প্লট আর্কিটাইপ—পর্ব ৩ 

তারিখ:

পোস্ট শেয়ার করুন:

প্লট আর্কিটাইপ পর্ব ৩ লিখেছেন- আশরাফুল সুমন

প্লট আর্কিটাইপ—পর্ব ৩

৬। রিবার্থ:

রিবার্থের গোড়া প্রোথিত আছে বাইবেল কিংবা মিথে। কিন্তু বর্তমানে রিবার্থ গল্প বলতে এমন গল্প বোঝায় যেগুলোতে শুরুতে কোনো চরিত্র বাহ্যিক বা অভ্যন্তরীণ প্রভাবে আঁধারে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে, বা আঁধারের কাছে বন্দি হয়ে পড়ে, তারপর অবশেষে তাকে কেউ মুক্ত করে। অথবা তার নিজের ভেতর ‘অনুধাবন’ সৃষ্টি হওয়ায় সে পরিণত হয় আগের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন আর উত্তম ব্যক্তিতে। মানে ভাবার্থে ঐ চরিত্রের ‘রিবার্থ’ হয়।

খেয়াল করুন, কমেডি বা ট্র্যাজেডির মতোই এখানেও কোনো চরিত্রের শুরুতে ‘ডার্ক’ হয়ে যাওয়া বা ‘ডার্ক’ কারো দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ব্যাপারটা আছে। আবার কমেডির মতো শেষে ‘অনুধাবন’-ও আছে।

একদম সহজ গল্প দিয়ে শুরু করি। আপনার গল্পের প্রোটাগনিস্ট কোনো রাজ্যের রাজকুমারী। ছোট বেলায় কোনো জাদুকরীর অভিশাপে সে ঘুমের দেশে চলে যায় (আঁধারের শক্তির কবলে পড়েছে)। তারপর কোনো রাজকুমার আসে আর তার ঘুম ভাঙিয়ে তাকে ‘পুনর্জন্ম’ উপহার দেয়। স্লিপিং বিউটিসহ দেশি-বিদেশি আরো অনেক রূপকথার গল্প আছে যেগুলোতে এরকম হয়।

আবার ভিন্নতাও আছে। ‘আঁধারের শক্তি’ যদি কোনো চরিত্রকে আক্ষরিক অর্থে দানবে পরিণত করে দেয়? সেই দানব হয়তো একটা প্রাসাদে থাকে। তারপর একদিন গল্পের নায়ক/নায়িকা সেখানে গিয়ে তার ভালোবাসা দিয়ে হোক আর যেভাবেই হোক অভিশাপটা ভেঙে দেয়, তাকে দানব থেকে পরিণত করে মানুষে। পুনর্জন্ম। বিউটি অ্যান্ড দ্য বিস্টের কাহিনিটা এমনই।

স্নো হোয়াইট, স্লিপিং বিউটি, বিউটি এন্ড দ্য বিস্ট, দ্য ফ্রগ প্রিন্স ইত্যাদি এ ধরনের আর্কিটাইপের উদাহরণ।

উপরের দুটো উদাহরণে দেখা যায় আঁধারের শক্তির কবলে পড়লেও চরিত্রের শুধু বাহ্যিক পরিবর্তন হয়, ভেতরে কিন্তু সে আগের মতোই থাকে। এমন যদি হয় যে তার ভেতর-বাহির দুই স্থানেই পরিবর্তন ঘটে?

উইচার সিরিজের প্রথম ছোট গল্পের সংকলন ‘দ্য লাস্ট উইশ’-এর একদম প্রথম গল্পটিকে এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে রাখা যায়। ছোট বেলায় কোনো অভিশাপের কারণে রাজা ফল্টেসের ঘরে জন্ম নেওয়া বাচ্চাটা মায়ের পেট থেকে বেরিয়ে আসে একটা রক্তপিপাসু, বীভৎস প্রাণী হিসেবে। স্ট্রিগা। গেরাল্টের হাতে দায়িত্ব পড়ে তাকে হত্যা করার। কিন্তু গেরাল্ট তাকে হত্যা করে না, বরং তাকে অভিশাপ থেকে মুক্তি দেয়। মেয়েটার ‘পুনর্জন্ম’ হয়। খেয়াল করুন, এই উদাহরণে অভিশাপের কারণে ভেতরের এবং বাইরের, দুটো স্থানেই পরিবর্তন ঘটেছে চরিত্রের।  

আচ্ছা, যদি এমন হয়, অপশক্তির প্রভাবে কোনো চরিত্রের শুধু অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন হয়?

‘দ্য স্নো কুইন’-এর কথাই ধরা যাক। একবার এক জাদুকর একটা জাদুর আয়না বানালো। সেই আয়নায় ভালো কিছু প্রতিফলিত হলে সেটা ছোট হতে হতে নাই হয়ে যায়। আর খারাপ কিছু প্রতিফলিত হলে সেটা বাড়তে বাড়তে সর্বোচ্চ রূপ ধারণ করে। একদিন আকাশপথে সেই আয়না নিয়ে যাওয়ার সময় ভেঙে যায়। আয়নার ভাঙা টুকরো এসে পড়ে পৃথিবীতে। যার চোখে ঢুকে যায়, সে সবকিছু ছিদ্রান্বেষীর দৃষ্টিতে দেখতে থাকে। যার হৃদয়ে ঢুকে যায় সে নিষ্ঠুর হয়ে পড়ে।

গল্পের নায়ক কেয় এবং নায়িকা গার্ডা পরস্পরের বন্ধু। একদিন সেই আয়নার ভাঙা টুকরো কেয়ের চোখ আর হৃদয়ে ঢুকে পড়ে। তারপর থেকে সে সবকিছুকে খারাপ দৃষ্টিতে দেখতে থাকে। ফুলকে ঘৃণা করতে থাকে, দেখলেই ছিঁড়ে ফেলে। গার্ডার চোখের জলকে বিরক্তিকর লাগে। অন্য মানুষের সম্পর্কে বাজে বাজে কথা বলে। তাদেরকে অনুকরণের নামে পেছনে নানান অঙ্গভঙ্গি করে অপমান করে।

একদিন কেয় নিজের স্লেজ গাড়ি নিয়ে তুষারের ভেতর বেরোলে স্নো কুইনের কাছে ধরা পড়ে যায়। মহিলা তাকে নিয়ে যায় অনেক অনেক দূরে, তারপর সেখানে বন্দি করে রাখে।

গার্ডা তার বন্ধুকে বাঁচাতে অনেকদূর পথ পাড়ি দেয়। শুরু হয় তার অভিযান (এই অংশটুকু কোয়েস্ট আর্কিটাইপে পড়ে)। তারপর অবশেষে কেয়কে খুঁজে পায়। সে বরফের টুকরো দিয়ে পাজল খেলছিলো। সব জটিল আকৃতি আর শব্দ তৈরি করতে পারলেও কেবল একটা শব্দই সে তৈরি করতে পারছিলো না। ‘ইটার্নিটি।’ স্নো কুইন তাকে বলেছিলো, এই একটা শব্দ যদি সে তৈরি করতে পারে, তাকে সে নিজের জগত ফিরিয়ে দেবে।

গার্ডা তার বন্ধুকে ধরে কাঁদতে থাকে। তার চোখের জলে কেয়ের হৃদয়ে গেঁথে যাওয়া আয়নার টুকরো সরে যায়। তারপর তার মন পরিষ্কার হয়ে যাওয়ায় আবেগও ফিরে আসে, কাঁদতে শুরু করে সেও। আর কেঁদে উঠতেই তার চোখে গেঁথে যাওয়া আয়নার টুকরোও সরে যায়, তাকে পুরোপুরি স্বাভাবিক করে তোলে। দুই বন্ধু পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে। তাদের মাঝে এত আনন্দ আর প্রাণশক্তি ছিলো যে আশেপাশের বরফকণাগুলোও খুশিতে নেচে ওঠে, আর তারা নিজেরাই ‘ইটার্নিটি’ নামের শব্দটা তৈরি করে কেয়কে মুক্তি দেয়।

দুই বন্ধু আরেকটা অভিযান শেষে বাসায় ফিরে আসে। দেখে, সবকিছু সেই আগের মতোই আছে, সেই পুরাতন রাস্তা, রাস্তার সামনের বাতি, মানুষজন। শুধু রূপান্তরিত হয়েছে তারা। কারণ তারা আর সেই ছোট্টটি নেই, পূর্ণবয়সে পা দিয়েছে। মানে তাদের অভ্যন্তরে পরিবর্তন হয়েছে, পুনর্জন্ম হয়েছে তাদের অন্তরে।

উপরের উদাহরণগুলোতে একটা ব্যাপার একই রকম; সবগুলোতেই কোনো একটা চরিত্রকে বাহ্যিক কোনো শক্তি বা ব্যক্তি আঁধারের মাঝে নিমজ্জিত করে দেয়। তারপর কেউ-না-কেউ তাকে উদ্ধার করে, পুনর্জন্ম উপহার দেয়। কিন্তু এই আঁধার যদি বাহ্যিক না হয়? যদি সেই আঁধারের জন্ম তার ভেতরেই হয়?

ক্রিস্টমাস ক্যারোলের কাহিনি স্ক্রুজ নামের এক লোককে ঘিরে, যে তার পার্টনার জ্যাকব মার্লির সাথে মিলে মানুষকে টাকা ধার দেওয়ার নাম করে সর্বস্বান্ত করে। জ্যাকব মার্লি মারা যাওয়ার পর একাই এই ব্যবসা চালিয়ে যেতে থাকে সে। কোনো একটা কারণে পুরো দুনিয়ার উপরেই তিক্ত আর বিরক্ত স্ক্রুজ, সবার সাথে দুর্ব্যবহার করা তার নিত্যদিনের স্বভাব। তার ভাতিজা যখন তাকে ক্রিস্টমাসের ডিনারে দাওয়াত দেয়, সেই দাওয়াত সে খারাপভাবে ফিরিয়ে দেয়। তার কেরানি বব ক্রেচিটের সাথে দুর্ব্যবহার করে, সেই সাথে ক্রিস্টমাসের দিনে ছুটি কাটালে বেতন কেটে নেওয়ার হুমকিও দেয়। শুধু তাই নয়, ক্রিস্টমাস উপলক্ষ্যে গরিবদের জন্য আর্থিক সাহায্য প্রদান করার আহ্বানও ফিরিয়ে দেয় সে।

ক্রিস্টমাসের আগের দিন সন্ধ্যায় স্ক্রুজ বাসায় ফিরে এলে তার সাথে দেখা হয় জ্যাকব মার্লির ভূতের সাথে। মার্লি একটা বিশাল শেকল দোলাতে দোলাতে জানায়, যারা কেবল স্বার্থপরের মতো নিজের কথা ভাবে, কেবল নিজের জন্য বাঁচে, তাদের জন্য অপেক্ষা করছে ভয়াবহ শাস্তি। জ্যাকব আরো জানায়, শীঘ্রই তিনটি অশরীরীর সাথে দেখা হবে ওর।

প্রথম অশরীরী আসে বহু আগের ক্রিস্টমাসের স্মৃতি নিয়ে। স্ক্রুজ নিজেকে সেই ছোট্টবেলায় আবিষ্কার করে। চারপাশে হাসিতে উন্মত্ত আত্মীয়-স্বজন আর অনেক ভালোবাসার মাঝে। তারপর নিজেকে দেখে তরুণ বয়সে। যে মেয়েটিকে খুব ভালোবেসেছিলো, সে অন্যের জন্য তাকে কীভাবে ছিন্ন বস্ত্রের মতো আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলেছিলো তা দেখে। আর ঠিক এইভাবেই সে পরিণত হয় আজকের এই তিক্ত, বদমেজাজি, অর্থলোভী স্ক্রুজে।

দ্বিতীয় অশরীরী আসে বর্তমানের ছায়া হয়ে। সে তাকে দেখায় পৃথিবী জুড়ে মানুষ কত আনন্দের সাথে ক্রিস্টমাস পালন করছে। তাকে দেখায় তার ভাতিজা আর বব ক্রেচিটের পরিবারকে, দুইজনেই প্রচুর আনন্দ করছে, মজা করছে। স্ক্রুজের চোখ যায় বব ক্রেচিটের ছেলে ছোট্ট টিমের দিকে। পৃথিবীকে এই একজনকে এখনো ভালোবাসে সে।

তৃতীয় অশরীরী আসে ভবিষ্যতের বার্তা নিয়ে। সে স্ক্রুজকে দেখায় কেউ একজন মারা গেছে, আর সেই লাশের পাশে কোনো আত্মীয়-স্বজন নেই। কারো মাথাব্যথা নেই। কারো চোখে পানিও নেই। কারণ যে মারা গেছে তাকে কেউই ভালোবাসতো না। কবরের মাথার কাছে থাকা নামফলক দেখে আঁতকে ওঠে সে। কারণ সেটা তার নিজের। তবে এখানেই শেষ নয়। কারণ সে একাই মারা যায়নি। সাথে মারা গেছে সেই ছোট্ট টিমও।

পরিবর্তন আসতে থাকে স্ক্রুজের ভেতর। সে অশরীরীর কাছে ওয়াদা করে, যদি তাকে আরো একটিবার সুযোগ দেওয়া হয়, তবে সে আগের চেয়ে ভালো হয়ে দেখাবে।

ঘুম থেকে উঠে সে দৌড়াতে থাকে। যে চ্যারিটিকে না করে দিয়েছিলো, তাকে অবিশ্বাস্য অঙ্কের অর্থ দিয়ে বসে। ববের বাসায় টার্কি পাঠায়। আর তার ভাতিজার বাসায় ক্রিস্টমাস উৎসবে যোগ দিয়ে সবাইকে বিস্মিত করে দেয়। পরের দিন সে ববের বেতনও বাড়িয়ে দেয়। ছোট্ট টিমকে পালন করতে থাকে নিজের ছেলের মতো করে। আর তারপর বব পরিণত হয় এলাকার সবচেয়ে আমুদে, হৃদয়বান ব্যক্তিতে।  

রিবার্থ গল্পে আরো একটা সাধারণ উপাদান আছে। তা হলো, এমন এক চরিত্র যা ‘আঁধারে নিমজ্জিত’ চরিত্রকে ‘পুনর্জন্ম’ পেতে সাহায্য করে। স্লিপিং বিউটি বা ঠাকুরমার ঝুলির কিছু গল্পে সেটা হলো এমন কোনো রাজকুমার যে রাজকন্যাকে অভিশাপ থেকে বাঁচায়। ‘দ্য স্নো কুইন’-এ তা হলো গার্ডা, উইচারের ঐ গল্পে গেরাল্ট আর ‘এ ক্রিস্টমাস ক্যারোল’-এ তা হলো ছোট্ট টিম (কারণ টিমই একমাত্র যাকে স্ক্রুজ ভালোবাসতো, যার জন্য সে আরো বাঁচতে চেয়েছিলো, উত্তম ব্যক্তিতে পরিণত হতে চেয়েছিলো।)

৭। ভয়েজ অ্যান্ড রিটার্ন:

প্রধান চরিত্র নিজের স্থান ছেড়ে দূরবর্তী কোনো স্থানে অভিযানে যায়, তারপর অভিযান শেষে বাড়ি ফিরে আসে। সে ফিরে আসে আগের চেয়ে ভিন্ন কোনো চরিত্র হয়ে, আগের চেয়ে জ্ঞানী আর অভিজ্ঞ হিসেবে। তার সাথে তার অভিযানের পুরস্কারও থাকতে পারে।

এতটুকুতেই নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন ভয়েজ অ্যান্ড রিটার্ন এ জীবনে কতবার পড়েছেন। মাথায় নির্ঘাত অনেকগুলো গল্প ইতোমধ্যেই ভেসে উঠেছে?

মনে পড়ে বাগদাদের সেই সুদর্শন নাবিকের কথা? নিজের জাহাজ আর ক্রুসহ সমুদ্রযাত্রায় যায় যে? প্রত্যেকবারই কোনো না কোনো অদ্ভুত দ্বীপে যায় যেখানে প্রথমে দ্বীপের বিস্ময় তাকে আর তার সঙ্গীদের বিস্মিত করলেও পরে সেখানকার অধিবাসী বা সেখানে বাসকারী দানব/অভিশাপের সাথে লড়াই করতে হয় ওকে। আর তারপর জয়ীর বেশে সে আবার ফিরে আসে তার জাহাজে কিংবা বাড়িতে। হ্যাঁ, সিনবাদের কথাই বলছি। এখন আপনি এরাবিয়ান নাইটসের সেই ‘সিনবাদ এবং তার সাতটি অভিযান’-এর কথাই ভাবুন যেখানে প্রতিটি অভিযান শেষে সে বাড়িতে ফিরে আসে (সাথে থাকে তার সদ্যলব্ধ জ্ঞান আর পুরস্কার), কিংবা ১৯৯৭-৯৮ এর দিকে বিটিভিতে প্রচারিত সেই টিভি সিরিজের কথাই ভাবুন যেখানে সিনবাদ, ডুবার, রঙ্গার, ফিরোজ, মিভ আর ডার্মট প্রতিটা অভিযান শেষে তাদের জাহাজে ফিরে আসে, উভয় ক্ষেত্রেই তা ভয়েজ অ্যান্ড রিটার্ন। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে সিনবাদ প্রতিটা অভিযান শেষে বাগদাদে (বাড়িতে) ফিরে না গেলেও নিরাপদে জাহাজে ফিরে যেত। আর সিনবাদের ক্ষেত্রে তার জাহাজই তার ‘বাড়ি’।

আবার ধরুন, কোনো এক প্রধান চরিত্র জাহাজ/বিমানে করে কোথাও যাচ্ছে। তার বাহন ডুবে গেল/ধ্বংস হয়ে গেল/শত্রুর কবলে পড়লো। সে পরিত্যক্ত অবস্থায় নিজেকে আবিষ্কার করলো এক নতুন দ্বীপে। শুরুতে সেই দ্বীপের নানান নতুনত্ব তাকে বিস্মিত করলো। কিন্তু খুব শীঘ্রই সে বুঝতে পারলো, দ্বীপে সে একা নয়। যে বা যারা আছে, তারা তাকে সাদরে অভ্যর্থনা জানাবে না। তারপর আবির্ভূত হয় গল্পের ভিলেন, যার সাথে যুদ্ধ করে অবশেষে নায়ক ফিরে আসে তার বাড়িতে। ‘রবিনসন ক্রুসো’ এই নকশাতেই পড়ে।

এতক্ষণ যেগুলো বলছিলাম সেগুলো হলো পরিচিত পৃথিবীরই অপরিচিত কোনো স্থানে ভ্রমণ। কিন্তু এমন যদি হয় যে আপনার চরিত্র বা চরিত্রগুলো পরিচিত পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন কোনো জগতে চলে যায়?

‘এলিস ইন দ্য ওয়ান্ডার ল্যান্ড’-এ এলিস নামের একটি মেয়ে তার পরিচিত পৃথিবীর একঘেয়েমি জীবনে বিরক্ত। কোনো একদিন একটা খরগোশকে তাড়া করতে গিয়ে গাছের কোটরে ঢুকে সম্পূর্ণ নতুন এক জগত আবিষ্কার করে সে। ঐ জগতে প্রাণীরা মানুষের মতো কথা বলে। ঐ জগতে জাদুর অস্তিত্ব আছে। শুরুতে এসব এলিসকে বিস্মিত করলেও পরে যখন গল্পের ভিলেনের আবির্ভাব হয়, তার প্রাথমিক বিস্ময় চলে গিয়ে বিপদের শঙ্কা তাকে ঘিরে ধরে। তারপর ঐ জগতে একটা অভিযান শেষে এলিস আবার ফিরে আসে তার পরিচিত জগতে।

নার্নিয়া সিরিজের প্রথম বই ‘দ্য লায়ন, দ্য উইচ অ্যান্ড দ্য ওয়ার্ড্রোব’-এ চার ভাইবোন খেলতে খেলতে একটা ওয়ার্ড্রোবে ঢুকে যায়। তার ভেতর দিয়েই ওরা চলে যায় ভিন্ন এক জগতে। নার্নিয়ায়। সেখানে আছে কথাবলা প্রাণী, জাদু এবং আরো অনেক বিস্ময়কর ব্যাপার। শুরুতে জগতটাকে তাদের কাছে মজার মনে হলেও আস্তে আস্তে মুদ্রার অপর পিঠ প্রকাশিত হতে থাকে। সেই জাদুকরীর হাত থেকে ওরা নার্নিয়াকে রক্ষা করে, তারপর ফিরে আসে নিজেদের জগতে।

ভয়েজ অ্যান্ড রিটার্নের আরো কিছু উদাহরণ: গালিভার্স ট্রাভেল, পিটার প্যান, ডিক্লাইন অ্যান্ড ফল, রাইম অব দ্য এনশিয়েন্ট মেরিনার।

ভয়েজ অ্যান্ড রিটার্নের কাঠামোটাকে যদি বৃত্তাকারে দেখানো যেত তবে বৃত্তটা হতো এমন: সাধারণ জগত—বিস্ময়কর জগত—সাধারণ জগত। শুরুটা হবে প্রধান চরিত্র বা চরিত্রগুলোর ‘সাধারণ জগত’-এ, তারপর তারা প্রবেশ করবে ‘বিস্ময়কর জগত’-এ (যে জগত শুরুতে চমৎকার মনে হলেও ধীরে ধীরে এর অন্ধকার রূপটাও প্রকাশিত হয়), তারপর কিছু ‘ট্রায়াল’ শেষে চরিত্রটা আবারো ফিরে আসবে তার সাধারণ জগতে।

এটা কি পরিচিত আরেকটা কাঠামোর সাথে মিলে? হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন, লিটারারি থিয়োরিস্ট জোসেফ ক্যাম্পবেলের ‘হিরোজ জার্নি’, যার অপর নাম ‘মনোমিথ’। তবে সেটা প্লট স্ট্রাকচার হিসেবে আলোচনা করা হয়, প্লট আর্কিটাইপ হিসেবে না। আবার, উপরের উদাহরণগুলো দেখে কোয়েস্ট আর্কিটাইপের মতো মনে হতে পারে। উদাহরণগুলোতে কোয়েস্ট থাকতে পারে, তবে কোয়েস্টের ক্ষেত্রে ‘রিটার্ন হোম’ এর কোনো নিশ্চয়তা নেই, বা তা নিয়ে আলোচনা নেই। আপনার যা অর্জন করার বা যা করার তা করে ফেলেছেন মানেই কোয়েস্ট শেষ। সেখানে ভয়েজ এন্ড রিটার্নে অবশ্যই ‘বাড়ি’-তে ফিরে আসতে হয়।

শেষ করার আগে বলি, ‘ভয়েজ’ বা অভিযান কিন্তু আক্ষরিক অর্থে না হয়ে রূপক অর্থেও হতে পারে। সমাজের শ্রেণিবিন্যাস কাঠামোর নিচের দিকের কেউ যদি হঠাৎ করে নিজেকে উচ্চশ্রেণীর সমাজের মাঝখানে আবিষ্কার করে, তবে সেই উচ্চসমাজও কিন্তু রূপক অর্থে ‘বিস্ময়কর জগত’। গ্রাম থেকে শহরে আসা মেয়েটা যখন প্রথমবার ঢাকা শহর দেখে, তার কাছে তাকে অভাবনীয়ই মনে হয়। চারপাশটাকে মনে হয় খুব মজার। আর তারপর যখন সে ঐ শহরের অন্ধকার রূপটা দেখে, তার শিকার হয়, তখন শুরু হয় তার ‘অভিযান’। আর সেখান থেকে যদি সে পুনরায় তার নিজের জগতে (গ্রামে) ফিরে যেতে পারে, সেটাও ভয়েজ অ্যান্ড রিটার্ন। তবে এই বিষয়ে আপাতত আর বিস্তারিত বলছি না, সেটা ‘পেপার ভয়েজার’ থেকে আমার আর্কিটাইপ আর প্লট স্ট্রাকচার নিয়ে যে বইটি বেরোবে তাতে থাকবে।

প্লট আর্কিটাইপ নিয়ে আলোচনা এখানেই শেষ। তবে শেষ করার আগে দুইটা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাই।

১) কোনো গল্প কি একাধিক প্লট আর্কিটাইপে পড়তে পারে?

২) গল্প লিখলে কি সেটা কোনো না কোনো প্লট আর্কিটাইপে পড়তেই হবে?

১) এর উত্তর হলো, হ্যাঁ, পারে। গল্পগুলো নিয়ে গবেষণা করলে দেখা যায় যে প্রচুর গল্প একাধিক প্লট আর্কিটাইপের ভেতর পড়ে।

২) এর উত্তর হলো, এখানে ‘পড়তেই হবে’ ইস্যু না, ইস্যু হলো, আপনি চান বা না চান আপনার গল্প কোনো না কোনো আর্কিটাইপে পড়বেই। রসায়ন নিয়ে যাদের অল্প হলেও জানা আছে, তারা জানেন যে যৌগ হলো মৌলের সমন্বয়ে গঠিত পদার্থ। ধরেন, কার্বন ডাইঅক্সাইড একটি যৌগিক পদার্থ। একে বিশ্লেষণ করলে আমরা দুটি মৌলিক পদার্থ পাবো: কার্বন এবং অক্সিজেন। তাহলে শুরুতে যে যৌগটা পেয়েছেন সেটা হলো প্রথমে গল্পটাকে আপনি যে আর্কিটাইপ ভেবেছিলেন তা (যৌগিক আর্কিটাইপ)। এরপর যখন আরো বিশ্লেষণ করলেন, তখন দেখবেন এক বা একাধিক মৌলিক আর্কিটাইপ বেরিয়ে আসছে, যা উপরের সাতটার কোনো একটাতে পড়বে।

আগের পর্ব ১

আগের পর্ব ২ 

 

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

spot_img

সম্পর্কিত নিবন্ধ

জুতা (ছোট গল্প)- আফিন্দী

জুতাবিদ্যুৎ’এর গলার তেজে ফাঁকা মেসরুম গমগম করে উঠলো, “ভাই, তুমি যাবে পাঁচ ভাইয়ে? খিদেয় আমার জান যায়! খালা...

মৃত্যু পরবর্তী জগতের অভিজ্ঞতা 

মৃত্যু পরবর্তী জগতের অভিজ্ঞতা  মৃত্যু পরবর্তী জীবনের অভিজ্ঞতা কেমন? মানুষ তার অনিশ্চিত জীবনে শুধু একটি বিষয়ের নিশ্চয়তা নিয়ে জন্মেছে।...

বুক রিভিউ- হুমায়ূন আহমেদের ‘মেঘ বলেছে যাব যাব’

বুক রিভিউ- হুমায়ূন আহমেদের 'মেঘ বলেছে যাব যাব' বুক রিভিউ- হুমায়ূন আহমেদের 'মেঘ বলেছে যাব যাব'।বইয়ের নাম:মেঘ বলেছে যাব...

ডা. স্যাটান: সিরিয়াল কিলার ডা. মার্সেল পেটিওটের ভয়ংকর গল্প!

তাকে আখ্যা দেয়া হয়েছিল ডা. স্যাটান বলে। তিনি একই সাথে একজন সৈনিক, ডাক্তার, মেয়র, ভয়ঙ্কর অপরাধী এবং সিরিয়াল...