কিংবদন্তী তলোয়ার

তারিখ:

পোস্ট শেয়ার করুন:

কিংবদন্তী তলোয়ার

সৃষ্টির শুরু থেকেই লড়াই করে চলেছে মানুষ। কখনও খাদ্য জোগাতে, প্রাণ বাঁচাতে, আবার কখনও স্রেফ ক্ষমতায় সেরা হতে।

সেই প্রাচীন কালের শিকারিই হোক কিংবা মধ্যযুগীয় রাজা-বাদশাহ, অথবা আধুনিক রাষ্ট্রনায়ক, প্রত্যেকেই নানাবিধ অস্ত্রের সাহায্যে লড়াই চালিয়ে গেছে, যাচ্ছে।  

লড়াইয়ের বহুবিধ অস্ত্রের মধ্যে অন্যতম একটি তলোয়ার। লম্বা ধারাল এবং যথেষ্ট উপযোগী এই অস্ত্র।

দূরপাল্লায় নয় বরং মুখোমুখি সংঘর্ষে তলোয়ার সর্বাধিক কার্যকর। পদাতিক এবং অশ্বারোহী যোদ্ধাদের হাতে হাতে শোভা পেত নানাবিধ তলোয়ার।

তলোয়ারের প্রাচীনতম নিদর্শনটি পাওয়া যায় খৃস্টপূর্ব ৩১০০ তে।

সে সময়ের যে ধরনের তলোয়ার ছিল, তা ব্রোঞ্জ, আর্সেনিক, কপার ইত্যাদির অসম মিশ্রণ তৈরি।

এরপর সৈনিক, জলদস্যু, সামুরাই, নোবেলদের হাত ঘুরে তলোয়ার পৌঁছে গেছে অনন্য উচ্চতায়।

কিছু কিছু তলোয়ার আবার অতিক্রম করে গেছে সকল উচ্চতা, হয়ে উঠেছে কিংবদন্তী। তেমন কিছু তলোয়ারের কথাই বলছি-

এক্সক্যালিবার

কিংবদন্তী তলোয়ার
এক্সক্যালিবার

তালিকায় প্রথমেই চোখ বুজে উঠে আসে “এক্সক্যালিবারের” নাম। আদতে এই তলোয়ারটি আবার আরেক কিংবদন্তীর সঙ্গী, তিনি রাজা আর্থার। আর্থারের কথা জানা যায় ইংল্যান্ডের প্রাচীন কবিতা এবং লোক-গাঁথায়। তলোয়ারটা তিনি ঠিক কীভাবে পেয়েছিলেন তা নিয়ে অবশ্য দ্বিমত রয়েছে।

তের’শ শতকের গোঁড়ার দিকে ফ্রান্সের কবি, রবার্ট ডি বোরন, তার কবিতা ‘মার্লিন’-এ উল্লেখ করেন আর্থারের রাজা হবার ঘটনা। সেখানে বলা হয়, পাথরের বুকে পোঁতা ছিল এক আশ্চর্য তলোয়ার। ভবিষ্যৎ বানী ছিল, যে ব্যক্তি তলোয়ারটা পাথরের বুক থেকে টেনে তুলতে পারবে, একমাত্র সে-ই ব্রিটেনের রাজা হবার যোগ্য।

অনেক নাইট এবং যোদ্ধা ব্যর্থ হলেও কিশোর আর্থার বিনা বাঁধায় তলোয়ার তুলে প্রমাণ করে তার যোগ্যতা, হয়ে যায় রাজা। আর সেভাবেই তার হাতে আসে কিংবদন্তী তলোয়ার এক্সক্যালিবার।

অপর সূত্র বলে এক্সক্যালিবার রাজা আর্থারকে দেয় এক জলপরী। এবং আর্থার পরবর্তীতে তলোয়ারটি আবার ফেলে দেয় সেই লেকে, যেখানে জলপরী থাকত। ছুঁড়ে দেয়া তলোয়ার লুফে নেয় পরীর হাত, তারপর গায়েব হয়ে যায় চিরতরে।

দ্বিতীয় সূত্রের পক্ষেই সমর্থন সর্বাধিক।

এক্সক্যালিবারের ক্ষমতা সম্পর্কেও চালু আছে নানা মতবাদ। বলা হয়, তলোয়ারের খাপ যে যোদ্ধার কাছে থাকত, যুদ্ধক্ষেত্রে রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু ছিল অসম্ভব। এছাড়াও, এক্সক্যালিবার খাপমুক্ত করার সাথে সাথেই যে তীব্র আলো জ্বলে উঠত, শত্রুরা অন্ধ হয়ে যেত তাতে। মাখমের মত প্রতিপক্ষের তলোয়ার কেটে ফেলতে সক্ষম ছিল এক্সক্যালিবার। তবে সত্যিই অস্ত্রটা কতটুকু বাস্তব তা নিয়ে রয়েছে অনেক দ্বন্দ্ব। ইতিহাসের সবচেয়ে চমকপ্রদ তলোয়ারটি কাল্পনিক হলেও অবাক হবার কিছুই নেই।

মুরামাসা

কিংবদন্তী তলোয়ার
মুরামাসা

তলোয়ারে নাম আসলে মুরামাসা নয়, এটা নির্মাতার নাম। জাপানিজ তলোয়ার শিল্পীরা নিজেদের নাম তলোয়ারে খোদাই করে কাজের সাক্ষর রেখে দেন। তাছাড়া প্রত্যেকের কারিগরি পদ্ধতি কিংবা ডিজাইনের উপরে নির্ভর করেও পরিবর্তন হয় তলোয়ারের ধরন। মুরামাসা প্রাচীন জাপানের প্রসিদ্ধ তলোয়ার নির্মাতাদের মধ্যে অন্যতম। কথিত আছে, অস্ত্রের কারিগরিতে ডুবে গিয়ে সে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে, যেন তার তলোয়ার সব কিছু ধ্বংস করার ক্ষমতা পায়।

তার কারিগরি এতই ভাল ছিল, ঈশ্বর সন্তুষ্ট হয়ে মুরামাসার অস্ত্রগুলোর বিশেষ ক্ষমতা দান করে। তারপর সেগুলো ভয়ংকর হয়ে ওঠে, মৃত্যুকে ডেকে আনে খুব দ্রুতই। পথের কাঁটা সরিয়ে দিতে বিন্দুমাত্র অপেক্ষা করে না মুরামাসা সোর্ড। রক্তের পিপাসা না মিটলে ব্যবহারকারীর প্রাণনাশের কারণ হয়ে দাঁড়ায় এই তলোয়ারগুলো।

তৎকালীন জাপানের এক সেনাপতি, তকুগাওয়া ইয়াসু’র সমস্ত পরিবার মারা যায় মুরামাসার তৈরি অস্ত্রের মুখে। এরপরই মুরামাসার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন তিনি।

ততদিনে তলোয়ার শিল্প অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিল নির্মাতা মুরামাসা। সেই রেশ ধরেই আরও বেশ কয়েক বছর চলে একই মানের তলোয়ার তৈরির কাজ। তলোয়ারের অভিশপ্ত হবার বিষয়টা আসলেই বাস্তব কি-না, তা নিয়েও শঙ্কা আছে বৈকি! তবে মুরামাসা এবং তার তলোয়ার দুটোই বাস্তবে ছিল, এই নিয়ে কোনও দ্বন্দ্ব নেই।

কুসানাগি

কিংবদন্তী তলোয়ার
কুসানাগি

জাপানের আরও একটি কিংবদন্তী তলোয়ার, কুসানাগি। অলৌকিকতার বিচারে মুরামাসাকেও ছাড়িয়ে গেছে এটি। প্রাচীন মিথ বলে, ঝড়-জলের দেবতা আট মাথাওয়ালা এক সাপকে মেরে তার পেট চিরে উদ্ধার করে এই আশ্চর্য অস্ত্র। এরপর থেকে তলোয়ারটা বংশ পরস্পরায় ক্ষমতা আর ঐতিহ্যের প্রতীক হয়ে সম্মান বাড়িয়েছে রাজ পরিবারের।

জাপানের মূল্যবান রাষ্ট্রীয় সম্পদের মধ্যে এটি অন্যতম।

কুসানাগি তলোয়ারের আছে বাতাসের গতিপথ নিয়ন্ত্রনের ক্ষমতা। যে কোনও দিকে এক কোপ দিলে ঝড়ো হাওয়া বইত কুসানাগির আঘাতে। সরু ঘাসও কেটে ফেলতে সক্ষম ছিল তলোয়ারটি।

বর্তমানে, জাপানের নাগানো প্রদেশের আতসুতা মন্দিরে, সংরক্ষিত আছে এই আশ্চর্য তলোয়ার। অবশ্য গত শতাব্দীতে কেউ দেখা পায়নি ওটার। শুধু কয়েকবার নতুন সম্রাটের অভিষেক উপলক্ষে জিনিশটা বের করা হয়েছিল, তবে ভালভাবে মুড়ে রাখা ছিল প্রতিবারেই। চোখের দেখা দেখেনি কেউ।

কিংবদন্তী এই তলোয়ার এখনও ওই মন্দিরেই আছে এমনটা জোর দিয়ে বলা যায় না। তবে কর্তৃপক্ষ জিনিশটির গোপনীয়তা রক্ষায় সম্পূর্ণ সফল, একথা বলাই বাহুল্য!

গোউজিয়ানের তলোয়ার

কিংবদন্তী তলোয়ার
গোউজিয়ানের তলোয়ার

চৈনিক রাজা গোউজিয়ানের তলোয়ার প্রায় আড়াই হাজার বছর পুরাতন সম্পদ। ১৯৬৫ সালে, চীনের এক স্যাঁতস্যাঁতে কবরস্থান থেকে উদ্ধার হয় এটি। খাপ খোলার পর দেখা যায়, একচিলতে মরচেও ধরেনি অস্ত্রে, উল্টে ধার পরীক্ষা করতে গিয়ে আঙুল কেটে যায় এক প্রত্নতাত্ত্বিকের।

অত বছর আগে এত নিখুঁত কারিগরি দক্ষতায় কীভাবে এমন একটা অসাধারণ তলোয়ার তৈরি সম্ভব হয়েছিল তা এক রহস্যই বটে!

তলোয়ারের শরীরে খোদাই করা লেখাও অক্ষত ছিল। তা থেকেই জানা গিয়েছে, চীনের ইউ রাজ্যের রাজার জন্য তৈরি হয়েছিল ওটা। পরবর্তীতে ইউ রাজ্যের ইতিহাস ঘেঁটে গবেষকরা সিদ্ধান্তে এসেছে, ওটা রাজা গোউজিয়ানেরই অস্ত্র। তলোয়ারটা সেসময় এতটাই চমকপ্রদ ছিল যে, মানুষ দাবি করত ওটা স্বর্গ আর মর্ত্য একজোট হয়ে তৈরি করেছে।

সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে এই অস্ত্র চাইলে এখনও অনায়াসে ব্যবহার করা সম্ভব। দুই সহস্র বছরের অধিক সময় পাড়ি দিয়েও একটি অস্ত্রের অক্ষত থাকার এমন নমুনা খুব বেশি নেই পৃথিবীতে।

তলোয়ারটি আকারে মধ্যযুগীয় তলোয়ারের তুলনায় ছোট। তৈরি হয়েছে, কপার, টিন, লেড, লোহা, সালফার দিয়ে। গায়ে আঁকা চমৎকার নকশা বাড়িয়েছে এর আকর্ষণ। বর্তমানে, রাজা গোউজিয়ানের তলোয়ার সংরক্ষিত আছে চীনের হুবেই প্রদেশের জাদুঘরে।

রাজা অ্যাটিলার তলোয়ার

কিংবদন্তী তলোয়ার
রাজা অ্যাটিলার তলোয়ার

হান সম্প্রদায়ের রাজা অ্যাটিলা, ইতিহাসের ভয়ংকর, দুর্ধর্ষ, কুটিল যোদ্ধাদের একজন। তার স্বপ্ন ছিল ভোগ দখল। সম্পূর্ণ রোমকে নিজের মুঠোয় নিতে চাইত সে। চাইত ইউরোপে একাধিপতি হতে।

বাবার মৃত্যুর পর, বিশ্বাসঘাতক ভাই ও চাচার ষড়যন্ত্রে, শৈশবে প্রচুর যন্ত্রণা ভোগ করতে হয় তাকে। আর পরবর্তীতে সেই প্রতিশোধের আগুনই মনে জাগিয়ে তোলে ভয়ংকর আক্রোশ।

কথিত আছে, একবার অ্যাটিলা খোলা ময়দানে শুয়ে ছিল। কিছুক্ষণ পর এক রাখাল এসে হাজির হয় সেখানে। জানায়, খামারের কাছে একটা তলোয়ার কুড়িয়ে পেয়েছে সে, জিনিশটা নাকি এক ছোঁয়ায় মেরে ফেলেছে তার সাধের গরু।

রাখাল অ্যাটিলার মত একজন যোগ্য যোদ্ধার হাতে অস্ত্রটা তুলে দিতে চেয়েছিল। তাই ওটা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে, একথা বলে। রাখালের কথা শুনে অ্যাটিলা তলোয়ারটা নেড়ে চেড়ে দেখে। বিদ্যুৎ খেলে যায় তার মাথায়।

সাইথিয়ান সম্প্রদায়ে একটি তলোয়ারের কিংবদন্তী আগেই জানত অ্যাটিলা, সেটা যুদ্ধের দেবতা এরেস স্বয়ং দান করেছিলেন। ওই তলোয়ার এতটাই কার্যকর ছিল যে ব্যবহারকারীকে করে তুলতে পারত মৃত্যুঞ্জয়, একাধিপতি রাজা। এক যুদ্ধের সময় হারিয়ে যায় অস্ত্রটা। রাখালের দেয়া তলোয়ারের সাথে এরেসের তলোয়ারের সাদৃশ্য খোঁজে রাজা অ্যাটিলা।

যদিও এমনটা হতেই পারে, রাজা অ্যাটিলা, হান সম্প্রদায়কে যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করতে এবং নিজের ক্ষমতা নিশ্চিত করতে তলোয়ারটাকে কিংবদন্তীর খেতাব দিতে চেয়েছি।

কেননা যদি আসলেই অ্যাটিলা তলোয়ার পাবার পর অমর হতে পারত, তাহলে পরবর্তীতে তার স্ত্রী তাকে বিষ খাইয়ে কিছুতেই মারতে পারত না।

অ্যাটিলার মৃত্যুর পর তার দেহাবশেষের সাথে তলোয়ারটি কবর দেয়া হয় জলাশয়ের নিচে। সেই কবরস্থানের সঠিক সন্ধান আজও মেলেনি। অ্যাটিলার সাথে হারিয়ে গেছে তার কিংবদন্তী তলোয়ার, চিরতরে।

বর্তমানকালের আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রের ভিড়ে তলোয়ার আর যুদ্ধনীতির অংশ নেই।

ক্লোজ রেইঞ্জে এখন হ্যান্ডগান অনেক বেশি কার্যকর ও নিখুঁত। হালের অত্যাধুনিক অস্ত্র আগমনের পরেই ক্রমশ কমতে শুরু করে তলোয়ারের কদর। এখন তলোয়ার হয়ে উঠেছে ঐতিহ্যের বাহন, উচ্চ-মর্যাদার নিদর্শন। আবার কোথাওবা উপাসনার অংশ, কিংবা শুধুই ইতিহাসের ধারক। তবুও যতদিন পৃথিবী থাকবে, ততদিন বেঁচে থাকবে অদ্ভুত সব তলোয়ারের কিংবদন্তী।

তার সত্যি মিথ্যা যাচাই হয়তো তেমন গুরুত্ব রাখে না। ইতিহাস বিকৃত হয়, সময় বদলে যায়, ঘটনা নবীন রূপ পায়। কিন্তু গুরুত্ব একই থাকে, বর্তমান ও ভবিষ্যতের আঙিনায়।

কথাকার – প্রান্ত ঘোষ দস্তিদার

গল্পসল্প আড্ডা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

spot_img

সম্পর্কিত নিবন্ধ

জুতা (ছোট গল্প)- আফিন্দী

জুতাবিদ্যুৎ’এর গলার তেজে ফাঁকা মেসরুম গমগম করে উঠলো, “ভাই, তুমি যাবে পাঁচ ভাইয়ে? খিদেয় আমার জান যায়! খালা...

মৃত্যু পরবর্তী জগতের অভিজ্ঞতা 

মৃত্যু পরবর্তী জগতের অভিজ্ঞতা  মৃত্যু পরবর্তী জীবনের অভিজ্ঞতা কেমন? মানুষ তার অনিশ্চিত জীবনে শুধু একটি বিষয়ের নিশ্চয়তা নিয়ে জন্মেছে।...

বুক রিভিউ- হুমায়ূন আহমেদের ‘মেঘ বলেছে যাব যাব’

বুক রিভিউ- হুমায়ূন আহমেদের 'মেঘ বলেছে যাব যাব' বুক রিভিউ- হুমায়ূন আহমেদের 'মেঘ বলেছে যাব যাব'।বইয়ের নাম:মেঘ বলেছে যাব...

ডা. স্যাটান: সিরিয়াল কিলার ডা. মার্সেল পেটিওটের ভয়ংকর গল্প!

তাকে আখ্যা দেয়া হয়েছিল ডা. স্যাটান বলে। তিনি একই সাথে একজন সৈনিক, ডাক্তার, মেয়র, ভয়ঙ্কর অপরাধী এবং সিরিয়াল...