বই, বইঘর, ক্ষয়িষ্ণু সংস্কৃতি এবং অন্যান্য- প্রান্ত ঘোষ দস্তিদার

তারিখ:

পোস্ট শেয়ার করুন:

বই, বইঘর, ক্ষয়িষ্ণু সংস্কৃতি এবং অন্যান্য

প্রান্ত ঘোষ দস্তিদার

ছোট্ট হারু ভালবাসত ইলিশ মাছ, আর ভয় পেত রয়েল বেঙ্গল টাইগার। অথচ জাগতিক নির্বুদ্ধিতা পেশাদারীদের বাধ্য করল অসময়ে ইলিশ ধরতে, এবং চামড়ার লোভে বাঘ হত্যা করতে। দিন গেল, বছর গেল, মাস গেল- সময় এসে হাজির হলো এমন এক পরিস্থিতে যখন হারু নিজেই সামাজের দায়িত্বশীল একজন নাগরিক, সন্তানের বাবা। এখন সে আর ইলিশ খেতে পায় না, রয়েল বেঙ্গল টাইগার বলে কোনও বাঘ প্রজাতি আজ আর জঙ্গলে নেই। এখন সে আক্ষেপে ছেলেকে অতীতের গল্প শোনায়। সন্তান ভাবে- বাবা এসব কী বলে? সবই তার উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা!

গল্পটা ভাল লাগল না তো? লাগার কথাও নয়। অথচ বাস্তবতা অনেকটা এই পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। সংস্কৃতির অন্যতম বাসস্থান বইঘরগুলো ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে দেশের বুক থেকে। এমনটা কি হবার কথা ছিল? হয়তো না! আমি অন্তত সমাজের অদূরদর্শিতাকেই এর জন্য দায়ী করতে প্রস্তুত। পাশ্চাত্যে এখনও অসংখ্য বইঘর, লাইব্রেরী এবং অনলাইন শপ রয়েছে, সেগুলো অনেকাংশে সফল ভাবে ব্যবসাও করছে। তাদের স্থান অনুপাতে জনসংখ্যাও আমাদের তুলনায় নিতান্তই নগণ্য, তবে কেন আমরা পারছি না?

ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে। নিউমার্কেটে বাবা-মা’র হাত ধরে শপিং-এ যেতাম। এমন কখনও হয়নি ওখানে গিয়ে বইয়ের দোকানে ঢুকিনি। ভেতরে গিয়ে থরে থরে সাজানো বইগুলো ঘেঁটে দেখতে যে কী পরিমান আনন্দ হত, তা বলাই বাহুল্য! অধিকাংশ দিনই বই কিনে বাড়িতে ফিরতাম। নতুন বইয়ের গন্ধ নিতে নিতে ভুলে যেতাম টিভি প্রোগ্রামের কথা। বইটা না শেষ করা পর্যন্ত শান্তি পেতাম না।

সেসব দোকান আজও আছে, হতশ্রী দশায়। তাকে তাকে বৈধ বইয়ের সাথে অবৈধ উপায়ে ছাপা বইও পাওয়া যায়। নৈতিকতার অবক্ষয়ের পথ ধরতে তারা এক প্রকার বাধ্যই হয়েছে বলা চলে। বই বিক্রি নেই, মানুষ আসে না দোকানে। চুপচাপ বসে বসে আর কত ধৈর্য ধরা যায়?

এরপর বিশেষ ভাবে মনে আসে ধানমণ্ডির দুটো বইয়ের দোকান, বই বিচিত্রা এবং ETC. -র কথা। কাছাকাছি দুটো দোকান, পুরাতন ২৭ নম্বর রোডের মাঝামাঝি। দুটোই সুন্দর ছিল কিন্তু ETC. -র চাকচিক্য ছিল চোখের দেখার মত। সম্ভবত সেই প্রথম দেশের মাটিতে দেখেছিলাম একটি বিদেশী ধাঁচের বইঘর। দোতালা বুকশপ, চলন্ত সিঁড়ি ধরে উপরে উঠতে হত। দেশী বইয়ের পাশাপাশি আধুনিক ও চিরায়ত বিদেশী বইয়ের সমাহার। সব আসল বই! ‘আসল’ কথাটি বলে নিজেরই লজ্জা হচ্ছে। বই-তো আসলই! তা আবার নকল হয় কীভাবে?

হয়, বই নকলও হয়। হরদম হচ্ছে। সেই ছেলেবেলা থেকে দেখছি। বিদেশী বইয়ের দাম বেশি ছুতো দিয়ে সেই বই এক প্রকার ফটোকপির মত করে দেধারসে ছাপায় হয়। এতে বইয়ের দাম কমে, বাজারে সুলভ মূল্যে পাঠকের হাতে বই পৌঁছায়। এই প্রকার অবৈধ চর্চায় যে নৈতিকতার অবক্ষয় হয়েছে, তার ক্ষতিকারক দিকটা আজকের দিনে এসে বেশ স্পষ্ট ভাবে ধরা পড়ে। এখন আধুনিক স্ক্যানার, মোবাইলের কল্যানে বইয়ের সফট কপি ছড়িয়ে পড়েছে ইন্টারনেটের আনাচে কানাচে। সেই বস্তু বিনামূল্যে পাওয়া যাচ্ছে। তা সংগ্রহ করা অবৈধ বটে, কিন্তু তাতে কী? সেসবের পরোয়া আজ কে করে? মানুষকে অবৈধ জিনিস খাইয়ে খাইয়ে অভ্যস্ত করে ফেলা হয়েছে, এখন তাকে নৈতিকতা শিখিয়ে সত্যের পূজারী করার চেষ্টা অনেকটা অর্থহীন।

ফিরে আসি ETC. প্রসঙ্গে। আহা! কী সুন্দর সাজানো গোছান দোকান। সুদৃশ্য লাল রঙের সোফাগুলো এখনও মনে পড়ে। সাড়ি সাড়ি শেলফে কত নতুন নতুন বই! একবার হাত বুলালেও মন ভাল হয়ে যেত। যেবার হ্যারি পটার সিরিজের ষষ্ঠ বই মুক্তি পেল, বইটি ETC. তেও প্রকাশের সাথে সাথেই এসেছিল। নতুন হার্ড কভার বই! চকচকে ঝকমকে। আমার বিশিষ্ট হ্যারি পটার পাগল বন্ধু দোকানে গিয়ে চটপট বাগিয়ে ফেলল বইটা। উফ! সে-কি আনন্দ তার! অর্থাভাবে আমি কিনতে পারিনি ঠিকই, কিন্তু ওর আনন্দ দেখে তৃপ্তি পেয়েছিলাম। বইটা নেড়ে চেড়ে দেখেছিলাম। ও বুক দিয়ে আগলে রাখত, এক টুকরো সোনার মত সামলে রাখত সেটা। আরেক বন্ধু দোকানে গিয়ে সোফায় বসেই শেষ করে ফেলল পড়া, টাকা ছিল না কিনতে পারেনি। আরও বেশ কিছু বই পড়েছিল ও।

বইঘরের আনন্দটা সেখানেই! ওখানে ঢুকলেই মনে হবে অবারিত প্রান্তরে হাজির হয়েছি। যার শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই। যেখানে বাধাহীন ছুঁটে বেড়ান যাবে, ক্লান্তিহীন আনন্দ পাওয়া যাবে। যেখানে দুটো বই হাতে নিয়ে পড়ে ফেললেও কেউ ভ্রুকুটি করবে না। আবার এক একটি বই হীরের মত গুরুত্ব নিয়ে সংগ্রহের ইচ্ছা থাকবে মনে।

একদিন যথাস্থানে গিয়ে দেখলাম প্রিয় বইঘরটি আর নেই। ব্যবসায় টিকতে না পেরে সরে পড়েছে। মন খারাপ হয়ে গেল। ওই রাস্তা দিয়ে যাবার উপক্রম হলেই দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়ে তাকিয়ে থাকতাম সুদৃশ্য দালানটার দিকে। মনে হত- ঈশ, এই যান্ত্রিক শহরে একটা নির্মল আনন্দও কি টিকতে পারবে না? একটুকু শান্তিও কি আমাদের জীবন থেকে মুখ লুকিয়ে পালিয়ে যাবে?

হয়তো যাবে। কিছুদিন পরেই ওখানে আরেক সুদৃশ্য দোকান মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। ETC. চলে গিয়ে এল গ্রামীণ ফোন কাস্টমার কেয়ার অফিস। তারা মানুষকে সেবা দিচ্ছে এখনও। কিন্তু বই দিতে পারছে না। বই তাদের দেবার কথাও নয়, তারা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, নিজেদের কাজটুকু যথার্থ করে যাচ্ছে।

এভাবেই পালিয়ে যাচ্ছে সব নির্মল ভালবাসার নিদর্শনগুলো। দেশে ক্রিয়া দৌরাত্ব বাড়ছে, অথচ মাঠের সংখ্যা কমে যাচ্ছে ব্যস্ত শহরের বুকে। আগে যেখানে শিশুদের অবাধ প্রবেশ ছিল, সেখানে বসান হয়েছে বিধি নিষেধ। আগে আমরা রাস্তায় নেমে খেলা করতাম একে অপরের সাথে, সামাজিক সম্পর্ক ছিল একই দালান কিংবা পাড়ার অধিকাংশ শিশুদের মধ্যে। এখন সবাই চেনে ঘরের চার দেয়াল, টেলিভিশনের কেবল চ্যানেল, কম্পিউটার, মোবাইল, ইন্টারনেট, ব্যাস। উন্নতি এবং উন্নয়ন বাঁধ সেধেছে সু-অভ্যাসগুলোর বিকাশে। অথচ পাশ্চাত্যে তো এমন নয়!

বিদেশে কীভাবে পারে বই পড়া সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখতে? তাদের সঠিক ফর্মুলা রয়েছে। তারা বিচার করে বুঝেছে, কী করে বই পড়া উৎসাহিত করতে হয়, কী করে সমাজকে সামাল দিতে হয়। তারা অবৈধ উপায়ে বই সমর্থন দেয় না, বাজার নিয়ন্ত্রণ করে, অনলাইন এবং অফলাইনে মানুষকে বই কিনে পড়তে উৎসাহ দেয়।

পাশ্চাত্যে অধিকাংশ স্কুলে শিশুদের বই পড়ার জন্য আলাদা ব্যবস্থা করা হয়। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব লাইব্রেরী আছে। সাপ্তাহিক কিংবা মাসিক ভিত্তিতে বইয়ের উপর আলোচনা হয়, যেখানে সবাই বই পড়ে এসে তাদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করে, কিংবা লিখিত জমা দেয় মতামত। অভিভাবকদের পরামর্শ দেয়া হয় বাচ্চাদের বইঘরে নিয়ে পছন্দ মত বই ক্রয়ের সুযোগ করে দিতে। বাবা-মা সচেতন হলে সন্তানকে রাতে বই পড়ে শোনায়। শুনতে শুনতে শিশু ঘুমিয়ে যায়।

এখানে লাইব্রেরীও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সঠিক লাইব্রেরী ব্যবস্থাপনা বিনা ক্রয়ে বই পাঠে সহযোগিতা করে। কিছু সার্ভিস ফি দিয়ে সদস্য হয়ে গেলে সাপ্তাহিক ভিত্তিতে বই নেয়া যায়। লাইব্রেরীরা বই পুরাতন হয়ে গেল সেগুলোকে সেল করে আবার নতুন বই রাখে কালেকশনে। এবং এই সকল পুরনো বই আবার কম দামে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে কিনে পাঠকেরা সংগ্রহে রাখতে পারে। বইঘরগুলোও স্টকে নতুন বই রাখতে পুরনো বই সুলভ মূল্যে বিক্রি করে দেয়। সুতরাং যার আর্থিক স্বচ্ছলতা নেই, সেও অপেক্ষাকৃত সস্তায় বই কিনে পড়তে সক্ষম হয়। তাই অভ্যাস টিকে থাকে, নৈতিকতা সমুন্নত থাকে, বই পাঠে আগ্রহ বাড়ে। আর বই পড়লে মানসিকতা এবং মানবিকতার বিকাশ হয় সে তো প্রমাণিত সত্য!

পক্ষান্তের আমরা শিক্ষার বোঝা ছেলেমেয়েদের ঘাড়ে চাপাতে গিয়ে উল্টো তাদের বই বিমুখ করে ফেলছি। পরীক্ষার যাঁতাকলে তাদের পিষে হাড়গোড় গুঁড়িয়ে দিচ্ছি, বইয়ের প্রতি ভয় বাড়াচ্ছি। অভিভাবকেরা সন্তানকে একটি গল্পের বই পড়তে দেখলে উল্টো বকা দিচ্ছি, যেখানে তাদের হাতে স্বেচ্ছায় সাহিত্য তুলে দেওয়াই হচ্ছে যথার্থ উপায়!

আমাদের এখন আর লাইব্রেরী বলতে তেমন কিছুই নেই, আগেও সে ভাবে ছিল বলা যায় না। একবার জনৈক স্যারের সাথে তুমুল আগ্রহে উপস্থিত হয়েছিলাম স্থানীয় গ্রন্থাগারে। দেখে মনটাই ভেঙ্গে গিয়েছিল। হত দরিদ্র উপায়ে সংরক্ষিত পুস্তকাদি, পড়ার ব্যবস্থাও হতশ্রী। বই আনা যায়, কিন্তু কালেকশনে আধুনিক রহস্য-রোমাঞ্চ উপন্যাস নেই! আছে সব গম্ভীর বইয়ের সমাহার। বড় বড় নামকরা লেখকের জটিল সাহিত্য, এবং কতিপয় সংবাদপত্র। কিন্তু তা তো বাঞ্ছনীয় নয়! লাইব্রেরী হবে এমন স্থান, যেখানে সবার প্রয়োজন প্রাধান্য পাবে। যেখানে একজন শিশু যদি কমিক্স খুঁজে আনন্দ পায় তবে তাকে তা-ই দিতে হবে, আবার একজন বৃদ্ধ যদি বঙ্কিম রচনাবলী দিয়ে মনের খোঁড়াক মেটাতে চান তবে তা-ই সই!

নাহ, আমরা সঠিক উপায়ে সভ্যতা গড়ে তুলতে পারিনি। জোর করে সবাইকে বিদ্বান করতে গিয়ে বিদ্যা বিমুখ করে তুলছি ক্রমাগত। নীতি নির্ধারকরা নিদ্রায় আচ্ছন্ন, ওদিকে সমাজ ভেসে যাচ্ছে নিকষ আঁধারের স্রোতে।

বলা যায় বইমেলা নিয়েও। প্রসঙ্গের পরিসর কিছুটা বিস্তৃত হয়ে যায় বটে তবে বলা কর্তব্য! ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ কি আদেও সংস্কৃতির উপকার করছে? আমার সন্দেহ হয়। যে অভ্যাস মানুষের মাঝে বছরাবধি চর্চা হবার কথা ছিল, বই মেলার কল্যানে তা মাসাবধি হচ্ছে কেবল। এবং এখানে প্রকৃতি বইপ্রেমি এবং অনাগ্রহী পথাচারির সংখ্যা প্রায় সমান সমান। কিংবা পথচারীর সংখ্যাই অধিক।

প্রসঙ্গত বলা যায় কচ্ছপ ও খরগোশের সেই চিরায়ত গল্প। যেখানে খরগোশ দৌড়ে কচ্ছপ থেকে অনেক দ্রুতগামি দেখে ভেবে নিয়েছিল কিছুটা জিরিয়ে নেওয়ায় ক্ষতি নেই, সময় মত উঠে এক দৌড় দিলেই জয় সুনিশ্চিত! কচ্ছপ না থেমে একটু একটু করে ঠিকই জিতে গিয়েছিল। অন্যদিকে খরগোশ সেই দ্রুত গতির দৌড় শুরু করার আগে ঘুমিয়ে বেলা পার করে দিল। তার আর জেতা হলো না।

ব্যাপারটা তেমনি। আমেরিকায় সমগ্র বছরকে তিন থেকে চারটি ভাগে ভাগ করে বইয়ের বিজ্ঞাপন এবং প্রকাশনা হয়। ধরা যাক শীতকালে একটি বইয়ের বিজ্ঞাপন দেয়া হলো। এবারে বইটি বিভিন্ন সমালোচকের হাতে পাঠানো হয়, ব্লগার এবং মিডিয়া পার্সোনালকে দেয়া হয়। এবং শেষমেশ পরবর্তী গ্রীষ্মে কিংবা এক বছর পর বইটি প্রকাশিত হয়। এই সুদীর্ঘ সময়ে বইটি মানুষের মাঝে আলোচিত হয়। যারা আলোচনা করে তাদের এক অংশ সরাসরি প্রকাশকের সাথে যোগাযোগ করে বইয়ের ভাল মন্দ জানায়, যাতে প্রয়োজন হলে মার্কেটিং পলিসিতে কিছুটা পরিবর্তন আনতে পারেন পরিবেশক। আবার অনেকে সোশ্যাল মিডিয়া কিংবা নিউজ মিডিয়াতে বইটি নিয়ে স্বতঃস্ফূর্ত প্রচারণা শুরু করে দেয়। ফলে পাঠক আগেই বইয়ের প্রকৃতি সম্পর্কে অবহিত হয়, এবং যথা সময়ে প্রি-অর্ডার করে বইটি পেতে পারে। অনেকে আবার সোজা দোকানে গিয়ে লাইন ধরে। বইঘরে হিড়িক পড়ে যায় বই কেনার।

বইকে জনপ্রিয় করার জন্য পাশ্চাত্যের প্রকাশকরা বইয়ের সাথে বাড়তি হিসাবে বুকমার্ক দেয়, ম্যাপ কিংবা ব্যাগ দেয়, পোস্টার দেয়। অনেক বইঘর স্বয়ং লেখককে এনে বইয়ের সম্পর্কে কথা বলতে উৎসাহিত করেন, পাঠকেরা আসে, সরাসরি লেখকদের সাথে তাদের মোলাকাত হয়। বইটি লঞ্চও হয় কোনও না কোনও বইঘর থেকেই। সাংবাদিক-প্রকাশক-লেখক-পাঠক-বিক্রেতা সব এক কাতারে এসে বইকে গ্রহণ করে, সমৃদ্ধ করে। অথচ আমাদের দেশে সেই সংস্কৃতি কই? লেখক, পাঠক, প্রকাশক, বইঘর প্রত্যেকে এখানে যেন আলাদা সত্ত্বা! ভাবটা এমন- একে অন্যকে ছাড়া অনায়াসেই বাঁচতে পারে! বই ছাপিয়ে ফেললাম আর বিশ্বজগত উদ্ধার হয়ে গেল! কিংবা বই দোকানে তুললেই ষোলকলা পূর্ণ! ব্যাপারটা এত সহজ নয়। গাছে জল না ঢাললে, গাছের যত্ন সঠিক উপায়ে না নিলে গাছ বড় হবে কেন? যাচ্ছেতাই ভাবে গাছকে বাড়াতে চাইলে গাছ মরে যায়, বড় হয় না। আমাদের সংস্কৃতিতেও প্রকৃত অর্থে তা-ই হচ্ছে।

এর মধ্যেও কিছু উজ্জ্বল নক্ষত্র রয়েছে। এক বাক্যে বলা যায় চট্টগ্রাম শহরের বইঘর, ‘বাতিঘর’ -এর কথা। যারা বাংলাদেশের বিরূপ পরিবেশেও প্রতিকূলতা কাঁধে নিয়ে গড়ে তুলেছে একটি আধুনিক চিন্তাধারার বইঘর। যার ভেতরে ঢুকলেই মনে শান্তি আসে। যেখানে লেখকরা আসেন, পাঠকরা আসেন, বই দেখেন, বই পড়েন। দেশি বিদেশী বইয়ের অরিজিনাল কপি সংগ্রহ করা যায় যেখান থেকে। এসব বইঘরের প্রয়োজন দেশের সর্বত্র, অথচ আছে গুটিকয়েক।

এছাড়া অনলাইন ভিত্তিক বিক্রেতা রকমারি.কম কিংবা ফেসবুক ভিত্তিক কিছু বিক্রেতা সংস্থা নিজেদের মত চেষ্টা চালাচ্ছে স্বল্প পরিসরে।  

অপর দিকে পাশের দেশ ভারত বিখ্যাত বুক চেইন পেঙ্গুইন বুকসের সাথে অংশীদারিত্ব করে সুলভ মূল্যে বই তুলে দিচ্ছে তাদের পাঠককুলকে। আরও বড় বড় অনেক বিদেশী প্রকাশকরা সেখানে এসে বই লোকালাইজ করছেন। আমাজনের মত সুবিশাল অনলাইন সংস্থা সেখানে এসে নিরাপদে বই দিচ্ছে মানুষকে। নিরাপদ এবং ঝঞ্ঝাটহীন ব্যাংকিং এবং কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে তারা সাপোর্ট পাচ্ছে বই বিক্রয় গতিশীল ও উপযোগী করতে। সেখানে আমরা কি করছি? কিচ্ছু না। হাতে হাত রেখে বসে আছি। সভ্যতা ধ্বংস হতে দেখছি, সমাজ অবক্ষয়ের পথে যেতে দেখছি, সংস্কৃতি বিলীন হয়ে যেতে দিচ্ছি, সাহিত্যকে পদদলিত করার সুযোগ করে দিচ্ছি। বইকে ক্রমাগত চলে যেতে দিচ্ছি বিস্মৃতির অতলে।

নাহ, এভাবে চলবে না! চলতে পারে না। বইকে বাঁচাতে হবে, বইঘরকে বাঁচাতে হবে। যদি সংস্কৃতি বাঁচানোর ইচ্ছে থাকে তবে এর কোনও বিকল্প নেই। হয়তো একদিনে হবে না, হয়তো এক যুগেও হবে না, তবে চেষ্টা করলে অবশ্যই হবে। সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা পেলে হতে বাধ্য, সঠিক নিরাপত্তা পেলে, প্রকৃত পরিকল্পনা থাকলে হবেই হবে।

মানুষের নৈতিকতা সংশোধন একটি জটিল প্রক্রিয়া। যা ধ্বংসের পথে চলে গেছে, তা ফিরিয়ে আনা কঠিন। কিন্তু আমাদের ভেঙ্গে পড়লে চলবে না। হারুর সন্তানের মত যেন আপনার সন্তানও বইয়ের নাম শুনে প্রাচীন কল্পকথা বলে মনে না করে, সেই দায়িত্ব আপনাকেই নিতে হবে। বইঘরকে বাঁচাতে হবে, বই কে বাঁচাতে হবে। তবেই আপনার সন্তানও বাঁচবে উন্নত মানসিকতা নিয়ে, সংস্কৃতি বুকে করে, সভ্যতার অগ্রদুত হয়ে; অন্যথায় নয়।

———- X ———-

লিখেছেন- প্রান্ত ঘোষ দস্তিদার 

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

spot_img

সম্পর্কিত নিবন্ধ

জুতা (ছোট গল্প)- আফিন্দী

জুতাবিদ্যুৎ’এর গলার তেজে ফাঁকা মেসরুম গমগম করে উঠলো, “ভাই, তুমি যাবে পাঁচ ভাইয়ে? খিদেয় আমার জান যায়! খালা...

মৃত্যু পরবর্তী জগতের অভিজ্ঞতা 

মৃত্যু পরবর্তী জগতের অভিজ্ঞতা  মৃত্যু পরবর্তী জীবনের অভিজ্ঞতা কেমন? মানুষ তার অনিশ্চিত জীবনে শুধু একটি বিষয়ের নিশ্চয়তা নিয়ে জন্মেছে।...

বুক রিভিউ- হুমায়ূন আহমেদের ‘মেঘ বলেছে যাব যাব’

বুক রিভিউ- হুমায়ূন আহমেদের 'মেঘ বলেছে যাব যাব' বুক রিভিউ- হুমায়ূন আহমেদের 'মেঘ বলেছে যাব যাব'।বইয়ের নাম:মেঘ বলেছে যাব...

ডা. স্যাটান: সিরিয়াল কিলার ডা. মার্সেল পেটিওটের ভয়ংকর গল্প!

তাকে আখ্যা দেয়া হয়েছিল ডা. স্যাটান বলে। তিনি একই সাথে একজন সৈনিক, ডাক্তার, মেয়র, ভয়ঙ্কর অপরাধী এবং সিরিয়াল...