিয়ে বুটজুতা কিনে এখন ফেসে গেলো। বুট আছে কিন্তু ফিতার জন্য পরতে পারবে না। শালা! এমন থাকার মানে কি? মেজাজ আবার সপ্তমে উঠতে চাচ্ছে, কিন্তু রাগকে এখন পাত্তা দিলে চলবে না।
রাতে সবকটা অনলাইন শপে ঘুরে দেখলো। নাই, এখানেও নাই। যেনো দেশে এংকেল বুটের ফিতা বিক্রি করতে সরকার আইন করে নিষেধ করেছে! তাল হারাতে হারাতে শেষমেশ দারাজে পাওয়া গেলো ফিতা। চোখ চকচক করে উঠলো ওর। আর অপেক্ষার শক্তি পেলো না, ফটাফট অর্ডার করে ফেললো।
পরদিন দুপুরে কনফার্মেশন ইমেল আসার আগপর্যন্ত বিদ্যুৎ’এর জানা ছিলো না জুতার ফিতা আমদানি হবে ইউরোপ— জুতার জন্য বিখ্যাত দেশ ইতালি থেকে। তবে সময় কম লাগবে, পনেরো দিন। শখের বুট পায়ে দিতে পনেরো দিনের ধৈর্যের যোগান খুঁজতে লাগলো। দিন যায়, একসময় বিদ্যুৎ ভুলে যায় ফিতার কথা। দৈনন্দিন ঝামেলা মিটাতে হিমশিম খায়। এরপর পার্সেল হয়ে আজকে সন্ধ্যার আগে আগে দুয়ারে হাজির হলো সাতরাজার ধন— এংকেল বুটের ফিতা। খুশির ঠেলায় পার্সেল খোলে গেলো, ফিতা লাগাতে শুরু করলো। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি; ফিতা বুটে প্যাচ খেয়েও আরো প্রায় এক হাতের মতো পরে আছে মেঝেতে! এই মহাশয় হাইনেক বুটের সম্পত্তি, এংকেল বুটের জন্য ওভারসাইজ!
অপেক্ষা-কল্পনা, শখের বুট ব্যবহার করতে না পারা, পয়সা নষ্ট-সময় নষ্ট–এনার্জি নষ্ট, খালা না আসায় সারাদিন না খেয়ে থাকা ইত্যাদি নানান মশলার মিশেলে বিদ্যুৎ’এর মগজে রাগের আগুনে রান্না হলো চমৎকার দুটি শব্দ— বালের জীবন।
শব্দদুটো রাতের নরোম হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে ফারাজের কানে আর্তনাদ করে উঠলো। ফারাজ হাসবে না হাসবে না করেও আটকাতে পারলো না! বিদ্যুৎ হাসি উপেক্ষা করে বললো, “ভাই বলো না আমাদের কপাল খারাপ কেনো? চিকার বাচ্চাদের আস্তো বুট রেখে ফিতা কাটতে হলো কেনো? আর কটলোই যখন, তখন কেনো বাজার থেকে ফিতা উঠে গেলো? অনলাইনে অর্ডার করে আশার উপরে বসে ছিলাম, কিন্তু হয়ে গেলো ওভারসাইজ। কেনো? জীবনের এই কোন তামাশা ভাই আমারে নিয়ে?
ফারাজ উত্তরে বলতে গেলো, “কপাল খারাপের কথা মুখেও..” কিন্তু শেষ করতে পারলো না। রিক্সাওয়ালা কষে ব্রেক চেপে রিক্সা আর ওর মুখ দুটোই বন্ধ করে দিয়েছে। ড্রাইভার বললো রাস্তায় কাজ চলছে, আপাতত বন্ধ। রিক্সা আর যাবে না।
অগত্যা দুজনে হাঁটতে শুরু করলো। আম্বরখানা কাছেই; পয়েন্টে গেলেই রিক্সা পাওয়া যাওয়ার কথা। ফারাজ তার না বলা বাক্য পূর্ণ করলো, “শোন, প্রতিকূল পরিবেশ তো সেই গুহা-জীবন থেকেই। হতাশা-রাগ ঝেড়ে ফেলতে হবে। নাহলে জীবন আমাদের লাগিয়েই যাবে। সে সুযোগ জীবনকে দেয়া যাবে না; এটাক ইজ দ্য বেস্ট ডিফেন্স। লাগাতে হবে আমাদের প্রথমে, জীবনকে।”
বিদ্যুৎ কাধ ঝাঁকি দিয়ে টিটকারির হাসি হাসলো। জ্ঞানের কথায় পেট ভরছে না। বিদ্যুৎ ক্লান্ত, জীবন টানতে গিয়ে ক্লান্ত। তার সাথেই বারবার এমন হয়। এইসব চিন্তার মাঝখানে চেঁচানোর আওয়াজ পেলো। ঘাড় ঘুরিয়ে আওয়াজের উৎসের দিকে নিয়ে গেলো। দেখলো ফারাজ ভাই রাস্তায় উল্টে পরে আছে। আকাশের দিকে মুখ, চোখ বন্ধ–কুঁচকে আছে। ফারাজকে টেনে তুলতে তুলতে বিদ্যুৎ বললো, “দেখলে ভাই, জীবনের ধোন কতো লম্বা? নাম নিতেই জায়গামতো লাগিয়ে দিলো!”
ভাঙা রাস্তা— পিচ, ইট, রড এলোমেলো পরে আছে খেয়ালই করেনি ফারাজ। উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে দেখলো উন্মুক্ত হাঁটু’র সাথে ভাঙা রাস্তার খুব মাখামাখি হয়েছে। স্মারক সরূপ রক্ত লেগে আছে, হালকা ব্যথাও উপস্থিত। ফারাজ তার সদ্য কুমারীত্ব ত্যাগ করা হাঁটু থেকে ময়লা ঝাড়তে ঝাড়তে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বিদ্যুৎ’এর কথার সত্যতা আছে। হাঁটতে গিয়ে দেখলো স্যান্ডেল ছিঁড়ে গেছে। জীবনকে লাগানো এতো সহজ না!
আম্বরখানা মুচির কাছে জুতা সেলাই করাতে দিয়ে দুজনে আবার হাঁটতে শুরু করলো। রিক্সা আর নিবে না। ফারাজের মাথায় সব বাদ দিয়ে শখ উঠেছে, খালি পায়ে হেঁটে জিন্দাবাজারে যাবে। গরমে আধসেদ্ধ রাস্তায় অনভ্যস্ত খালি পা ফেলতে খুব একটা খারাপ লাগছে না। জীবনের মারপ্যাঁচ দুজনেই ভুলে গেলো। একটানা হেঁটে জিন্দাবাজারে এসে স্যান্ডেল কিনলো ফারাজ। জুতায় বিদ্যুৎ’এর মতোন এতো বাছবিচার নেই ওর। একটা হলেই হলো। তারপর গেলো পাঁচ ভাই’তে। সরিষা ভর্তা আর সাতকরা দিয়ে গরুর মাংস আর ধোঁয়া উঠা সাদা ভাত— শরীরের যে যে জায়গা ফাঁকা জায়গা ছিলো সবখানে ভাত পাঠিয়ে পূর্ণ করে দিলো দুজনেই।
তৃপ্তির ঢেকুর তুলে রেস্টুরেন্টের বাহিরে এসে ফারাজ একটা পান নিলো। জাফরান আর গোপাল ১৩২ জর্দা সাথে কাঁচাসুপারির রসায়নে মাথা ঝিমঝিম করা গন্ধ ভাসতে লাগলো ফারাজকে ঘিরে। একটা সিগারেটও ধরালো, তারপর বিদ্যুৎ’কে বললো, “এই খাওয়ার পর আধঘণ্টা না হাঁটলে পাপ হবে। চল চল, মেসে যাই। রাত অনেক হয়েছে।”
আম্বরখানা পর্যন্ত হেঁটে আসতে রাত সাড়ে দশটা হয়ে গেলো। সিলেটে রাত ন’টায় দোকানপাট বন্ধ হয়, ভিড়ভাট্টা কমে যায়। ঝাপি খোলে বসে আধ্যাত্মিক শহরের রাজধানী। শীতল হাওয়া তালে তালে ধাক্কা দিয়ে ফারাজ আর বিদ্যুৎ’কে হাঁটতে সাহায্য করলো। পয়েন্টের কাছাকাছি এসে ফারাজের মনে পরলো জুতা সেলাই করতে দিয়েছিলো। নতুন জুতা কেনায় পুরনোটার প্রতি আগ্রহ কমে গেছে। তবে এতোক্ষণে মুচি চলে গেছে। ফারাজ এই নিয়ে আর মাথা ঘামালো না। চার রাস্তার মোড়ে আসতেই না-চাইতেও চোখ গেলো অগ্রনী ব্যাংকের নিচের টানা বারান্দায়। মুচি-হকারদের বসার জায়গা এটা। শূন্য পরে আছে। ফারাজ চোখ সরিয়ে জামে মসজিদের দিকে নিয়ে গেলো। জায়গায় জায়গায় ভ্রাম্যমাণ চায়ের টং, সবজি-মাছের দোকান বসেছে। গভীর রাতে আম্বরখানার এই বাজারের আমেজটা পছন্দ ফারাজের। ধনী থেকে রাস্তার ফকির— একসাথে দরদাম করে এখান থেকে বাজার কেনে। বিদ্যুৎ’এর ডাকে ফারাজ দাঁড়ালো, অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিলো সে। বিদ্যুৎ যে পাশে নাই খেয়ালই করেনি। বিদ্যুৎ অবাক চোখে অগ্রনী ব্যাংকের বারান্দার দিকে তাকিয়ে আছে। ফারাজ বিদ্যুৎ’এর দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখলো বারান্দার এক কোণায় বসে আছে কেউ একজন। হাতে প্লাস্টিকের লাল দড়ি। মানুষটার পায়ের কাছে একটা কুকুর ঘুমিয়ে আছে। হাতের দড়ি দিয়ে কুকুরের কানে সুড়সুড়ি দিচ্ছে মানুষটা। ঘুমের মধ্যেই কুকুরটা মাথা ঝাকাচ্ছে, স্বভাবের বাইরে অদ্ভুত আওয়াজ বেরিয়ে আসছে মুখ থেকে।
দুজনেই থম মেরে দাঁড়িয়ে এই অদ্ভুত দৃশ্য দেখছে। কুকুরের কানেও যে কেউ সুড়সুড়ি দিতে পারে তা কখনো কল্পনাতেও আসে নি সেখানে নিজ চোখে প্রত্যক্ষ করছে! তাঁদের দেখে মানুষটা উঠে দাঁড়ালো, বললো, “আপ্নেগো সময়জ্ঞান নাই? ঘণ্টার উপ্রে এনে বইয়া রইচি আপ্নেগো লাইগা। দোকান বন কইরা বেবাকে চইলা গেছে!”
ফারাজ অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো, “তুমি যাওনি কেনো?”
উত্তরে মুচি বললো, “আপ্নেরে দেখলাম খালি পায়েই হাইটা যাইতাছেন গা। আমি ভাবছি এনেই হয়তো থাকবেন। তুরন্দ জুতা সিলি কইরা রাইখা দিচি। হের পরে আপ্নেগো আর পাত্তা নাই।”
ফারাজ আর বিদ্যুৎ চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো যেনো এই মাত্র চোখের সামনে থেকে আস্তো ক্বীন ব্রীজ হাওয়ায় অদৃশ্য হয়ে গেছে। জুতা সেলাই করে তা দেয়ার জন্য মুচি বসে আছে এতোক্ষণ, বিশ্বাস হচ্ছে না ওদের।
মুচি বললো, “জুতা সিলি আমার কাম-ধম্ম দুইডাই। এইনে অবহেলা করি না। আপ্নেগো পাউ না চললে আমগো পেটও চলবো না। আমার কাম আমার কাছে কিলিয়ার। এখন সিলির দাম ৫০ টেকা দেন, আমি বাইত যাই।”
মুচি ভয়ে ভয়ে সেলাই দাম একটু বাড়িয়েই বললো। এই বয়সের ছেলেদের বিশ্বাস নাই। দামদরে না হলে গালাগালি তো করবেই, মারতেও পারে। সমাজের ছোট জাত হওয়ার বিশেষ যন্ত্রণা আছে। নিজের ব্যক্তিগত সম্পত্তি মনে করে সবাই হাত-মুখ ছোটায়। কোনো বিবেক-বিচার নাই। মুচি দুরুদুরু বুকে ফারাজের দিকে তাকিয়ে রইলো দামের আশায়।
ফারাজ একশো টাকার দুইটা নোট এগিয়ে দিলো, “আপনার নিষ্ঠা আমাকে অবাক করেছে। এর দাম তো দিতে পারবো না তবে এই টাকাটা আপনি রাখেন। ভালোমন্দ খেয়ে নিয়েন। আর জুতোও রেখে দিন আপনি।”
টাকাটা মুচিকে ধরিয়ে দিয়েই দুজনে আবার পথ ধরলো। এমন সব মুহূর্ত ফারাজ আর বিদ্যুৎ’কে দারুন এক আবেশে জড়িয়ে দেয়। আম্বরখানার বাতাসের চাইতেও গরাদের ভেতরে গভীর শীতল বাতাস অনুভব করে। বিদ্যুৎ ভাবে, এই জুতার কাহিনী থামছেই না। কোন কোন ঘাট ঘুরে এখন তাঁদের কোথায় এনে ফেললো!
ফারাজ আর বিদ্যুৎ’এর চলে যাওয়ার দিকে মুচি তাকিয়ে রইলো, বিন্দু হয়ে মিলিয়ে যাওয়ার আগপর্যন্ত তাকিয়েই রইলো। আর এরপরেই মুচির মুখে দুষ্টু একটা হাসি খেলে গেলো। ছোট জাত হওয়ায় সমাজে টিকে থাকার লড়াইয়ে চালাক হতে হয়। দুজনের কথাবার্তা থেকেই বুঝেছিলো ওরা ভাবুক, খামখেয়ালি আছে ওদের মধ্যে। তাই অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেয় ও, যার ফলাফল এখন হাতের মধ্যে দুইটা কড়কড়ে নোট। অপেক্ষায় সওদা খারাপ হয় নাই, লাভ দ্বিগুণ’ই বলা যায়। ঘরের জন্য জম্পেশ বাজার করে ফেলতে পারবে। তার আগে দরকার চা!
জুতার সেলাইয়ের বাক্স আর ব্যাগ হাতে শীস দিতে দিতে টং’এর সামনে দাঁড়ালো মুচি, “কাচাপাত্তি মাইরা এককাপ চা দিয়েন, ডাবুল শট!”
লেখাঃ আফিন্দী ইমেইলঃ afindi95@gmail.com হোয়াটসএপঃ +447519 591 624