ব্যাড জিনিয়াস (২০১৭) রিভিউ

তারিখ:

পোস্ট শেয়ার করুন:

সিনেমা: ব্যাড জিনিয়াস (Bad Genius)

জনরা: থ্রিলার

দেশ: থাইল্যান্ড

পরিচালক: Nattawut Poonpiriya

কাস্টিং: Chutimon, Eisaya Hosuwan, C Santinatarnku, Teervadou, Warakulnukwa প্রমুখ।

রানিং টাইম: ২ ঘন্টা ১০ মিনিট।

আইএমডিবি: ৭.৬/১০

ব্যাড জিনিয়াস। স্কুল, কলেজে পড়ার সময় কেউকেউ স্বভাবত, কেউ বাধ্য হয়ে কেউবা কৌতূহলে; আমরা প্রায় সবাইই কমবেশি কখনো না কখনো নকল বা টুকলি করেছি। আমাদের হয়তো এমন বন্ধুও আছে যার মস্তিষ্কে নিউরন সংখ্যার চেয়ে পকেটে চিরকুটের সংখ্যা বেশি থাকত। নকল করার তো অনেক পদ্ধতি আছে যেমন চিরকুটে ছোটো ছোটো ভাঁজ,  স্মল ইকুয়েশন, বেঞ্চে লিখে রাখা, স্যার অমনোযোগী হলেই পেছনে কিংবা ডানে-বামে ঘাড় ঘোরানো, মাল্টিপল চয়েসের সময় আঙুল দেখিয়ে ক-খ-গ-ঘ বোঝানো, ইত্যাদি। এগুলো তো সচরাচর খুব কমন নকল পদ্ধতি।

কিন্তু, আজকে আপনাদের এমন একটি সিনেমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেব যেখানে একদল ছেলেমেয়ে পরীক্ষায় নকল করাকে আর্টের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে! এরাই হচ্ছে সিনেমার সেই ব্যাড জিনিয়াস। সত্য গল্প অবলম্বনে বানানো থাই ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম সেরা একটি সিনেমা- “ব্যাড জিনিয়াস।”

জেনে অবাক হবেন, পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় নকল গুলোর একটি সংঘটিত হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে STIC (SAT) Exam-এ। একটি আন্তর্জাতিক লেভেলের পরীক্ষায় কড়া নিরাপত্তাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এই সাংঘাতিক স্ক্যামটি ঘটায় থাইল্যান্ডের দু’জন শিক্ষার্থী। আর এই প্লটের উপর নির্ভর করে পরিচালক Nattawut Poonpiriya নির্মাণ করেন ”Bad Genius.” এই ঐতিহাসিক নকলের পদ্ধতি কী ছিল, প্ল্যানিং কীভাবে করেছিল, কেনই বা ক্যারিয়ারের রিস্ক নিয়ে তারা এ কাজ করেছিল এবং এর ফলাফল তাদের জীবনকে কোন দিকে মোড় নেওয়ায়; এ বিষয়গুলো নিয়েই সিনেমার কাহিনি এগিয়েছে। আর স্ক্রিন টাইমে দর্শককে পুরোটা সময় এক মাথা ঝিম ধরা সাসপেন্সের মধ্যে আটকে রেখেছে।

তাহলে আর দেরি কেন, আসুন জেনে নিই এই মাথা নষ্ট করা সিনেমাটির কাহিনী সম্পর্কে।

কাহিনী সংক্ষেপ:

ব্যাড জিনিয়াস
সংগৃহীত

সিনেমার কাহিনী মূলত ‘lynn’ নামের এক থাই ছাত্রীর পরীক্ষায় স্ক্যামিং-এর উপর নির্ভর করে বানানো।

লিন নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে। সে অসম্ভব মেধাবী। সে অনেকবার গণিত অলিম্পিয়াড জিতেছে। লিনের বাবা চান সে বিদেশে ভালো প্রতিষ্ঠানে স্কোলারশিপ নিয়ে পড়ুক। কিন্তু, স্কোলারশিপ দূরে থাক অ্যাডমিশন দেবার খরচও যোগান দেওয়া উনার জন্য কঠিন হয়ে যায়। লিনের বাবা সাধারণ স্কুল শিক্ষক তাই উনার পক্ষে স্বভাবতই লিনের উচ্চতর পড়াশোনার খরচ চালানো খুবই কষ্টকর। 

সিনেমার প্রথম দৃশ্যে দেখা যায়, লিন ও তার বাবা প্রিন্সিপালের কক্ষে অ্যাডমিশন সংক্রান্ত আলাপ করছে। প্রিন্সিপাল লিনকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি কি এই স্কুলে পড়তে চাও?’

লিন উত্তর দেয়, ‘হয়তো আমি আগের স্কুলেই ভালো ছিলাম। কেননা, সেখানে খরচ কম ছিল। এখানে এতটা খরচ বাবার পক্ষে যোগান দেওয়া সম্ভব না।’ শুধু তাইই না সে পুরো সেমিস্টারের খরচের পাই-টু-পাই হিসেব মুখেমুখে করে দেয়। প্রিন্সিপাল লিনের ট্যালেন্ট এবং পুরনো রেকর্ড দেখে তাকে উক্ত স্কুলে স্কোলারশিপে পড়ার সুযোগ করে দেন।

ক্লাসের প্রথম দিনে লিনের পরিচয় হয় একই ক্লাসের Grace এর সাথে। Grace লিনকে জানায় সে পড়াশোনায় দূর্বল। এবার যদি সে জিপিএ ৩.২৫ এর বেশি না পায় তাহলে স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হবে। লিন Grace কে অংক সমাধান করতে সাহায্য করে। শুধু তাইই না, লিন গ্রেসকে পরীক্ষায় ইরেজারের মাধ্যমে উত্তর কপি করিয়ে দেয় ফলে গ্রেস ৩.৭৫ পেয়ে যায়। এতে খুশি হয়ে গ্রেস লিনকে ওর বয়ফ্রেন্ডের বাড়িতে পার্টিতে ইনভাইট করে।

গ্রেসের বয়ফ্রেন্ড হলো একই ক্লাসের ছাত্র প্যাট। যে অত্যন্ত বিত্তশালী পরিবারের ছেলে। প্যাট গ্রেসের কাছে জানতে পারে লিন কীভাবে গ্রেসকে পরীক্ষায় সাহায্য করেছে। প্যাট গ্রেসকে প্রস্তাব করে তাকে ও তার আরও চারজন বন্ধুকে যদি পরীক্ষায় পাশ করতে সাহায্য করে তাহলে সাবজেক্ট প্রতি ৩০০০ বাথ করে পে করবে। যাতে প্রতি সেমিস্টারে লিনের ২,৩৪০০০ বাথ উপার্জন হবে। লিন প্রথমে কনফিউশনে থাকলেও যখন সে জানতে পারে স্কোলারশিপ পাবার পরেও তার বাবাকে চা-পানির জন্য দুই লক্ষ বাট দিতে হয়েছে তখন সে বুঝতে পারে, ‘তুমি চিট না করলেও, জীবন তোমার সাথে ঠিকই চিট করবে।’ তাই সে প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়।

সংগৃহীত

লিন খুব ভালো পিয়ানো বাজাত। সে পিয়ানোর কর্ড ব্যবহার করে নকলের এক অভিনব কৌশল ভেবে বের করে এবং তা রপ্ত করে। এরপর সবাইকে তা রপ্ত করিয়ে পরীক্ষায় প্রত্যেককে নকল করতে সাহায্য করে। কিন্তু, সহপাঠী টং-এর সাথে খাতা অদলবদল করতে গিয়ে সামান্য ভুল হওয়ায় এবং Bank নামের এক সহপাঠীর অভিযোগে লিন ধরা পরে যায়।

সংগৃহীত

ব্যাংক হলো লিনের মতো আরেক ট্যালেন্টেড স্টুডেন্ট। ব্যাংক ও তার মা একটি লন্ড্রির দোকান চালায়। সেও স্কোলারশিপে স্কুলে চান্স পেয়েছে। লিন ও ব্যাংকের পরিচয় হয় এক গণিত অলিম্পিয়াডে। যেখানে ওরা যৌথভাবে নিজেদের স্কুলকে রিপ্রেজেন্ট করে। ব্যাংক পাই-এর মান হুবহু মুখস্থ বলে দিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়। লিন বুঝতে পারে একদিন হয়তো ব্যাংককে তার কাজে লাগবে।

সংগৃহীত

এরই মাঝে ঘটে যায় আরেক কান্ড। প্যাট তার বাড়িতে গ্রেসকে পরিচয় করিয়ে দেয়। প্যাটের বাবা-মা শর্ত জুড়ে দেয় যদি তারা STIC বা স্যাট এক্সামে পাশ করতে পারে তবেই তাদের সম্বন্ধ মেনে নেবেন, অন্যথায় না।

গ্রেস লিনের কাছে গিয়ে কান্নাকাটি করে এবং অনুরোধ জানায়। লিন বলে, অসম্ভব। কেননা, এটি আন্তর্জাতিক লেভেলের পরীক্ষা। আর এই পরীক্ষাটি পুরো বিশ্বে একই সময়ে অনুষ্ঠিত হয়। লিন রাজি না হলে পরবর্তীতে তাকে অফার করে STIC exam-এ পাশ করাতে পারলে তাকে ৬ লক্ষ বাথ দেওয়া হবে। গ্রেস অনেক ভাবার পরে রাজি হয়ে যায় এবং সে নকলের উপায় খুঁজে বের করে।

সংগৃহীত

সে গ্রেস এবং প্যাটকে শর্ত জুড়ে দেয় এরজন্য তার আরও ক্লায়েন্ট লাগবে যাতে সে আরও বেশি অর্থ উপার্জন করতে পারে। কিন্তু, পুরো কাজটি তার একার পক্ষে করা সম্ভব ছিল না তাই তার ব্যাংকের সাহায্যের প্রয়োজন ছিল। 

কিন্তু, ব্যাংক ছিল অত্যন্ত সৎ। মোটা অংকের টাকার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়। সে কোনোভাবেই রাজি হতে চায় না। তখন লিন তাকে বিখ্যাত ডায়ালগটি দেয়, “But don’t you see, even if you don’t cheat… life cheats you anyways.”

ব্যাংক বাস্তবতা বুঝতে পেরে একসময় রাজি হয়ে যায়। শুরু হয় তাদের দুঃসাহসিক এক পরিকল্পনার। কী ছিল সেই পরিকল্পনা? যা তোলপাড় করে দেয় পৃথিবীকে? সেই বিস্ময় জাগানিয়া ঘটনার বাকীটুকুর স্পয়লার না দিই। নিজেই দেখে নিন, আর ফিল করুন প্রতি মূহুর্তে থ্রিল আর সাসপেন্স!

গুরুত্বপূর্ণ দিক সমূহ:

অভিনয়:

মূলত, লিন-ব্যাংক-প্যাট-গ্রেস এই চারটি চরিত্র সিনেমায় মূখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেছে। প্রত্যেকের অভিনয় ছিল নিজনিজ চরিত্রের বিচারে একদম ঠিকঠাক, মানানসই। বিশেষ করে, লিন চরিত্রে Chutimon Chuengcharoensukying এর। নামের মতোই সাংঘাতিক রকমের অভিনয় করেছে মেয়েটি। পুরোটা সময় নিজের দিকে আকর্ষণ ধরে রেখেছে। মনে হবে, লিন চরিত্রটি আপনি নিজেই। বুকের মধ্যে ধপধপ করবে এই বুঝি ধরা পড়ে গেলাম! বাকীদের অভিনয় নিয়েও অভিযোগ করার মতো কিছু নেই।

স্ক্রিনিং অ্যান্ড মেকিং:

নরমালি থ্রিলার সিনেমাগুলোতে মুভির থ্রিল খুঁজে পেতে একটু সময় লাগে, আস্তে আস্তে থ্রিল পেতে শুরু করে। কিন্তু, এই সিনেমাটি ব্যতিক্রম। এখানে আপনি শুরু থেকেই থ্রিলিং অনুভব করতে পারবেন।

সাধারণত খুব কম সিনেমা ই দেখা যায় যেখানে এত গোছানো এবং পারফেক্ট স্ক্রিনিং থাকে। এছাড়া, সিনেমার গল্পটিও ইউনিক। বিজিএম, লোকেশন সেট-আপ, কাস্টিউম সবকিছুই মোটামুটি ঠিকঠাক ছিল। চোখে লাগার মতো তেমন লুপ-হোল নেই। আর এইজন্যই দর্শক টানার সব এলিমেন্টই সিনেমাতে রয়েছে। এখানে এক মিনিটও বোরিং হবার সু্যোগ নেই। সত্য ঘটনা নির্ভর সিনেমা গুলো বানানো বেশ শক্ত হয়ে থাকে, কিন্তু পরিচালক খুব যত্নে ও সাবধানতার সাথে বাস্তব এবং কল্পনার সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন। যেন, ঠিকঠাক পরিমাণ মতো নুন, তেল, মসলা মিশিয়ে পরিমিত তাপে রান্না করা এক অমৃত! যার রেশ থেকে যায় অনেকদিন।   

পরিশিষ্ট:

সিনেমাটি থাই ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম ব্যবসা সফল একটি সিনেমা। সিনেমাটি বক্স অফিসে প্রায় ৪২.৩৫ মিলিয়ন ডলার আয় করে নেয়। Asia Pacific Film Festival এ মোট ৭ টি নমিনেশন পায় এবং দুইটিতে বিজয়ী হয়। এছাড়াও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও জাতীয় অঙ্গনে পুরষ্কারের পাশাপাশি ক্রিটিকস মহলেও ভীষণ প্রশংসিত হয়।

তাই গতানুগতিক সিনেমার ভিড়ে ভিন্ন কিছু দেখতে চাইলে দেখে নিতে পারেন এই মাস্ট ওয়াচ মাস্টারপিস সিনেমাটি। ধন্যবাদ। 

রিভিউ করেছেন drishty rubayet

সিনেমার গল্পসল্প

 

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

spot_img

সম্পর্কিত নিবন্ধ

জুতা (ছোট গল্প)- আফিন্দী

জুতাবিদ্যুৎ’এর গলার তেজে ফাঁকা মেসরুম গমগম করে উঠলো, “ভাই, তুমি যাবে পাঁচ ভাইয়ে? খিদেয় আমার জান যায়! খালা...

মৃত্যু পরবর্তী জগতের অভিজ্ঞতা 

মৃত্যু পরবর্তী জগতের অভিজ্ঞতা  মৃত্যু পরবর্তী জীবনের অভিজ্ঞতা কেমন? মানুষ তার অনিশ্চিত জীবনে শুধু একটি বিষয়ের নিশ্চয়তা নিয়ে জন্মেছে।...

বুক রিভিউ- হুমায়ূন আহমেদের ‘মেঘ বলেছে যাব যাব’

বুক রিভিউ- হুমায়ূন আহমেদের 'মেঘ বলেছে যাব যাব' বুক রিভিউ- হুমায়ূন আহমেদের 'মেঘ বলেছে যাব যাব'।বইয়ের নাম:মেঘ বলেছে যাব...

ডা. স্যাটান: সিরিয়াল কিলার ডা. মার্সেল পেটিওটের ভয়ংকর গল্প!

তাকে আখ্যা দেয়া হয়েছিল ডা. স্যাটান বলে। তিনি একই সাথে একজন সৈনিক, ডাক্তার, মেয়র, ভয়ঙ্কর অপরাধী এবং সিরিয়াল...