প্লট আর্কিটাইপ পর্ব ২ লিখেছেন- আশরাফুল সুমন
প্লট আর্কিটাইপ—পর্ব ২
৪। কমেডি:
আর্কিটাইপগুলোর ভেতর সবচেয়ে কঠিন এবং বিভ্রান্তিকর। এর ইতিহাস, বিস্তৃতি আর ভ্যারিয়েশন এত বেশি যে একে বর্ণনা করা বা কাঠামোর মাঝে ফেলাটাই কঠিন (বুকারকে ধন্যবাদ)। প্রথমেই বলে রাখি, কমেডি জনরা আর বুকারের প্লট আর্কিটাইপ ‘কমেডি’ একই না। অডিয়েন্সকে হাসানোর উদ্দেশ্যে করা কাজকে কমেডি জনরার আওতায় ধরা হয়। এখন সেটা শুধুই ‘হাসিয়ে-দিলাম-আর-হয়ে-গেল’ জাতীয় কাজও হতে পারে, আবার মজার ছলে উপস্থাপিত গভীর সাহিত্যিয় কাজও হতে পারে। অন্যদিকে, বুকারের ‘কমেডি’ আর্কিটাইপ হলো সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞার ভেতর পড়া একটা কাঠামো, যেটা আসলে প্লট স্ট্রাকচার না, জনরাও না, প্লটের আর্কিটাইপ বা মূল বস্তু। সংক্ষেপে, প্রত্যেক কমেডি আর্কিটাইপই ‘কমেডি জনরা’, তবে কমেডি জনরার প্রত্যেক গল্পই কমেডি আর্কিটাইপ না।
বুকারের ‘কমেডি’ আর্কিটাইপ হলো সেই রোমান্টিক গল্পগুলো যেখানে নায়ক-নায়িকা পরস্পরকে পছন্দ করে, বা তাদের মাঝে প্রেম হবে বলে আমরা আশা রাখি, তারপর তাদের মাঝে কোনো একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়, বা একজন আরেকজনকে ভুল জায়গায় ভুল সময় দেখে ফেলে উলটা-পালটা ভেবে দূরে সরে যায়, অথবা কোনো একটা বাধা তাদের মিলনকে অসম্ভব করে তোলে। অবশেষে এই বিভ্রান্তি দুইজনের কাছে প্রকাশ করা হয়, বা তাদের মাঝের বাধাটা সরে যায় এবং ‘অতঃপর তারা সুখে শান্তিতে বসবাস করতে থাকে’।
তার মানে হলো, কোনো গল্প কেবল হাস্যরসে ভরপুর হলেই সেটা কমেডি আর্কিটাইপের ভেতর পড়ে না (তবে অবশ্যই কমেডি জনরায় পড়ে)। কমেডি আর্কিটাইপ হতে হলে তাকে কিছু নিয়ম অনুসরণ করতে হয় আর একটা ছাঁচের ভেতর পড়তে হয়। পূর্বের অন্য প্লট আর্কিটাইপগুলোর ক্ষেত্রে গঠন ব্যাখ্যা না করলেও এটার ক্ষেত্রে বোঝার সুবিধার্থে করছি। বুকারের মতে, এই আর্কিটাইপের তিনটা ধাপ আছে।
ধাপ ১: বিভ্রান্তির ছায়া (The shadow of confusion)
নায়ক-নায়িকাকে অডিয়েন্সের কাছে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। আমরা বুঝতে পারি, এদের একত্রে সুখে-শান্তিতে বসবাস করার কথা। কিন্তু তাদের মাঝখানে কোনো একটা বাধা এসে দাঁড়ায়। এই বাধা জন্ম নেয় হয়তো কোনো একটা ভুল বোঝাবুঝির কারণে, নইলে একজন অপরজনের কথা বা কাজের ভুল অর্থ করার কারণে (বিভ্রান্তি), কিংবা অন্য যেকোনো বাহ্যিক বা অভ্যন্তরীণ শক্তির কারণে। এরপর তারা আলাদা হয়ে যায় বা মনে হয় তাদের মাঝে মিল সম্ভব না। এই আলাদা হয়ে যাওয়াটা শারীরিক দূরত্ব হতে পারে, বা হতে পারে পাশাপাশি থেকেও তৈরি হওয়া মানসিক দূরত্ব। সোজা কথায়, যেকোনো মানবিক, দানবিক, প্রাকৃতিক শক্তি তাদের পরস্পর থেকে আলাদা করে দেয় বা তাদের মিলনকে আপাত অসম্ভব করে তোলে। আর এই বিভ্রান্তি বা বাধার কারণে একের পর এক উদ্ভট/হাস্যকর ঘটনার অবতারণা হতে পারে। আবার হাস্যরসাত্মক ঘটনা নাও থাকতে পারে। আগেই বলেছি হাস্যরস এখানে মুখ্য না। এরপরেও এর নাম কেন কমেডি সেটা একদম শেষে ব্যাখ্যা করবো।
ধাপ ২: ঘনীভূত সংকট (It gets worse)
শুরুর সেই বিভ্রান্তি, ভুল বোঝাবুঝি, মানবিক/দানবিক/প্রাকৃতিক বাধা আরো ঘনীভূত হয়। আরো শক্তিশালী হয়ে তার সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছে যায়। অডিয়েন্সের মনে হয়, ‘নাহ, এ আর সম্ভব না রে, পাগলা।’
ধাপ ৩: বিভ্রান্তির পতন (The confusion is lifted)
কেউ একজন বা কিছু একটার মাধ্যমে এই বিভ্রান্তির ব্যাখ্যা করা হয়। হয়তো মূল সমস্যাটা যে লাগিয়েছে সে নিজের ভুল স্বীকার করে। বা তাকে শাস্তি দেওয়া হয়। নইলে যে বা যারা বিভ্রান্তির মূল উৎস ধরতে পারে তারা ব্যাখ্যা করে। এরপর প্রেমিক-প্রেমিকা আবার একত্র হয়। তারপর বিয়ে করে সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে থাকে।
সব কমেডি যে উপরের গঠনটাকে চোখ বন্ধ করে অনুসরণ করে তাও কিন্তু না। আগেই বলেছি, এই আর্কিটাইপকে ব্যাখ্যা করা সবচেয়ে কঠিন। আমি অনলাইন পোস্ট হিসেবে যতটা সম্ভব সংক্ষেপে বোঝানোর চেষ্টা করছি, অনেক আলোচনা বাদ দিয়েই। যারা আরো জানতে চান, তাদের বলি, আপনারা এই প্লট আর্কিটাইপ (এবং আরো যত ধরনের আর্কিটাইপ আছে) সেগুলো সম্পর্কে আরো অনেক বিস্তারিত আকারে এবং আরো উদাহরণসহ জানতে পারবেন এই লেখাগুলো বই আকারে প্রকাশিত হওয়ার পর। আমি অনেক আগে থেকেই লেখালেখির মৌলিক এবং গঠনগত ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে বেশ কয়েকটি বই লেখার পরিকল্পনা করে রেখেছি, আর সেই অনুযায়ী কোন বইতে কোন কোন টপিকগুলো থাকবে তাও ঠিক করে রেখেছি। এই লেখাগুলো নিয়ে যে বইটি আপনারা হাতে পাবেন সেটিতে যে শুধু প্লট আর্কিটাইপগুলোকে আরো বিস্তারিত আর আরো ব্যাখ্যা/উদাহরণসহ দেওয়া হবে তাই না, সাথে থাকবে ক্যারেক্টার এবং সিম্বল আর্কিটাইপ সম্পর্কে বিস্তারিত। সেই সাথে থাকবে প্লট স্ট্রাকচার নিয়ে গভীর আলোচনা। আপাতত অনলাইনে এই প্লট আর্কিটাইপ নিয়ে আলোচনার পরেই কিছু বেসিক প্লট স্ট্রাকচার—যেমন, ফ্রেইট্যাগের পিরামিড, হিরোজ জার্নি, থ্রি এক্ট স্টোরি স্ট্রাকচার আর ফিক্টিয়ান কার্ভ—নিয়েও সংক্ষেপে আলোচনা পোস্ট দেবো।
এবার উদাহরণে আসি। এখানে চাইলে শেক্সপিয়ারের কমেডিগুলোর উদাহরণ দেওয়া যায়, তবে সেগুলো এবং বাংলা সাহিত্যের উদাহরণগুলো বইয়ের জন্যেই ফেলে রাখলাম। এখানে বরং একটা সহজ উদাহরণ দেই।
‘এলা এনচান্টেড’-এ এলা নামের একটি মেয়েকে জন্মের সময় এক পরী ‘আনুগত্যের উপহার’ প্রদান করে। এর ফলে এলাকে যে আদেশই দেওয়া হোক না কেন, সে ওটা মানতে বাধ্য থাকে। একসময় এলার সাথে পরিচয় হয় রাজকুমার চারমন্টের। এলার সৎ বোনেরা এতে ওর প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়। ওরা তার গোপনীয়তা সম্পর্কে জেনে ফেলে সেটাকে ব্যবহার করে তাকে ভীষণ অপমান করে। হতাশ এলা সেই পরীকে খুঁজতে বের হয় যে ওকে ছোটবেলায় সেই উপহার দিয়েছিলো। ধীরে ধীরে এলা আর চারমন্ট দুইজনেই পরস্পরকে ভালোবেসে ফেলে।
চারমন্টের চাচা এডগার এলার গোপনীয়তা সম্পর্কে জেনে যায়। তাকে সে আদেশ করে চারমন্টকে খুন করতে। জানায়, চারমন্টের বাবাকেও সে-ই খুন করেছে, এবং এখন চারমন্টকে তার অভিষেকের আগেই খুন করলে সে রাজ্যের রাজা হতে পারবে। এলা বুঝতে পারে তার এই ‘উপহার’ চারমন্টের ক্ষতি করতে পারে। তাই সে ওকে একটা চিঠি লিখে, জানায় যে সে চলে যাচ্ছে, কিন্তু কেন যাচ্ছে তার ব্যাখ্যা দিতে পারবে না। এরপর সে তার এক বন্ধুকে দিয়ে নিজেকে গাছের সাথে বেঁধে রাখে। (গল্পের এই অংশটুকু হলো ‘বিভ্রান্তির ছায়া’)।
রাতে সেই পরী তার কাছে আসে। এলা তাকে তার উপহার ফিরিয়ে নিতে অনুরোধ করলে সে ভীষণ বিরক্ত হয়। ওর বাঁধন খুলে দিয়ে বলে, ও যেন নিজেই নিজেকে উপহার থেকে মুক্ত করার উপায় খুঁজে নেয়। বাঁধনমুক্ত হতেই এলা বাধ্য হয় প্রাসাদে যেতে। চারমন্ট ওকে দেখতে পেয়েই একটা আয়না দিয়ে ঘেরা রুমে নিয়ে যায়, প্রপোজ করে। এলার হাতে তখন উদ্যত ছুরি, চারমন্টের বুকে বসিয়ে দেবে এখুনি। এরই মাঝে তার মাথায় আসে ব্যাপারটা। সে আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে আদেশ দেয়, আজ থেকে সে আর কখনো কারো আদেশ মানতে বাধ্য হবে না। জাদুটা ভেঙে যায়। কিন্তু এলার হাতের ছুরিটা দেখে ফেলে চারমন্ট। এডগারের আদেশে এলাকে অন্ধকূপে ছুঁড়ে দেওয়া হয়। (এই অংশটা হলো ‘ঘনীভূত সংকট’)।
এলার বন্ধুরা তাকে মুক্ত করে। জানায়, এডগার তার ভাতিজার মুকুটে বিষ মাখিয়েছে। ওরা সবাই চারমন্টের অভিষেক অনুষ্ঠানে যায়। সেখানে বেশ কিছু কাহিনির পর অবশেষে চারমন্ট বুঝতে পারে তার চাচাই সবকিছুর পেছনে আছে। ফলে এলা আর তার মাঝের বিভ্রান্তি কেটে যায়। এদিকে এডগার নিজেকে রাজা ঘোষণা করে বোকার মতো মুকুটটা নিজেই পরে ফেলে। তারপর অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যায়। অবশেষে এলা আর চারমন্টের প্রেমের পরিণতি হয়। তারা বিয়ে করে সুখে শান্তিতে বাস করতে থাকে। (এইটুকু অংশ হলো ‘বিভ্রান্তির পতন’)।
আরো উদাহরণ: প্রাইড এন্ড প্রিজুডিস, এ সিন্ডারেলা স্টোরি, এ মিডসামার নাইটস ড্রিম, ফ্রোজেন, কমেডি অব এররস, দ্য টেমিং অব দ্য শ্রু।
কমেডি নিয়ে আলোচনা করতে গেলে আসলে শেষই হবে না। তারপরেও কিছু কথা না বলে পারছি না। কমেডির একদম সাধারণ কাঠামোতে চারটা উপাদান থাকে।
ক) একজন ডার্ক ফিগার, যার কারণে এই বিভ্রান্তি। বা যার কারণে নায়ক-নায়িকা একত্র হতে পারছে না। সে হতে পারে নায়িকার অত্যাচারী, গোঁয়ার মা, যে দুনিয়া উলটে গেলেও নায়ক-নায়িকাকে একত্র হতে দেবে না (সব সময় বাবাদেরকেই কেন ডার্ক ফিগার হতে হবে?)। গল্পের শেষে এরা হয় নিজের ভুল বুঝতে পারে, নয়তো তার কৃতকর্মের শাস্তি পায়। এলা এনচান্টেডে এই ডার্ক ফিগার হলো এডগার। তবে এই ‘ডার্ক ফিগার’-যে সব সময় মানব/দানব/প্রাণী হবে তাও না। এর স্থানে প্রাকৃতিক কোনো বাধাও আসতে পারে। সেক্ষেত্রে সেটা হবে ‘ধোঁয়াশা’। আর এর ফলেই জন্ম নেবে ‘বিভ্রান্তি’।
খ) এক বা একাধিক চরিত্রের প্রকৃত পরিচয় নিয়ে অস্পষ্টতা থাকে। তারা কিছু একটা ‘রহস্য’ গোপন করে। আর এই রহস্যই শেষে গিয়ে প্রকাশিত হয়। উদাহরণে এলা নিজেই এই রহস্যময়ী চরিত্র।
গ) প্রেমিক যুগলের প্রেমের পরিণতির মাঝে কোনো বাধা থাকে। হতে পারে সেটা একপাক্ষিক প্রেম, বা একজন অপরজনকে সন্দেহ করে, ভুল বুঝে। বা হয়তো তারা এখনো প্রেমেই পড়েনি। গল্পের শেষে এদের মাঝে অবশ্যই মিল হবে। উদাহরণে দেখুন, এলার ‘উপহার’-এর কারণে আর তার নিজের রহস্য চারমন্টের থেকে গোপন করার কারণে তাদের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। অবশ্য, এই দূরত্ব সৃষ্টিতে আমাদের ‘ডার্ক ফিগার’ এডগারেরও হাত আছে।
ঘ) পরিবারগুলোর মাঝে কিংবা চারপাশের বিভিন্ন চরিত্রগুলোর মাঝে অপূর্ণতা থাকে। গল্পের শেষে এই অপূর্ণতা কেটে যায়। সবকিছু জায়গামতো বসে যায়, পরিবারে ভাঙন থাকলে জোড়া লেগে যায়। উপরের উদাহরণে ঠিক এটাই হয়। সবাই যার-যার প্রাপ্যটা পায়। ভিলেন তার শাস্তি পায়। প্রেমিক তার প্রেমিকা পায়। বাকিদেরও সবকিছু খাপে খাপে বসে যায়।
এবার এই প্লট আর্কিটাইপ নিয়ে বিভ্রান্তির জায়গাটা বলি। নাম তার কমেডি, কিন্তু কমেডিক উপাদান এখানে মুখ্য না। রোমান্স মুখ্য। তবে তা কীভাবে কমেডি হয়? এটা বুঝতে হলে এর আদিতে ফিরে যেতে হবে।
ধারণা করা হয়, কমেডির উৎপত্তি গ্রিসে। একদম প্রথম দিকের কমেডিগুলো সুগঠিত ছিলো না। এদের বলা হতো ‘ওল্ড কমেডি’। এরিস্টোফেনিসের মাধ্যমে সূচনা হয় এর। তার কমেডিগুলো বিচার করলে দেখা যায়, এখানে দুই ধরনের চরিত্রের মাঝে সংঘর্ষ থাকে: প্রথম ধরনের চরিত্রের কোনো ডার্ক অবসেশন থাকে। দ্বিতীয় ধরনের চরিত্র সত্যটা দেখতে পায়। তারা হয় স্বাধীনতা আর আলোর প্রতীক। এরিস্টোফেনিসের কমেডি বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই, সেখানে কোনো চরিত্রের ‘ডার্ক অবসেশন’ থাকে, আর সে ওটার প্রতি খুব মনোযোগ দেয়। একটা সময় মনে হয় কোনো কিছুই তাকে সেটা থেকে আর সরাতে পারবে না। তারপর অবশেষে তার কাছে সত্যটা প্রকাশিত হয়। সে ‘অনুধাবন’ করতে পারে তার সেই অবসেশন নিজের এবং সবার ক্ষতি করছে। সে ‘রূপান্তরিত’ হয়, সেই অবসেশন ছেড়ে দেয়, তারপর পরিণত হয় আগের চেয়ে উত্তম কোনো রূপে।
Lysistrata-তে দেখা যায়, এথেন্সের মহিলারা তাদের স্বামীদের অতি যুদ্ধাবেগের প্রতি ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে একটি কঠোর সিদ্ধান্তে আসে; স্বামীদের সাথে মেলামেশা বন্ধ করে দেয় তারা, মানে সেক্স-বঞ্চিত করে। ওসব করতে চাইলে আগে যুদ্ধ বন্ধ করে দেখাও, তারপর ভেবে দেখবো নে—এই জাতীয় ব্যাপার-স্যাপার আর কি। বেশ কিছু সময় সবকিছু বিভ্রান্তির ভেতর থাকে। একটা সময় স্বামীরা বুঝতে পারে, তাদের জীবনে আসলে কোনটা বেশি দরকার। তারা বুঝতে পারে, যুদ্ধ নয়, ঘরের শান্তি বজায় রাখাই আসল মানবধর্ম।
একইভাবে, The wasps নামের কমেডিতেও একজন বাবার ‘ডার্ক অবসেশন’ থাকে বিচারকার্যের প্রতি। এতটাই যে তার সামনে যাকেই আনা হোক, তাকেই সে অপরাধী হিসেবে সাজা দেয়। তারপর একদিন তার ছেলে কোনো একটি বিচারের দিন বাবাকে বোকা বানিয়ে শাস্তি প্রদান করা থেকে বিরত করে ফেলে। জীবনে প্রথমবারের মতো নিজের আদালতে কাউকে নির্দোষ বলে ঘোষণা দেয় বিচারক (আসলে ভুল করে দিয়েছে এই রায়)। বাবা শুরুতে ছেলের উপরে রেগে গেলেও পরে বুঝতে পারে, সারাক্ষণ এই বিচারিক কাজে নাক ডুবিয়ে রেখে সে আসলে জীবন থেকে কতকিছুই না হারাচ্ছে। বুঝতে পারে, বিচারকার্যের প্রতি এই অতি-আসক্তি তাকে তার নিজের কোর্টেই বন্দি করে রেখেছিলো এতদিন। আর এখন সে এই গুরুভার আর বন্দিদশা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। তার ‘অনুধাবন’ হয়, এবং সে পরিণত হয় খুবই আমোদপ্রিয় এক ব্যক্তিতে।
‘নিউ কমেডি’-র যখন আবির্ভাব হয়, তখন আগের সেই রূপ এমনভাবে পরিবর্তি হয়ে যায় যে মনে হয় পুরো খোলসই নতুন রূপ ধারণ করেছে। কমেডি তখন পরিণত হয় রোমান্টিক গল্পে। তবে রোমান্টিক হয়ে গেলেও তাতে মূল বস্তুটা রয়ে গেছে। সেই ‘ডার্ক ফিগার’ আর তার ‘ডার্ক অবসেশন’। বা কোনো ‘ধোঁয়াশা’, যার আড়ালে চরিত্রগুলো ঢাকা পড়ে। শেষে ঐ ডার্ক ফিগারের ‘অনুধাবন’ এবং ‘রূপান্তর’ কিংবা শাস্তি। অথবা অনুধাবনের আলোয় সেই ধোঁয়াশার বিভ্রান্তির কেটে যাওয়া। এই যে কেউ একজন তার মূল সমস্যাটা ধরতে পারে না, উলটো তাকে সঠিক মনে করে তা নিয়েই বড়াই করে (ডার্ক ফিগারের ক্ষেত্রে), পৃথিবীতে এর চেয়ে বড় কমেডি আর কী আছে? আবার, প্রেমিক যুগল যে বিভ্রান্তির কারণে পরস্পর থেকে পৃথক হয়ে যায়, সেই পুরো ব্যাপারটার স্বরূপ তারা নিজেরা ধরতে না পারলেও পাঠক/দর্শকরা ঠিকই ধরতে পারে। আর ‘কমেডি’-টা এখানেই। চরিত্রগুলো জানেই না কী ‘কমেডি’ হয়ে যাচ্ছে তাদের সাথে, কিন্তু পর্দার ওপাশে থাকা ওরা ঠিকই ধরতে পারছে। ওরা ধরতে পারছে প্রেমিক যুগলের মাঝে ঝামেলাটা লেগেছে ঠিক কোন কথাটার সম্পূর্ণ ভুল অর্থ বোঝার কারণে, ওরা ধরতে পারছে ‘ডার্ক অবসেশন’ যার আছে সে তার প্রকৃত সত্য সম্পর্কে কতটা অজ্ঞ। আর এ কারণেই এই আর্কিটাইপের এমন নাম।
আর বিস্তারিত আলোচনায় যাচ্ছি না আপাতত।
ভালো কথা, এমন যদি হয় যে সেই ডার্ক ফিগার গল্পের শেষেও ‘অনুধাবন’ করতে না পারে? ‘রূপান্তরিত’ না হয়? যদি সে নিজেই গল্পের হিরো/হিরোইন হয়? যদি শেষে প্রেমিক যুগলের মিল না হয়? সবকিছুর হ্যাপি এন্ডিং না হয়? একই গঠনে শুরু করে এই ভিন্নতা নিয়ে শেষ হলে কি তবে তা কমেডি থাকবে?
এই প্রশ্নের জবাব দিতেই আমরা চলে যাবো পরবর্তী প্লট আর্কিটাইপে।
৫। ট্র্যাজেডি: উপরের প্রশ্নের উত্তর হলো, যদি এমনটা হয়, তবে যা হবে সেটা আর কমেডি থাকবে না, হয়ে যাবে ট্র্যাজেডি। এটি হলো কমেডির দর্পন প্রতিবিম্ব। এই ধরনের আর্কিটাইপে প্রধান চরিত্রের কোনো ডার্ক অবসেশন, চরিত্রগত ত্রুটি বা ভুলের কারণে সে বা তার খুব কাছের কেউ মর্মান্তিক পরিণতি বরণ করে। মৃত্যুর চেয়ে অন্তিম এবং চূড়ান্ত পরিণতি আর কী আছে এ জগতে?
ট্র্যাজেডি আর্কিটাইপের পাঁচটি স্তর থাকে। আমি এই পাঁচটি স্তর ব্যাখ্যা করবো একটি উদাহরণ দ্বারা।
ধাপ ১: আকাঙ্ক্ষার পর্যায় (Anticipation stage): এই ধাপে গল্পের নায়ক/নায়িকার ভেতর কোনো একটি ব্যাপারে অপূর্ণতা প্রকাশ পায়। আর তারপর কারো মাধ্যমে এমন কিছু তাদের সামনে আসে, যাতে তার মনে হয় এটা পেলে তার অপূর্ণতা কাটবে। সেই কিছু একটার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে তারা। আর এই চাওয়া থেকেই তৈরি হয় এন্টিসিপেশন। আকাঙ্ক্ষা।
শেক্সপিয়রের ট্র্যাজেডি ম্যাকবেথের এই ধাপে দেখা যায় জেনারেল ম্যাকবেথ আর ব্যানকুও সদ্য যুদ্ধজয় করে ফিরে এসেছে। তখন রহস্যময় তিন নারী তাদের বলে ম্যাকবেথ তিনটি উপাধি পেতে যাচ্ছে ভবিষ্যতে, যার মাঝে শেষেরটি হচ্ছে ‘রাজা’। সেই সাথে তারা ব্যানকুওর সম্পর্কে বলে, সে ‘রাজা’ হতে না পারলেও তার ছেলেরা ঠিকই রাজা হবে একদিন। শীঘ্রই ওরা জানতে পারে, ঐ তিন উপাধির মাঝে প্রথম দুইটি উপাধি রাজা ডানকান ইতোমধ্যেই ম্যাকবেথকে উপহার দিয়েছে। ফলে, তৃতীয় উপাধি ‘রাজা’-র জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে সে। ডানকানকে হত্যা করার পরিকল্পনা করে।
ধাপ ২: স্বপ্নিল পর্যায় (Dream stage): এই ধাপে আমাদের নায়ক তার অলুক্ষুণে পরিকল্পনায় সাময়িক বিজয়ী হয়। বেশ কিছুদূর পর্যন্ত সে যা চায় তাই হতে থাকে। তার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হতে থাকে একের পর এক, সে ক্রমান্বয়ে হয়ে ওঠে আরো অপ্রতিরোধ্য। একসময় মনে হয়, ওকে হারাতে পারে এমন কেউই এই দুনিয়ায় জন্ম নেয়নি।
এই ধাপে জেনারেল ম্যাকবেথ তার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করে ফেলে। ডানকানকে হত্যার পর তার দুই ছেলে পালিয়ে ইংল্যান্ডে চলে যায়। সবাই ধরে নেয়, রাজার হত্যায় ওদের হাত আছে দেখেই ভয়ে পালিয়েছে। এদিকে রাজার মৃত্যুর পর সেই ৩য় উপাধির মালিক হয় ম্যাকবেথ। ‘রাজা’ হয়ে বসে স্কটল্যান্ডের সিংহাসনে।
ধাপ ৩: হতাশার পর্যায় (Frustration stage): এই পর্যায় থেকেই নায়কের পতনের শুরু হয়। হঠাৎ করেই তার বিরুদ্ধে একের পর এক ঘটনা ঘটতে থাকে। ফলে নিজের অবস্থানকে আরো সুসংহত করার জন্য সে পূর্বের চেয়ে আরো বেশি ভয়ানক কাজ করতে শুরু করে। আসলে এসব করার মাধ্যমে সে তার অন্তিম পরিণতিই সুনিশ্চিত করে কেবল। এই ধাপে এমন কারো আগমন ঘটতে পারে যার হাতে তার অন্তিম পরিণতি হবে।
ম্যাকবেথ তার বন্ধু ব্যানকুওকে সন্দেহ করতে থাকে। তার মনে হতে থাকে, ওর নিজের ছেলেরা নয়, বরং ব্যানকুওর ছেলেরাই স্কটল্যান্ডের সিংহাসনে বসবে (কারণ ঐ তিন জাদুকরী বলেছিলো ব্যানকুওর ছেলেরা ‘রাজা’ হবে)। ভয় আর সন্দেহ ঘিরে ধরে ম্যাকবেথকে। তারপর নিজের আসনকে সুসংহত করার জন্য সে ব্যানকুওকে খুন করায়। কিন্তু ব্যানকুওর ছেলেরা পালিয়ে যায় ইংল্যান্ডে। ম্যাকবেথের হতাশা আরো বেড়ে যায় যখন সে জানতে পারে যে শুধু ঐ ছেলেরাই নয়, সেই সাথে পালিয়ে গেছে ওর এতদিনের সবচেয়ে বড় সমর্থক ম্যাকডাফও। আর ম্যাকডাফ শুধু পালায়ইনি, যোগ দিয়েছে ডানকানের ছেলেদের সাথেও।
ধাপ ৪: দুঃস্বপ্নের পর্যায় (Nightmare stage): আগে যা ছিলো কেবলই মাথাব্যথা, এবার তা পরিণত হয় ব্রেইন ক্যান্সারে। নায়কের হতাশা আরো ঘনীভূত হয়। টের পায়, ব্যর্থতার খুব কাছাকাছি চলে এসেছে সে। টের পায়, এগিয়ে আসছে তার শত্রুরা, খুব শীঘ্রই তার গলা চেপে ধরবে তারা।
সেই তিন রহস্যময়ী জাদুকরীর সাথে আবার দেখা হয় ম্যাকবেথের। তারা তাকে আবারো তিনটা বাণী শোনায়। এর মাঝে একটা ছিলো, ‘ম্যাকডাফ থেকে সাবধান’। ম্যাকবেথ এর কপালের ভাঁজ বেড়ে যায়। সে তার শত্রুকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য ঘাতক পাঠায়। আর ঘাতকের হাতে মৃত্যু হয় ম্যাকডাফের সন্তান আর স্ত্রীর। তারপর এই পর্যায়ের শেষের দিকে আমরা দেখতে পাই, ইংল্যান্ডে চলে যাওয়া স্কটিশরা একত্র হয়েছে সেই অত্যাচারী রাজার বিরুদ্ধে, যার অন্তিম পরিণতি এখন কেবল সময়ের ব্যাপার।
ধাপ ৫: ধ্বংসের পর্যায় (Destruction or death wish stage): নায়ক তার চূড়ান্ত পরিণতি বরণ করে। সেটা অন্য কারো হাতেও হতে পারে, আবার নিজের হাতেও হতে পারে (আত্মহত্যা)। এ ক্ষেত্রে, অন্তিম পরিণতি সরাসরি নায়কের না হয়ে তার কাছের কারোও হতে পারে, যার মৃত্যুর জন্য প্রধান চরিত্রই কোনো না কোনোভাবে দায়ী থাকে।
ম্যাকবেথের ধ্বংসের পর্যায় শুরু হয় স্ত্রীর মৃত্যুর মাধ্যমে। তারপর অবশেষে যুদ্ধে ম্যাকডাফের হাতে মৃত্যু হয় তার।
উদাহরণ: দ্য পিকচার অব ডোরিয়ান গ্রে, রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট, জুলিয়াস সিজার, হ্যামলেট, ম্যাকবেথ। বাংলা সাহিত্য থেকে কৃষ্ণকুমারী, বলিদান, বিসর্জন, চন্দ্রগুপ্ত।
আজ এই পর্যন্তই। আগামী পর্বে রিবার্থ আর ভয়েজ অ্যান্ড রিটার্ন নিয়ে আলোচনা করবো। সে পর্যন্ত বিদায়।