নিখোঁজ- আবিদ হোসেন জয়

তারিখ:

পোস্ট শেয়ার করুন:

নিখোঁজ- আবিদ হোসেন জয়

(১)

গল্প বলতে আমি সাধারণত সাচ্ছন্দ্য বোধ করিনা। প্রথমত গল্প বলার অভ্যেস আমার নেই। আর দ্বিতীয়ত, শ্রোতার মনযোগ ধরে রাখার যে ক্ষমতা, আমার ধারণা সেটাও আমার নেই। তবে আজ আমি যে গল্পটি বলব, তা কিছুটা হলেও মানুষের মনযোগ কাড়বে।

কারণ এই গল্পের কোন শেষ নেই, ব্যাখ্যা নেই। শুধু আছে রহস্যে ঘেরা কিছু প্রশ্ন।

বর্তমানে আমি একজন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা। এক সময় গোয়েন্দা বিভাগে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করেছি। তার সূত্র ধরে, অনেক রহস্য আমাকে ভেদ করতে হয়েছে। বস্তায় লাশ ভরে পুকুরে ফেলে দেওয়া কেস, বিকৃত চেহারাধারী অজ্ঞাত লাশ, আত্নহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়া খুন ইত্যাদি ইত্যাদি।

আমার ঝুলিতে যে ব্যর্থতা নেই এমনটা নয়। অবশ্যই আছে। তবে সংখ্যায় কম। বড়জোর পাঁচ থেকে ছয়টি রহস্য আমার জীবনে অমীমাংসিতই রয়ে গেছে। অবশ্য তার পেছনে নিজের ব্যর্থতার চাইতেও বেশি রয়েছে রাজনৈতিক প্রভাব। বিভিন্ন ক্ষমতাসীন ব্যক্তিবর্গের জন্য আমি বেশিদূর আগাতে পারিনি। শুধু মাত্র একটি রহস্য ছাড়া। যার ব্যর্থতার দায় ভার সম্পূর্ণই আমার নিজের কাধে।

আর আমার গল্পটি তা নিয়েই।

তখন ১৯৯০ সাল। পুলিশের চাকুরীতে জয়েন করেছি বেশি দিন হয় নি। এক মফস্বল শহরে আমার পোস্টিং। থানা থেকে পুলিশ কোয়ার্টারের দুরত্ব অনেক। রোজ একটি মোটরসাইকেলে যাতায়াত করি। পুরোনো মডেলের মোটরসাইকেল। ইয়ামাহা, ডিলাক্স হান্ড্রেড।

একদিন ডিউটি শেষে রাত করে বাড়ি ফিরছি। ইট বিছানো লম্বা পথ। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ইলেকট্রিসিটির অভাবে আচ্ছন্ন সেই শহরে তখন লোডশেডিং এর তীব্র প্রবণতা। বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা হতেই আলো হারাবার শোক। মাথার ওপর যেই বিশাল আকাশ, তার চাঁদটাই বড় ভরসা। তার মধ্যে বাংলা সনে কার্তিকের অস্তিত্ব। সিগারেটের ধোঁয়ার মত পাতলা কুয়াশা চারদিকে। আমার গায়ে পুরোনো দিনের পুলিশ ইউনিফর্ম। গাঢ় নীল রঙা শার্ট। তার সাথে খাকি রঙের প্যান্ট। মৃদু কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ কে যেন আমার পথ আটকে দাঁড়াল। মোটরসাইকেলের হেডলাইটের সরু আলোয় দেখলাম একটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। বয়স আনুমানিক ষোল কি সতেরো। পরণে হাফ হাতা শার্ট, ফুল প্যান্ট৷ আমাকে দেখে দৌড়ে কাছে এলো। অস্থির ভঙ্গিতে বলল, – স্যার আমার মা অনেক অসুস্থ। আমার সাথে একটু বাড়ি চলুন। একটু চলুন স্যার।

আকস্মিক এরকম পরিস্থিতে আমি সামান্য ঘাবড়ে গেলাম। সেখানে গিয়ে আমি কী করব? আমি তো আর ডাক্তার নই। আমি ছেলেটির কাধে হাত রেখে, সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, – দেখো, আমি তো সেখানে গিয়ে কিছু করতে পারব না। আমি তো ডাক্তার নই। তুমি বরং আমার সাথে চল। ডাক্তারখানা থেকে একজন ডাক্তার নিয়ে আসি।

ছেলেটি মুহূর্তেই আমার প্রস্তাব নাকোচ করে বলল, – না স্যার। আপনি আগে আমার সাথে একবার চলুন। আমার মা অনেক ভিতু। আপনাকে দেখলে তিনি সাহস পাবেন। চলুন স্যার।

– আচ্ছা তোমাদের বাসা কত দূরে?

– বেশি দূরে না স্যার। পায়ে হেঁটে দশ মিনিটের রাস্তা।

যেহেতু পায়ে হেঁটে দশ মিনিটের পথ। তার মানে মোটরসাইকেলে আরো কম সময় লাগবে। একবার গিয়েই দেখা যাক। তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। এই ভেবে আমি ছেলেটির সাথে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। ছেলেটি আমার মোটর সাইকেলে চড়ে বসল।

তার দিক নির্দেশনায় আমি ইট বিছানো পথ ছেড়ে বায়ে মোড় নিলাম। একটা সরু পথ অনেকটা দূর চলে গেছে। নির্জন, নিস্তব্ধ, এক অচেনা পথ।

দুই ধারে সাড়ি ধরে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগাছালি।

বাতাসের স্তর ভেদ করে একটি অবাধ্য শেয়ালের ডাক ভেসে আসছে। বিষন্নতা মেশানো এক স্বর। যেই স্বর এক সময় বিভাজিত হতে শুরু করল। একটি থেকে দুটি, দুটি থেকে চারটি। তখন মনে হল, একটি নয় বরং অনেক গুলো শেয়াল অনবরত ডেকে যাচ্ছে। আমার ভেতর কেমন যেন অস্বস্তিবোধ শুরু হল। এদিকে পেছনে বসে থাকা ছেলেটিও কোন কথা বলছে না। মায়ের অসুস্থতার শোকে যেন ভাষা হারিয়ে বসে আছে। আমি অস্বস্তি কাঁটাতে নিজে থেকেই কথা আগালাম,

আচ্ছা তোমার নাম কি?

– রাতুল-

কোন ক্লাসে পড় তুমি?

– ক্লাস টেন

– কোন স্কুল?

– এখানে তো একটাই স্কুল আছে। মেমোরিয়াল হাই স্কুল। সেখানেই পড়ি।

– ও আচ্ছা। তাই তো। এ কথা আমার মাথায় আসে নি। আচ্ছা তোমার মার কি কোন অসুখ আছে? নাকি তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন?

– আমি তা জানিনা। মা প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়েন। ডাক্তার দেখাতে হবে। – তাহলে ডাক্তার দেখাচ্ছ না যে?ছেলেটি আমার এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল, – স্যার আমরা চলে এসেছি।

আমি খেয়াল করে দেখলাম, আমরা একটি বাড়ির সামনে এসে পৌঁছেছি। এক চালা বাড়ি। তার ভেতর খুপরির মত দুটো ঘর। উঠোনে পাতা বিহীন একটি মরা গাছ। শুকিয়ে যাওয়া ডালে একটি হারিকেন ঝুলছে। সেই আলো চারদিক ঘিরে থাকা অন্ধকারে নিতান্তই তুচ্ছ। বাড়ির পেছনে সম্ভবত একটি বহমান নদী। নদীর পাড়ে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের আওয়াজ, রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে কানে আসছে।

– স্যার ঘরে চলুন।

আমি মোটরসাইকেলটি দাঁড় করিয়ে, ছেলেটিকে অনুসরণ করে এগিয়ে চললাম। সে আমাকে নিয়ে একটি ঘরে বসালো। একটি হারিকেন ধরিয়ে রেখে চলে গেল। যাবার আগে বলল, – পাশের ঘরে আমার মা শুয়ে আছে। আমি তাকে আপনার কথা বলে আসছি আপনি একটু বসুন।

মিনিট দুয়েক পর সে যখন ফিরে এলো, তখন তার হাতে এক গ্লাস পানি। মুখে চওড়া হাসি। গ্লাসটি আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, স্যার পানি খান। আমার মা সুস্থ হয়ে গেছে। বলেছিলাম না? আমার মা অনেক ভিতু। যেই শুনেছে আমি একজনকে সাথে করে নিয়ে এসেছি, তাতেই তিনি সুস্থবোধ করছেন।

আমি গ্লাসটি হাতে নিলাম। আর এই প্রথম খেয়াল করলাম ছেলেটির ডান হাতে মোট ছয়টি আঙুল। স্বাভাবিকের চেয়ে একটি বেশি। শুনেছি ছয় আঙুল ধারী মানুষ নাকি ভাগ্যবান হয়। ছেলেটি কতখানি ভাগ্যবান কে জানে!

আমি এক চুমুকে পুরো গ্লাস শেষ করে, গ্লাসটি ফেরত দিয়ে বললাম, – আমি তাহলে আজ উঠি। আমার কাজ শেষ।

– না না স্যার। কোথায় যাচ্ছেন? আমার মা আপনার সাথে দেখা করবেন। আমি তাকে নিয়ে আসছি। আপনি এক মিনিট বসুন।

আমি তার অনুরোধ ফেলতে পারলাম না। চুপ করে বসে রইলাম। এদিকে অপেক্ষার প্রহর এক মিনিট পার হয়ে দশ মিনিটে গড়িয়েছে, কিন্তু সে ফিরছে না। মাথা সুদ্ধ ঘাড় ঘুরিয়ে আশপাশটা দেখলাম। ছোট্ট ঘর জুড়ে সীমাহীন দারিদ্রতা। একটা পুরনো চাদর বিছানো ঘুণে খাওয়া চৌকি। একটা ভাঙ্গা আলনা। তাতে ঝুলন্ত গুটি কয়েক জামা। নোংরা। ঘর্মাক্ত। আধোয়া।

চৌকির গা ঘেঁষে একটা চেয়ার বিহীন টেবিল। তার উপর একটি অবহেলিত পত্রিকা না জানি কতদিন ধরে পড়ে আছে। আমি সময় কাটাবার জন্য তা হাতে নিলাম। পত্রিকা জুড়ে অসংখ্য শিরোনামের ছড়াছড়ি। কিন্তু হারিকেনের ক্ষীণ আলোয় শিরোনামের হাত ধরে, গুঁটি গুঁটি অক্ষরে লিখা মূল খবরে যাওয়া সম্ভব হল না। তাই আমি শিরোনামেই চোখ বুলাতে লাগলাম,

“ নূর হোসেন মারা যাবার আজ ৩ বছর “

” ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে রাজধানীতে পূর্ণ হরতাল “

“ বাবার হাতে একই পরিবারের দু’জন খুন “

এই সকল শিরোনাম আমাকে মোটেও আকৃষ্ট করল না। উল্টো ভেতরে ভেতরে বিরক্তবোধ শেষ সীমানায় গিয়ে পৌঁছাল। আমি পত্রিকা ফেলে উঠে দাঁড়িয়ে বাইরে পা বাড়ালাম। উঠোনে এসে ছেলেটির নাম ধরে ডাকলাম। কিন্তু কোন জন মানবের অস্তিত্ব সাড়া জাগালো না। আমি ঠিক করলাম বাড়ি চলে যাব। মোটরসাইকেলের কাছে আসতেই মনের ভেতর একটা সংশয় জেগে উঠলো। এরকম যদি হয়, ছেলেটি কোন বিপদে পড়েছে?

তাই আমি মনের সংশয়ে সাড়া দিলাম। উঠোনের মরা গাছে ঝুলন্ত হারিকেনটা হাতে করে পাশের ঘরে পা বাড়ালাম। অনুমতির তওয়াক্কা না করে সেই ঘরে পা রাখতেই দেখলাম, সেখানে কেউ নেই।

(২)

একটা সদ্য অঙ্কুর গোঁজানো ভয়, মনের ভেতর পুষে আমি সেই স্থান ত্যাগ করলাম। যদিও ভয় পাবার মত কোন ঘটনা তখনো ঘটেনি। ঘটেছিল তার কিছুকাল পর। যখন মোটর সাইকেল স্টার্ট করে আমার চেনা পথের খোঁজে, সেই অচেনা সরু গলিতে ফিরলাম। আবারো শেয়ালের ডাক কানে আসতে শুরু করল। বিভাজিত বিষন্ন স্বর। একটি থেকে দুটি, দুটি থেকে চারটি। আমার অন্তঃকর্ণ ভেদ করতে করতে তারা এক সময় ক্লান্ত হয়ে তীব্রতা হারালো। আমি কিছুটা স্বস্তি পেলাম। কিন্তু স্বস্তির সময় বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না। কারণ আমি আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম, আমি ঘুরে ফিরে পুনরায় সেই ছেলেটির বাড়িতেই এসে উপস্থিত হয়েছি।

সেই এক চালা বাড়ি, খুপরির মত দুটো ঘর। পাতা বিহীন মরা গাছ। যেন আমি কোন বৃত্তাকার পথে আঁটকে গেছি।

একই ঘটনার বেশ কয়েকবার পুণরাবৃত্তি ঘটল। মোটরসাইকেল ঘুরিয়ে কিছুদূর যেতেই আবার সেই বাড়িতে উপস্থিত হতে লাগলাম। এভাবে কতবার ঘটল আমার ঠিক খেয়াল নেই। যখন ভোর হবার সম্ভাবনা নিয়ে শেষ রাতের আঁধারের সাথে কিছুটা আলো মাখলো, তখন খেয়াল করলাম আমি আমার চেনা ইট বিছানো পথে ফিরে এসেছি।

আমি আর বাড়ি ফিরলাম না। সেখান থেকে সোজা চলে গেলাম থানায়। থানার বৃদ্ধ কন্সটেবল হারুন মিয়া, ভোর সকালে আমাকে দেখে বিস্মিত হলেন। তার মধ্যে আমার চোখেমুখে ক্লান্তিময় অবস্থা, ইউনিউফর্ম জুড়ে বিশৃঙ্খলা। এসব দেখে তিনি আরো ঘাবড়ে গেলেন। জানতে চাইলেন, কি হয়েছে? আমার সাথে?

আমি তাকে সব খুলে বললাম। তিনি তাচ্ছিল্য মেশানো অভিজ্ঞতার সাথে বললেন, – স্যার এসব কিছুনা। এক ধরণের শয়তান আছে, এরা ধরলে মানুষ রাস্তায় হারায় ফেলে। এরা মানুষের কোন ক্ষতি করে না।

আমি তার কথা বিশ্বাস করলাম না। আমি যুক্তিবাদী মানুষ। আমি সকালের আলো গায়ে মেখে পুণরায় সেই সরু গলির খোঁজে বেরিয়ে পড়লাম। কিন্তু সারাদিন হন্যে হয়ে খুঁজেও কোন লাভ হল না। যেন একটি সরু পথ শহরের মানচিত্র থেকে, কাউকে না বলেই বিলীন হয়ে গেছে।

তারপর অনেক দিন পার হয়ে গেল। প্রায় মাসখানেক। এদিকে তখন এরশাদের শাসন আমল। দেশের অবস্থা ভাল নয়। স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে পুরো দেশ উত্তাপ ছড়াচ্ছে। যে কোন সময় স্বৈরাচারী সিংহাসন ভেঙ্গে পড়বে। আমি তখন প্রখর ব্যস্ততায় ভুগছি। কিন্তু তবুও কেন জানি ঐদিনের ঘটনা চাইলেও ভুলতে পারছি না। একটা স্থায়ী ক্ষতের মত তা যেন আমার মাথায় বসে আছে।

তাই হুট করে একদিন, সেই ছেলেটির খোঁজে তার স্কুলে চলে গেলাম। মেমোরিয়াল হাই স্কুল। নামটি তখনও আমার স্মৃতি থেকে মুছে যায় নি। হেডমাস্টার সাহেব আমাকে দশম শ্রেণীর ক্লাস টিচারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। খেদমত উল্লাহ। গণিতের শিক্ষক। বয়স আনুমানিক পয়তাল্লিশের ধারে কাছে। তিনি আমার সামনে একটি রেজিস্টার খাতা খুলে বসলেন। নাকের ডগায় ঝুলে থাকা চশমাটা ঠিক করে বললেন,

কার কথা যেন জানতে চাচ্ছেন আপনি?

– রাতুল। ক্লাস টেন।

তিনি অখন্ড মনযোগে খাতা জুড়ে তল্লাসি চালালেন। তারপর বিরক্ত নিয়ে বললেন, – নাহ এই নামে কেউ আমার ক্লাসে নেই। আর এখন বছরের শেষের দিক। সব ছেলের নাম আমার মুখস্থ। তবে আমি একটু ভোলা মনের মানুষ তাই খাতা খুলে বসলাম।

– আচ্ছা ক্লাস টেনের কি আর কোন শাখা আছে ?

– নাহ আর শাখা কোত্থেকে আসবে? পড়ালেখা করার মত ছেলেপেলেই তো নেই। আপনি কি সেই ছেলেটির সামান্য বর্ণনা দিতে পারবেন?

কি বর্ণনা দিব তা আমি বুঝে উঠতে পারলাম না। ঐ রাতের আঁধারে ছেলেটিকে ভাল করে পরোখ করা হয় নি। তবে একটি তথ্য আমার তখনো মনে ছিল। আমি তাই বললাম, রাতুলের ডান হাতে ছয়টি আঙ্গুল ছিল।

খেদমত উল্লাহ সাহেব, রেজিস্টার খাতা বন্ধ করে কিঞ্চিত হেসে বললেন,- এখন বয়স হয়ে গেছে আমার। ছেলেপেলেদের আর বেত্রাঘাত করিনা। করলে বলতে পারতাম কার হাতে কয়টি আঙ্গুল।

আমি বিষন্ন মন নিয়ে তার রুম ছাড়লাম। স্কুলের করিডোর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি।

হঠাৎ খেদমত উল্লাহ সাহেব পেছন থেকে দেখে উঠলেন,- ভাই একটু শুনুন।

আমি সামান্য আশা নিয়ে তার কাছে ফিরে গেলাম।- জি বলুন।

আমার ক্লাসে একটি ছেলে ছিল অনেক বছর আগে। তার হাতে অবশ্য ছয় আঙ্গুল ছিল। হঠাৎ মনে পড়ল তার নাম ও রাতুল। যদিও আমার ভোলা মন কিন্তু এই কথা এখনো মনে রেখেছি কারণ ছেলেটি ভীষন মেধাবি ছিল। একবার ম্যাথ অলিম্পিয়াডে ফার্স্ট হয়েছিল। সেই অলিম্পিয়াডের প্রধান অতিথির সাথে তার একটা ছবি আমার কাছে আছে। আসুন আপনাকে একবার দেখাই।

আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল, খেদমত উল্লাহ সাহেব যেই ছেলেটির কথা বলছেন, আমি সেই ছেলেটিকেই খুঁজছি। ঠিক তাই হল। আমি ছবি হাতে নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। কিন্তু তখনো বিস্মিত হবার মত আরো একটি কথা অবশিষ্ট ছিল।

খেদমত উল্লাহ সাহেব ছবি ফেরত নিয়ে বললেন,- আপনি এত বছর পর এই ছেলেকে কোথায় পেলেন বুঝতে পারলাম না। আপনার সম্ভবত কোথাও ভুল হচ্ছে। কারণ এই ছেলে প্রায় পাঁচ বছর আগে হারিয়ে গিয়েছিল। তারপর তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় নি।

(৩)

এই পর্যায়ে এসে, আপনাদের গল্পটি কেমন লাগছে তা ঠিক ধরতে পারছিনা। তবে ঐ মুহূর্তে আমার ভেতর কি হচ্ছিল তা বোঝানোর মত ভাষা আমার জানা নেই। সে যাই হোক, আবার গল্পে ফেরা যাক।

সেদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে আমি খেদমত উল্লাহ সাহেবের কাছ থেকে রাতুলদের বাসার ঠিকানাটা নিয়ে এলাম। আর বিলম্ব না করে সেদিনই চলে গেলাম সেখানে। সাথে ছিল আমার এক মাত্র মোটর সাইকেলটি। তাছাড়া আর কেউ নয়।ঠিকানা অব্দি পৌঁছে আমি স্মৃতিবিজড়িত সমস্যায় ভুগতে লাগলাম। মনে হতে লাগল, এই জায়গায় আমি এর আগেও একবার এসেছি। এক চালা বাড়ি। তার ভেতর দুটো খুপরি ঘর। উঠোনে একটি পাতা বিহীন মরা গাছ। আমার মনে পড়ে গেল, এই সেই বাড়ি যেখানে আমি সেদিন এসেছিলাম। সব আগের মতই আছে, শুধু রাতের আঁধার দিনের আলোর সাথে জায়গা বদল করেছে।

একজন মহিলা আমাকে দেখে ঘরের ভেতর থেকে বেড়িয়ে এলেন। পরণে হালকা বাদামী রঙের শাড়ি। শরীর জুড়ে বার্ধক্যের চিহ্ন। আমি তাকে আমার পরিচয় দিলাম। সেদিনের কথা সম্পূর্ণ আড়াল করে, শুধু রাতুলের হারিয়ে যাবার কথা জানতে চাইলাম।

তিনি অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বললেন,- রাতুলের কথা বাদ দিন। তা আর মনে করে কি হবে?

আমি তাকে অনুরোধ করলাম,- একবার আমাকে দয়া করে বলুন। সেদিন কি হয়েছিল?

তিনি আমার অনুরোধে অনিচ্ছাসত্ত্বেও মুখ খুললেন। কিন্তু তারপর আমার মনে হল, তার কাছে না আসলেই বোধ হয় আমার জন্য ভাল ছিল। কারণ তার ঠিক পরপর দুটো ঘটনা ঘটল,

এক,মহিলাটি আমাকে বললেন, এক রাতে আমি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লাম। রাতুল আমাকে বলল, মা তুমি শুয়ে থাকো। আমি সাহায্যের জন্য কাউকে ডেকে নিয়ে আসছি। এই বলে সে যে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেল। আর ফিরে এলো না।

দুই,আমি কোয়ার্টারে ফিরে দেখলাম, খেদমত উল্লাহ সাহেব আমার জন্যে অপেক্ষা করছেন। তিনি আমাকে দেখে শার্টের বুক পকেটে হাত দিলেন। সেখান থেকে একটি চিরকুট বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, – একটা ভুল হয়ে গেছে। বলেছিলাম না আমার ভোলামন? সকালে যেই ঠিকানাটা দিয়ে ছিলাম সেটা রাতুলদের পুরোনো ঠিকানা। সেখানে এখন আর কেউ থাকেনা। আজ স্কুল ছুটির পর হঠাৎ রাতুলের বাবার সাথে দেখা হল। মনে করে তার থেকে নতুন ঠিকানাটা নিয়ে এলাম। এই নিন ধরুন। আমি কাঁপা কাঁপা হাতে চিরকুটটা হাতে নিলাম। একই ধরণের কম্পন গলার স্বরে মিশিয়ে বললাম, – কিন্তু আমি যে মাত্র সেখান থেকেই এলাম? রাতুলের মার সাথে আমার কথা হয়েছে।

– কি বললেন? রাতুলের মার সাথে আপনার কথা হয়েছে?

– জি

– আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে।

– কেন?

– আমি আপনাকে আরো একটি কথা বলতে ভুলে গিয়েছি।

– কি কথা?- পাঁচ বছর আগে শুধু রাতুল হারিয়ে যায় নি। রাতুলের সাথে তার মাও হারিয়ে গিয়েছিল।

খেদমত উল্লাহ সাহেবের সাথে আমি এ নিয়ে আর কথা বাড়ালাম না। তিনি চলে গেলেন। তার সাথে বিদায় নিল আমার শরীরের সুস্থতা। টানা এক সপ্তাহ আমি তীব্র জ্বরে বিছানায় পড়ে রইলাম। পরিবার ছাড়া একা ঐ মফস্বল শহরে আমাকে দেখার মত কেউ রইল না। একটু ভুল বললাম। থানার কন্সটেবল হারুন, এক দিন এক হালি কলা হাতে, তার শয়তানের গল্প শুনাতে হাজির হয়েছিলেন।

(শেষ পর্ব)

এদিকে আমি ঢাকায় পোস্টিং এর জন্য অনেক দিন ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। যেদিন আমার জ্বর সারলো, সেদিন জানতে পারলাম আমার পোস্টিং হয়ে গেছে। আমি ঐ রহস্যময় ঘটনা সম্পর্কে আর বিন্দু পরিমাণ আগ্রহ দেখালাম না। বলতে পারেন, ভয়েই আমি আগ্রহ দেখানো বন্ধ করে দিলাম। তারপর ব্যস্ততায় ডুবে গিয়ে আমার জীবন চলতে থাকল।

নতুন থানা। নতুন নতুন সব মানুষ। এভাবেই চলে গেল পাঁচটি বছর। তারপর এক সকালের কথা। আমি চায়ের কাপ হাতে পত্রিকায় চোখ বোলাচ্ছি। হঠাৎ ঐ পুরোনো মফস্বল শহর নিয়ে একটি প্রতিবেদন চোখে পড়ল। যার সারমর্ম হচ্ছে,নদী ভাঙ্গনে সেই এলাকার বেশ কিছু মানুষ প্রাকৃতিকভাবে নিজেদের বাস স্থান থেকে বিতাড়িত হয়েছে। তার মধ্যে একটি বাড়ির বিচ্যুত স্থান থেকে পাওয়া গেছে দু জন মানুষের কঙ্কাল। তদন্তের সিমাবদ্ধতার কারণে তাদের পরিচয় পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না।প্রতিবেদনটি পড়ার পর আমার সেই প্রথম রাতের কথা মনে পড়ে গেল। রাতুল যখন আমাকে খালি ঘরে রেখে চলে যায়, তখন আমি একটি পত্রিকা খুঁজে পাই। যার একটি শিরোনাম ছিল, ” বাবার হাতে একই পরিবারের দু’জন খুন। “হঠাৎ আমার মনে হতে থাকে, সেই রাত থেকে শুরু করে প্রতিবেদনটি চোখে পড়া অব্দি যা ঘটেছে সব একটি বার্তা। কেউ বা কারা যেন ভাষাহীন ইঙ্গিতে বলে যাচ্ছে, ফরিদ হাসান সাহেব। আমরা হারিয়ে যাই নি। আমাদের মেরে ফেলা হয়েছিল। আমি একদিনের মাথায় আবার সেই শহরে উপস্থিত হলাম।

খেদমত উল্লাহ সাহেব আমাকে দেখে অবাক হলেন। আমি তাকে বললাম, আমাকে রাতুলের বাবার কাছে নিয়ে যেতে পারবেন? আপনি আমাকে যে ঠিকানা দিয়ে ছিলেন, তা আমি হারিয়ে ফেলেছি।তিনি আমাকে রাতুলের বাবার কাছে নিয়ে গেলেন। বয়ষ্ক একজন মানুষ। মুখ ভর্তি চামড়ার ভাজ। উষ্কখুষ্ক সাদা কালো চুল। একটি ময়লা পাঞ্জাবি পড়ে, সারি ধরে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু ছোট ছোট গাছে পানি ঢালছেন। আমি নিজের পরিচয় গোপন করে তার সাথে কথা চালিয়ে গেলাম। তার এক ফাঁকে তীব্র কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,- আচ্ছা আপনার স্ত্রী আর ছেলে কি সত্যিই হারিয়ে গিয়েছিল?তিনি তাৎক্ষণিক কোন উত্তর দিলেন না। বরং অনবরত আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর খানিক মুচকি হেসে বললেন,- চা খাবেন? আমি অনেক ভাল চা বানাতে পারি।

( সমাপ্ত )

আবিদ হোসেন জয় 

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

spot_img

সম্পর্কিত নিবন্ধ

জুতা (ছোট গল্প)- আফিন্দী

জুতাবিদ্যুৎ’এর গলার তেজে ফাঁকা মেসরুম গমগম করে উঠলো, “ভাই, তুমি যাবে পাঁচ ভাইয়ে? খিদেয় আমার জান যায়! খালা...

মৃত্যু পরবর্তী জগতের অভিজ্ঞতা 

মৃত্যু পরবর্তী জগতের অভিজ্ঞতা  মৃত্যু পরবর্তী জীবনের অভিজ্ঞতা কেমন? মানুষ তার অনিশ্চিত জীবনে শুধু একটি বিষয়ের নিশ্চয়তা নিয়ে জন্মেছে।...

বুক রিভিউ- হুমায়ূন আহমেদের ‘মেঘ বলেছে যাব যাব’

বুক রিভিউ- হুমায়ূন আহমেদের 'মেঘ বলেছে যাব যাব' বুক রিভিউ- হুমায়ূন আহমেদের 'মেঘ বলেছে যাব যাব'।বইয়ের নাম:মেঘ বলেছে যাব...

ডা. স্যাটান: সিরিয়াল কিলার ডা. মার্সেল পেটিওটের ভয়ংকর গল্প!

তাকে আখ্যা দেয়া হয়েছিল ডা. স্যাটান বলে। তিনি একই সাথে একজন সৈনিক, ডাক্তার, মেয়র, ভয়ঙ্কর অপরাধী এবং সিরিয়াল...