জোডিয়াক – মূল- রবার্ট গ্রে স্মিথ

তারিখ:

পোস্ট শেয়ার করুন:

জোডিয়াক – মূল- রবার্ট গ্রে স্মিথ

‘জোডিয়াক খুনি’-কে নিয়ে আলোচনার শুরু সেই ১৯৬৮ সাল থেকে, যা এখনও চলমান। এই খুনি’কে নিয়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিক রবার্ট গ্রেস্মিথ লিখেছিলেন ‘জোডিয়াক’।

পর্ব ১

সূচনা

জ্যাক রিপারের পর আর সন অফ স্যামের আগে আতংকের আরেকটা উল্লেখযোগ্য নাম ‘জোডিয়াক খুনি’। দুর্ধর্ষ আর রহস্যময় এই ‘জোডিয়াক’ খুনি। উনিশশ আটষট্টি সালে সানফ্রান্সিস্কো শহর আর সৈকতের এলাকায় পরপর কয়েকটি খুন করে আতংক তৈরি করেছিল হুডপরা সেই খুনি। পত্রিকাগুলোতে নিজের পরিচয় খুঁজে বের করার আমন্ত্রণ জানিয়ে সাংকেতিক চিঠি পাঠাতো যার মর্ম বের করতে সিআইএ, এফবিআই এবং নাসার কোডব্রেকারদের গলদঘর্ম অবস্থা হয়েছিল।

আমি তখন সানফান্সিস্কো ক্রনিকলসের একজন রাজনৈতিক কার্টুনিস্ট, এই পত্রিকাটা উত্তর ক্যালিফোর্ণিয়ার বড় একটা সংবাদপত্র। সেই পত্রিকায় আসা প্রতিটা সাংকেতিক চিঠি, গোপন বার্তা কিংবা প্রতিটা নিহতের কাপড়ের টুকরোর সাক্ষী ছিলাম। শুরুর দিকে জোডিয়াকের এই কাজকর্মের ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহ ছিল না। কিন্তু ধীরে ধীরে খুনীর সূত্রগুলোর ব্যাপারে আমার আগ্রহ বাড়তে থাকে, তার আসল পরিচয় বের করার ব্যাপারে একবারে সফল না হলেও সামনের কারো জন্য কাজ কিছুটা হলেও যেন এগিয়ে দিতে পারি এ ব্যাপারে সংকল্প জাগে।

এই বইটা লেখার সময় দুটো বাঁধার কথা মাথায় ছিল। প্রথমটা হচ্ছে, সন্দেহভাজন অনেকেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে এরমধ্যে, এদের মধ্যে আক্রান্ত অনেকেই আছে। স্বাক্ষীদের কেউ কেউ লুকিয়েছে। হারিয়ে যাওয়া তথ্যসূত্রের জন্য আমাকে হারিয়ে যাওয়া স্বাক্ষীদেরও খুঁজে বের করতে হবে। এদের মধ্যে একজন তার নাম বদলেছে ছয়বার। জোডিয়াকের আক্রমন থেকে বেঁচে যাওয়া আরেকজন পালিয়ে আছে প্রায় এক যুগ ধরে, নানা ধরনের নাম ব্যবহার করে। ক্রিসমাস কার্ডের একটা পোস্টমার্ক থেকে আমি সেই মহিলাকে খুঁজে পেয়েছিলাম। দ্বিতীয় ব্যাপার হচ্ছে, খুনগুলো একেক কাউন্টিতে হয়েছে, সেই সময় আন্ত-বিভাগীয় রেষারেষিতে, এক পুলিশ সংস্থা এমন তথ্য লুকিয়েছে যা অন্য পুলিশ সংস্থা জানে না। প্রতিটা কাউন্টি থেকে, খুঁজে খুঁজে ফাইল বের করেছি, ধ্বংস হতে যাচ্ছিল এমন ফাইল বাঁচিয়েছি। এই সব ফাইলগুলোকে একসাথে করে প্রথমবারের মতো জোডিয়াকের একটা পূর্ণাংগ ছবি তৈরি করতে নেমেছি।

এই কেস নিয়ে যখন আরো কয়েক বছর গড়াল, উনিশশো পচাত্তর সালের দিকে মনে হলো আরো কিছু খুন হয়েছে যেগুলোতে হয়তো জোডিয়াকের সম্পৃক্ততা থাকতে পারে। এছাড়াও মনে হলো ওর শুরুর দিকের কোন শিকার হয়তো ওর নাম জেনে থাকতে পারে। আক্রান্ত এই ব্যক্তি জোডিয়াককে পুলিশে ধরিয়ে দিতে গিয়ে নিজেই তার শিকার হয়েছিল। এই খুনির পক্ষে কোন জোরালো কারণ বা মোটিভ ছিল না। এই ক্রমিক খুনি রক্তের নেশায় উন্মত্ত হয়ে গিয়েছিল আর সে সময়টায় ক্যালিফোর্নিয়া ক্রমিক খুনিদের জন্য অভয়ারণ্যে পরিনত হয়েছিল। সেই সময়ের হিসেবে পুরো আমেরিকায় পাঁচশো থেকে পনেরোশ জীবন গিয়েছিল এইসব ক্রমিক খুনিদের হাতে।

জোডিয়াকের হত্যাকান্ডগুলো শুধু হত্যা ছিল না। এর সাথে যৌণ অপরাধও ছিল। আক্রান্তকে ভয়াবহ নিপীড়নের মাধ্যমে সে যৌণ আনন্দ উপভোগ করতো। শিকারকে তাড়িয়ে বেড়ানো ছিল তার যৌন উত্তেজনা আর আক্রমণ করাই ছিল যৌনতা। জোডিয়াক তার শিকারকে অত্যাচার, খুনের মাধ্যমে যৌন আনন্দ পেতো, কারণ তার মনের মধ্যে যৌনতা, হিংস্রতা মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল।

ধর্ষকামীদের (অন্যান্য ক্রমিক খুনিদের মতোই) মধ্যে সাধারণ একটা প্রবণতা দেখা যায়, সেটা হচ্ছে নিজেদের প্রথম খুনের পর তারা খুব বুদ্ধিমান আর লুকানোর ব্যাপারে দারুন অভিজ্ঞ হয়ে যায়। অনেক সময় পুলিশের সাথে ইদুর-বেড়ালের খেলাই তাদের অপরাধের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কোন খুনি ধরা পড়ার পর তার স্বীকারোক্তিই আসলে একধরনের আক্রমণ। মানুষ কেন ধর্ষকামী হয় এটা কেউ জানে না, তবে ডাক্তারদের ধারণা ক্ষতিগ্রস্ত ক্রোমোজোম বা জীবনে ঘটে যাওয়া কোন ঘটনার কারনণই এমন হয়। নিষ্ঠুর বাবা-মা আর সঙ্গীসাথীদের আচরণে ছোট থেকেই মারামারি, চুরি, পশুপাখিকে কষ্ট দেয়া এগুলোর মাধ্যমেই মানুষের মধ্যে ধর্ষকামী প্রবণতার সৃষ্টি হয়। বয়স বাড়ার সাথে সাথে এই ক্ষতগুলো আরো বাড়ে আর মানুষ আরো হিংস্র হয়ে উঠে। 

জোডিয়াকের পুরো গল্পে একটা প্রধান শব্দ পাওয়া যায়, সেটা হচ্ছে অবসেশন। এই কেসের কারনে বিয়ে ভেঙ্গেছে, ক্যারিয়ার নষ্ট হয়েছে, স্বাস্থ্য খারাপ হয়েছে, পচিশশত জোডিয়াক সন্দেহভাজনকে যাচাই করে দেখা হয়েছে। এই কেসের দুঃখময়তা, রহস্যময়তা আর ক্ষতির শিকার হয়েছে অনেক অনেক মানুষ।

এই বইয়ের মাধ্যমে কিছু কাজ করতে চেয়েছি। একটা পরিবর্তন আনতে চেয়েছি, খুনিকে থামাতে চেয়েছি। ধীরে ধীরে তার অদ্ভুত সব চিহ্ন আর  গোপন কোড ভেঙ্গেছে আর আমি জেনেছি, কিভাবে খুনি এই হদিসছাড়া জোডিয়াক চিঠিগুলো লিখেছে, কেন সে খুন করেছে, এমনকি তার এইসব অদ্ভুত চিহ্ন আর বার্তার অনুপ্রেরণা সে কোথা থেকে পেয়েছে আর জল্লাদের পোশাকও কেন পরেছে।

এটা একটা সত্যি ঘটনা যার ব্যপ্তি দুই যুগেরও বেশি সময় এবং এখনো চলছে। আমি এখানে অনেক তথ্য যোগ করেছি যা আগে কোথাও প্রকাশিত হয়নি। আট বছরের টানা গবেষণার ফল এটা। বছরের পর বছর ধরে পুলিশ আর পত্রিকাগুলো জোডিয়াকের লেখা চিঠির খুব অল্প অংশই প্রকাশ করেছে। এই বইয়ে পুলিশকে লেখা জোডিয়াকের সব লেখাই থাকছে।

অল্প কিছু কেসের বেলায় স্বাক্ষীদের নামের শেষাংশ বদলে দিয়েছি। তাদেরকে পুলিশ চেনে। জোডিয়াক হিসেবে সন্দেহভাজন কয়েকজনের নামও বদলে দেয়া হয়েছে, সেই সাথে তাদের কাজ, শিক্ষা-দীক্ষা এবং অবস্থানও বদলানো হয়েছে।

জাদুবিদ্যা, মৃত্যুর হুমকি, ক্রিপ্টোগ্রাম, হুডপরা এক খুনি, কিছু নিবেদিতপ্রাণ তদন্তকর্মকর্তা এবং সাদা স্যাভিতে ঘুরে বেড়ানো এক রহস্যময় ব্যক্তি যাকে সবাই দেখেছে কিন্তু কেউ চেনে না, এসবই জোডিয়াক রহস্যের অংশ, যে রহস্য আমার কাছে সবচেয়ে ভীতিকর গল্প।

  • রবার্ট গ্রেস্মিথ, সান ফ্রান্সিস্কো, মে ১৯৮৫।

জোডিয়াক- শুরু

ডেভিড ফ্যারাডে এবং বেটি লুই জেনসেন

শুক্রবার, ২০ ডিসেম্বর, ১৯৬৮

ভালায়োর পাহাড় বেয়ে উঠতে গিয়ে ডেভিড ফ্যারাডের চোখে পড়ল গোল্ডেন গেট ব্রিজের একাংশ, কিছু জেলে, নৌকা, সেন পাব্লো বে’তে স্পিডবোট আর শহরের প্রশস্ত রাস্তাগুলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই এলাকায় অনেক লোক জড়ো হয়েছিল মূলত নেভির কাজের জন্য আর ভালায়ো অল্প কিছুদিনেই ব্যস্ত শহর হয়ে উঠেছিল। কমদামী সব ঘর-বাড়ির কাঠামো গড়ে উঠেছিল শহর জুড়ে। উনিশশো ষাটের মধ্যেই শহরের একাংশে কালোদের ঘাঁটি তৈরি হলো, শহরজুড়ে তৈরি হলো সাদা-কালোর দ্বন্ধ যা হাইস্কুলেও ছড়িয়ে পড়েছিল।

ভালায়ো হাই স্কুলের খুব ভালো ছাত্রের একজন ডেভিড আর্থার ফ্যারাডে। বয়স সতেরো। বিদ্বান এবং একই সাথে একজন ক্রিড়াবিদ।  উনিশশ আটষট্টি সালের দিকে লুই বেটি জেনসেন নামের কালো চুলের, ষোড়শী এক মেয়ের সাথে পরিচয় হলো ডেভিডের। মেয়েটা থাকে শহরের একটু বাইরে। পরিচয় হওয়ার পর প্রায় প্রতিদিনই ওর সাথে দেখা করতে যায় ডেভিড। আজ, পাঁচটার দিকে, বন্ধুবান্ধবদের সাথে ডেভিড আর বেটি লুই আলাপ করছিল রাতে তারা দুজন ডেটে যাবে সে প্রসঙ্গে। এটাই তাদের প্রথম ডেট।

ছয়টার দিকে বের হলো ডেভিড। ছোট বোন ডেবি’কে সাতটা দশে নামিয়ে দিল সোনোমা বুলেভার্ডে। যেতে যেতে ডেবি’কে বলল, ডেট শেষে বেটি লুই’কে নিয়ে সে লেক হারমান রোডে যেতে পারে কারণ আরো অনেকেই নাকি সেখানে যাবে বলে শুনেছে। সেরেনো ড্রাইভে নিজেদের বাসায় ফিরে এলো ডেভিড। সাতটা কুড়ি নাগাদ তৈরি হতে শুরু করলো। জামাকাপড়, জুতো, ঘড়ি পরে নিলো দ্রুত। সাথে নিলো এক ডলার পঞ্চান্ন সেট। প্যান্টের ডানদিকের পকেটে ঢোকাল। সাদা একটা রুমাল নিলো সাথে। চুল আঁচড়ে ধূসরকোট পরে নিলো। সাড়ে সাতটার দিকে বাবা-মা’কে বিদায় বলে বেরিয়ে এলো। বাইরে কিছুটা শীতল বাতাসে অল্প করে নিঃশ্বাস নিলো, তারপর ১৯৬১ মডেলের র‍্যাম্বলার স্টেশন ওয়াগনের দিকে এগিয়ে গেল। এই গাড়িটা তার মায়ের নামে রেজিস্ট্রি করা। গাড়িটা নিয়ে ১২৩ রিজউডে চারপাশ গাছপালায় ঘেরা একটা বাড়ির সামনে পৌছাল তখন আটটা বাজে।

ডেভিডের মতো বেটি লুই জেনসেনও বেশ কর্মঠ, পড়ুয়া এবং তাকে নিয়ে কোন বাজে কথা নেই কোথাও। এই মুহূর্তে ওর বাবা মা জানেন ডেভিডের সাথে মেয়ে স্কুলে ক্রিসমাস ক্যারলের কনসার্টে যাচ্ছে, জায়গাটা এখান থেকে কাছেই।

আয়নায় নিজেকে শেষবারের মতো দেখে নিলো বেটি লুই, রিবনটা ঠিকমতো বসালো। তার বাদামী চুলগুলো সুন্দরভাবে নেমে এসেছে কাঁধ বরাবর। বেগুনী মিনি ড্রেসের সাথে সাদা কলার তার বড় বড় চোখগুলোকে আরো রহস্যময় করে তুলেছিল। জানালার দিকে তাকাল সে, বোন মেলোডি’কে বলেছে স্কুলের কোন এক ছেলে এই জানালা দিয়ে তার দিকে লক্ষ্য রাখে। এছাড়া বেটি লুইয়ের মা এই জানালাটা প্রায়ই খোলা পেয়েছেন। বাইরের গেট পেরিয়ে এই জানালা দিয়ে খুব সহজেই এই বাসায় ঢুকে পড়া যায়। কিন্তু এই কাজ কে করবে? ক্লাসমেট? নাকি অন্য কেউ?

বেটির জন্য অপেক্ষা করতে করতে ওর বাবা ভার্নের সাথে গল্প করছিল ডেভিড। বেটির বাবা-মা এসেছেন মধ্যাঞ্চল থেকে, যদিও বেটির বেড়ে উঠা এই কলোরাডোতেই।

বেটি বেরিয়ে এসে ওর বাবার কাছ থেকে বিদায় নিলো, বলল পার্টি শেষে তারা একটা কনসার্টে যাবে। এখন আটটা কুড়ি বাজে, এগারোটার মধ্যেই বাড়ি ফিরবে।

কনসার্টে যাওয়ার বদলে তারা দুজন গেল শ্যারনের ওখানে, ব্রেন্টউডে, জায়গাটা স্কুলের কাছেই। নয়টার দিকে শ্যারন ওদের এগিয়ে দিল। এরপর ওরা দুজন কোথায় যাবে সেটা তার জানা হয়নি।

ঠিক ঐ সময়, ভালায়ো শহরের কয়েক মাইল পুবে, লেক হারমান রোডে, দুজন রেকুন শিকারি শিকারে বেরিয়েছিল। নিজেদের লাল পিকআপটা তারা পার্ক করেছিল মার্শাল র‍্যাঞ্চের একটু বাইরে। তখন বেনিসিয়া ওয়াটার পাম্প স্টেশনে ঢোকার মুখে তারা ‘৬০ শেভ্রলে মডেলের একটা সাদা গাড়ি পার্ক করা অবস্থায় দেখে। একই সময়ে স্টেশনের ভেতর থেকে একটা ট্রাক বেরিয়ে এসেছিল খালি রাস্তাটাতে।

সাড়ে নয়টার দিকে অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটল জায়গাটায়। একটা ছেলে তার প্রেমিকাকে নিয়ে যাচ্ছিল মেয়েটার স্পোর্টস কারে। গাড়িটায় ঝামেলা হওয়ায় ইঞ্জিন দেখার জন্য রাস্তার পাশে ফাঁকা জায়গায় থামাল। এই সময় একটা নীল ভেলিয়ান্ট গাড়ি বেনিসিয়া থেকে ভালায়োর দিকে যাচ্ছিল। ছেলেমেয়ে দুজনকে পাশ কাটানোর সময় কিছুক্ষণ পরই গাড়িটা রাস্তার মাঝখানেই থেমে গেল, তারপর ব্যাক গিয়ারে ধীরে ধীরে ছেলেমেয়ে দুজনের দিকে আসতে থাকল। ব্যাপারটা ঠিক স্বাভাবিক লাগল না ওদের কাছে, ছেলেটা দ্রুত গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চালাতে শুরু করল। ভেলিয়ান্টটাও পেছন পেছন আসছিল। বেনিসিয়া মোড়ের কাছে এসে নিজেদের গাড়িটা ডানদিকে মোড় নিলো ছেলেটা, ভেলিয়ান্টটা সোজা চলে গেল।

রাত দশটার দিকে, বিঙ্গো ওয়েশার তার ওল্ড বোর্গেস র‍্যাঞ্চে ছাগল দেখার জন্য এলে, তার চোখেও বেনিসিয়া ওয়াটার পাম্পিং স্টেশনের গেটে পার্ক করা শেভ্রলে গাড়িটা চোখে পড়ল। এমনকি রেকুন শিকারিদের ফোর্ড পিকআপটাও তার নজর এড়ালো না।

মিঃ এড-এর দোকানে কোক খেয়ে ডেভিড আর বেটি লুই আবার চলতে শুরু করলো। প্রথমে গেল জর্জিয়া, সেখান থেকে বায়ে কলম্বাস পার্কওয়েতে। ভালায়ো শহরের সীমানায়, লেক হারমান রোডের দিকে এগুতে থাকল ডেভিড।

এখানে আসার পথে রুপার খনি এলাকাটা পার হলো। রাস্তাটার শুরুর দিকে কিছু র‍্যাঞ্চ আছে। দিনের বেলায় এখানে গরু চড়ে বেড়ায়। কিন্তু রাতের বেলায় এখান ঘনঘোর অন্ধকার। ডেভিড আর বেটি নির্জন পুব দিকে এগুলো। এই জায়গাটাকে বলে লাভার্স লেন। পুলিশ প্রায়ই এখানে চক্কর কাটে, প্রেমিক-প্রেমিকাদের সাবধান করে এতো নীরব এলাকায় গাড়ি পার্ক না করতে।

সোয়া দশটার একটু আগে রাস্তার ডানদিকে ফাঁকা জায়গাটায় গাড়ি পার্ক করলো ডেভিড। এখান থেকে একটু সামনেই লেক হারমান পাম্পিং স্টেশন। সবগুলো দরজা লক করে দিল, বেটি লুইয়ের ফারকোট, পার্স আর নিজের কোটটা ড্রাইভারের সীটের পেছনের সীটে রাখল। গাড়ির হিটার অন করে দিল। নিজের সীটটাকে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি বাঁকিয়ে আরাম করে বসল।

রাস্তায় কোন বাতি নেই, চারপাশে খোলা জায়গা, শুধু পাহাড় আর চাষ করার জমি। জায়গাটা প্রেমিক-প্রেমিকাদের খুব পছন্দের, কেননা এখান থেকে খুব সহজেই পুলিশের গাড়ি দেখা যায় যখন বাঁক ঘুরে এই রাস্তায় ঢোকে। এই সময়ে তারা বীয়ার বা গাঁজা লুকিয়ে ফেলতে পারে।

ঠিক সোয়া দশটার দিকে এক মহিলা আর তার প্রেমিক গাড়ি চালিয়ে গেল এই রাস্তা ধরেই। পনেরো মিনিট পর তারা যখন আবার এই রাস্তা ধরে ফিরছিল তখনও তারা গাড়িটাকে দেখতে পেল।

রাত দশটা পঞ্চাশে মিসেস স্টেলা বোর্গেস লেক হারমান রোড দিয়ে তার র‍্যাঞ্চে ফিরল, বেটি লুই আর ডেভিড যেখানে গাড়ি পার্ক করেছে এখান থেকে আড়াই মাইল দূরে। দরজায় পা রাখতেই ফোন বেজে উঠেছিল এবং সে তাড় মায়ের সাথে কথা বলেছিল। মিসেস বোর্গেসের তেরো বছরের ছেলেকে একটা অনুষ্ঠান থেকে নিয়ে আসার ব্যাপারে আলাপ হয়েছিল দুজনের মধ্যে।

রাত এগারোটায়, মিসেস পেগি আর তার স্বামী, হোমার, তাদের গ্রান্ড প্রিক্স গাড়িটা নিয়ে লেক হারমান রোডে এসেছে। পাম্প হাউজের কাছাকাছি যে ড্রেন আর পানির পাম্পগুলো তাদের কোম্পানী বসিয়েছিল সেগুলো ঠিকঠাক আছে কিনা দেখতেই তাদের আসা। ডেভিডদের গাড়িকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় মিসেস পেগি দেখেছিল ডেভিড ড্রাইভিং সীটে হেলান দিয়ে বসে আছে, তার কাঁধে মাথা দিয়ে বসে আছে বেটি লুই। মিসেস পেগি গাড়ির হেডলাইটের আলোয় দেখেছিল ডেভিডের হাত স্টিয়ারিং হুইলে রাখা।

নিজেদের কাজ শেষ করে মিসেস পেগি গাড়ি নিয়ে বেনিসিয়ার দিকে চলে গেল। রেকুন শিকারিদের লাল পিকআপ তাদের চোখে পড়ল। দুই শিকারী, শিকারের জ্যাকেট আর টুপি পরা অবস্থায় ট্রাকেই বসা ছিল। গাড়ি ঘুরিয়ে আবার ডেভিডদের গাড়ির পাশ দিয়ে গেল মিসেস পেগি। ডেভিড আর বেটি লুই ঠিক আগের অবস্থাতেই বসে ছিল।

রেকুন শিকারী দুজন ক্রিকের পাশ দিয়ে হেঁটে পিকআপে ফিরে এসেছিল। এগারোটা পাঁচের দিকে তারা যখন চলে গেল, তখন তারা ডেভিড আর বেটি লুই’র র‍্যাম্বলার গাড়িটা পার্ক করা অবস্থায় দেখেছিল, তবে সেটা ছিল গেটের দিকে মুখ করা।

রাস্তার বাঁকে এরপরের গাড়ি যেটা এসেছিল তার হেডলাইটের আলোয় ডেভিড আর বেটি লুইকে হয়তো শেষবারের মতো একসাথে দেখা গিয়েছিল। এই গাড়িটা র‍্যাম্বলারকে পাশ কাটিয়ে গিয়ে দশ ফুট দূরে দিয়ে পার্ক করল।

গাড়িতে যে মানুষটাকে দেখা গেল সে বেশ গাট্টাগোট্টা, শক্তপোক্ত মানুষ। অন্ধকারের মাঝেও আলোর অল্প একটু ঝিলিক দেখা গেল, সম্ভবত লোকটার পরনের চশমায় প্রতিবিম্বিত হয়েছে। লোকটার পরনে উইন্ডব্রেকার ধরনের জ্যাকেট।  

পাশাপাশি দুটো গাড়ি নির্জন একটা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে।

এগারোটা দশে স্থানীয় তেল কোম্পানীর এক কর্মী বাড়ি ফেরার পথে গেটের সামনে র‍্যাম্বলার গাড়িটা দেখল, কিন্তু পাশে থাকা অন্য গাড়িটার ব্রান্ড কিংবা রঙ খেয়াল করতে পারল না। গাড়ি নিয়ে সে নিজ গন্তব্যে চলে গেল। শুকনো বাতাসে রাস্তায় জমে থাকা ঘাসগুলোতে আলোড়ন তুলল।

এরপর কী ঘটতে পারে সেটা আমরা কল্পনা করতে পারিঃ

জানালা নামিয়ে লোকটা ডেভিড আর বেটি লুইকে গাড়ি থেকে নেমে আসতে বলল। অবাক হয়ে ওরা দুজনই এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করল। লোকটা গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। বেরিয়ে আসার সময় তার ভারী জ্যাকেটের ভেতর থেকে একটা পিস্তল বের করে আনল।

আগুন্তক বেটি লুইয়ের দিকে তাকিয়ে ছিল, ওর পাশের জানালা খোলা ছিল। প্যাসেঞ্জারের পাশের দরজা দিয়ে আক্রমণ না করে লোকটা গাড়ির চারপাশ ঘুরল। ওদের গাড়ি থেকে বের করার জন্যই সম্ভবত ডান আর বাম দিকের চাকায় গুলি চালাল।

এতে কাজ হলো। ওরা দুজনই দ্রুত বেরিয়ে আসতে চাইলো। আগুন্তক দৌড়ে ওদের কাছে গেল।

বেটি বেরিয়ে এসেছে। ডেভিড প্যাসেঞ্জার সিট গলে বেরিয়ে আসতে চাইল, মাথা অর্ধেক বের করে দিয়েছে। আগুন্তক ডেভিডের বাম কানের উপর পিস্তল রাখল, ট্রিগার চেপে দিল। বুলেটটা মাথার খুলি ভেদ করে চলে গেল।

বেটি লুই চিৎকার করে উত্তর দিকে দৌড়াতে থাকল। রাস্তার সমান্তরালে, ভালায়োর দিকে। পিস্তল সামনে বাড়িয়ে দিয়ে আগুন্তক বেটির পেছন পেছন গেল, দশ ফুটের কম দূরত্ব থেকে পাঁচ বার গুলি করল বেটি লুইকে। মেয়েটার পিঠের ডানদিকটা একদম ঝাঁঝরা করে দিল।

র‍্যাম্বলার গাড়িটা থেকে ঠিক সাড়ে ছাব্বিশ ফুট দূরে বেটি লুই’র মৃতদেহটা পড়ে রইল। মুখটা নীচের দিকে, ডানদিকে কাত হয়ে ছিল।

আগুন্তক তার গাড়িতে উঠে অন্ধকার পথে হারিয়ে গেল।

মিসের বোর্গেস এগারোটা দশে মেয়ে আর শ্বাশুড়িকে বেনিসিয়া পৌঁছানোর জন্য তৈরি হল। চার-পাঁচ মিনিটের মধ্যেই সে ডেভিড যেখানে গাড়ি পার্ক করেছিল সেখানে চলে এলো। রাস্তার বাঁক পার হতেই হেডলাইটের আলোয় বীভৎস দৃশ্যটা চোখে পড়ল।

প্রথমে ভেবেছিল ছেলেটা গাড়ি থেকে পড়ে গেছে। এর কিছুক্ষণ পরেই পথের ধারে বেটি লুইকে দেখল। র‍্যাম্বলারের ডান দিকের দরজাটা তখনও খোলা ছিল, গাড়ির হিটার তখনও চলছে।

দ্রুত গাড়ি চালিয়ে সে এগিয়ে গেল। বেনিসিয়া পুলিশের গাড়ি দেখতে পেয়ে ওদের সব জানাল। তখন ঘড়িতে এগারোটা উনিশ বাজে।

পুলিশের গাড়িগুলো দ্রত ঘটনাস্থলে চলে এলো, তিন মিনিটের মধ্যেই। ক্যাপ্টেন ড্যানিয়েল পিটা, অফিসার উইলিয়াম টি ওয়ার্নার দেখতে পেল ডেভিড তখনও নিঃশ্বাস নিচ্ছে, দ্রুত এম্বুলেন্সকে খবর দেয়া হলো।

র‍্যাম্বলার গাড়িটাকে পর্যবেক্ষণ করা হলো। গাড়ির মোটর বেশ গরম, ইগনিশন অন করা, ডানদিকের দরজা খোলা, বাকিগুলো লক করা। ডান দিকের ফ্লোরবোর্ডে বুলেটের খোসা পেলেন। আশপাশে কোথাও কোন চাকার দাগ বা ধ্বস্তাধ্বস্তির চিহ্ন পাওয়া গেল না।

বেটি লুই’র দেহ কম্বলে ঢেকে দেয়া হলো। মুখ সোজা করে শুয়েছিল ডেভিড। বাম কানের কাছে বুলেটের ক্ষত দেখে ক্যাপ্টেন পিটা বুঝতে পারল গুলিটা ক্লোজ রেঞ্জ থেকে করা হয়েছে। ডানদিকের চিবুকের মাংস ঝুলে গেছে, হাত আর শার্টের হাতায় রক্ত লেগে আছে। ওয়ার্নার চক দিয়ে দেহটার চারদিকে আউটলাইন করলো। অন্ধকারের বুক চিরে লাল বাতিওয়ালা অ্যাম্বুলেন্স চলে এলো। ডেভিডকে একটা স্ট্রেচারে করে অ্যাম্বুলেন্সের পেছনে উঠানো হলো, গন্তব্য ভালায়ো জেনারেল হাসপাতাল। যাওয়ার পথে একজন ডাক্তার সঙ্গী হলো।

এগারোটা উনত্রিশে, কাউন্টি করোনার ড্যান হোরানকে ফোন দিল পিটা। যেখানে আক্রমনটা হয়েছে সেটা বেনিসিয়া পুলিশের সীমানার বাইরে, জায়গাটা পড়েছে সোলানো কাউন্টিতে। রেডিওতে সোলানো কাউন্টি শেরিফের অফিসে একজন তদন্ত কর্মকর্তাসহ অন্যান্য লোকজন নিয়ে আসার অনুরোধ জানালো।

দ্রুত তৈরি হয়ে নিল হোরান। মধ্যরাতের মধ্যেই অকুস্থলে চলে এলো, সাথে বেনিসিয়ার ডাক্তার বাইরন সানফোর্ড। এই ধরনের ঘটনার যাবতীয় ঝামেলা কাঁধে নিতে সবসময় প্রস্তুত হোরান, বিশেষ করে আক্রান্ত ব্যক্তির পরিবারকে জানানো দায়িত্বটা তার উপরেই বর্তায়। (মানসিক এই যন্ত্রণার কারনে একসময় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে সে চাকরিতে ইস্তফা দেয়)। ডাক্তার সানফোর্ড বেটি লুককে ঘটনাস্থলেই মৃত ঘোষণা করে। ময়নাতদন্তের জন্য মৃতদেহ নিয়ে যেতে বলে। এই সময় যথেষ্ট পরিমানে ছবি তোলা হয়েছিল, নানান দিক থেকে। ফেয়ারফিল্ড ডেইলি রিপাবলিক পত্রিকার থমাস ডি বালমার বেশ অনেকক্ষন আগেই এখানে উপস্থিত, কিন্তু বারোটা পাঁচে শেরিফের তদন্তকারী না আসা পর্যন্ত তাকে অকুস্থলে যেতে দেয়া হলো না।

সাধারনত বছরে দু’তিনটা খুনের তদন্ত হাতে আসে ডিটেকটিভ সার্জেন্ট লেস ল্যান্ডব্লাডের। এই মুহূর্তে লেক হারমান রোডে দাঁড়িয়ে আছে সে, মাথার টুপিটা তার মুখমন্ডল ঢেকে আছে। উনিশশো তেষট্টিতে শেরিফের অফিসে ডিটেকটিভ হিসেবে যোগ দানের পর থেকেই এই টুপিটা তার নিত্যসঙ্গী।

টর্চের আলোয় পুরো দৃশ্যটার একটা স্কেচ করে নিয়েছে ল্যান্ডব্লাড। ছবি আর ফিঙারপ্রিন্ট নেয়ার জন্য চারপাশ আলোকিত করা হয়েছে। রাস্তায় পুলিশের গাড়িগুলো থেকে আসা রেডিও’র শব্দে চারপাশের নিরবতা ভেঙে গেছে।

অফিসার বাটারবাখ আর ওয়াটারম্যানকে হাসপাতালে পাঠালো ল্যান্ডব্লাড, ডেভিডের স্টেটমেন্ট নেয়ার জন্য। বারোটা তেইশ মিনিটে তারা ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিটে এলো, নার্স বারবারা’র কাছে জানতে পারলো বারোটা পাঁচে ছেলেটা মারা গেছে।

সাথে সাথে শেরিফের অফিসে ফোন করলো ওরা, ডেপুটি জুনিয়র উইলসনকে হাসপাতালে নিয়ে এলো। মৃতদেহের ছবি তোলা হলো, বিশেষ করে কান, চিবুক আর রক্তমাখা চুলের।

অন্যদিকে লেক হারমান রোডে ডেভিডের র‍্যাম্বলার গাড়িতে আঙুলের ছাপ লুকানো আছে কিনা সেটা দেখার জন্য কাজ শুরু হলো। পুলিশের লোকজন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল অস্ত্র কিংবা অন্য কিছু পড়ে আছে কিনা খোঁজার জন্য। 

এখানে পাওয়া ছবি আর অন্যান্য প্রমাণ বেনিসিয়া পুলিশ সোলানো কাউন্টির শেরিফ অফিসে হস্তান্তর করবে। পিটা এবং ওয়ার্নার খুব সুন্দরভাবে ক্রাইম সীনকে সংরক্ষণ করেছে। মৃতদেহটাকে চারপাশের অন্যান্য জিনিস থেকে আলাদা করা হয়েছে, কোন কিছুকে সরানোর আগে সেটার অবস্থানের ছবি তুলে রাখা হয়েছে। আলাদা করে সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা করা হয়েছে যাতে কোর্ট চাইলে তা সেভাবেই উপস্থাপন করা যায়। ঘটনাস্থলে বীর্য বা যৌণকর্মের কোন প্রমাণ পাওয়া যায় কিনা সেটাও দেখা হয়েছে।

মৃতদেহের আকৃতি আঁকা হয়েছে চক দিয়ে, সেখানে নয়টা ফাঁকা গুলির খোসা পাওয়া গেছে। খুন করতে যে অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে সেটা সম্ভবত ২২ ক্যালিবার জে সি হিগিনস ‘৮০ মডেল অথবা হাই স্টান্ডার্ড মডেল। বুলেটগুলো কপারের আবরন মেশানো, উইনচেস্টার কোম্পানীর, উনিশশো সাতষট্টি সালের তৈরি। একদম নতুনই বলা যায়। এছাড়া র‍্যাম্বলারের ছাদে খানিকটা ডেবে যাওয়ার চিহ্ন পাওয়া গেছে।

অ্যাম্বুলেন্সের একজন সহকারীর মতে, তার সারাজীবনে এতো রক্ত সে দেখেনি। ‘এটা আমার দেখা সবচেয়ে ভয়ংকর ডাবল মার্ডার,’ মতামত দিয়েছিল ল্যান্ডব্লাড।

একটা চার মিনিটে ল্যান্ডব্লাড ভালায়ো জেনারেল হাসপাতালে রওনা দিল, তারপর সেখান থেকে কলোনিয়াল চ্যাপেল ফিউনারেল হোমে গেল। সেখানে বাটারবাখ আর ওয়াটারম্যান অপেক্ষায় ছিল, সঙ্গে ছিল হোরান। বেটি লুই জেনসেন’র দেহে গুলির অবস্থান নিয়ে তারা আলোচনা করছিল।

ল্যান্ডব্লাড অন্ধকারে দাঁড়িয়েছিল। ফ্লুরোসেন্ট বাতির আলোয় মেয়েটার দেহের উপর থেকে কাপড় সরালেন হোরান। মেয়েটার সাদা গোলাপি প্যান্টি থেকে কিছু একটা গড়িয়ে পড়ল মেঝেতে, সেটা গিয়ে ল্যান্ডব্লাডের পায়ের কাছে থামল। জিনিসটা তুলে নিল সে। জিনিসটা পয়েন্ট ২২ ক্যালিবারের খোসা, বেটি লুই’র দেহে আটকে গেছে কোনভাবে। ছোট একটা বোতলে জিনিসটা ভরে, রক্তাক্ত কাপড়চোপড়্গুলো নিয়ে নিজের অফিসে ফিরে এলো ল্যান্ডব্লাড। বাটারবাখ আর ওয়াটারম্যান ভোর সাড়ে চারটা পর্যন্ত কাজ করলো, তারপর তারাও ফিরে গেল।

দুপুরের দিকে বেটি লুইয়ের মৃতদেহের ময়নাতদন্ত হলো। ডেভিডেরটা হলো ঘন্টা দেড়েক পর। প্যাথোলজিস্ট ডক্টর সিরাই একটা আটত্রিশে ডেভিডের মাথার খুলির ভেতর দুমড়ানো মুচড়ানো বুলেটটা পেলেন। সেটা তুলোয় মুড়ে ল্যান্ডব্লাডের কাছে পাঠানো হলো।

হত্যাকান্ডের জায়গা আর মৃতদেহগুলো থেকে সাতটা বুলেটের খোসা পাওয়া গেল। এরমধ্যে চারটার অবস্থা ভালো, বাকিগুলোর অবস্থা খারাপ। দুটো খোসা খুঁজে পাওয়া যায়নি, সম্ভবত লেক হারমান রোডের পাশের মাঠে হারিয়ে গেছে। উদ্ধার হওয়া প্রতিটা বুলেটে ঘড়ির কাঁটার দিকে ছয়টা দাগ কাটা।

যখন কোন বন্দুক বানানো হয়, লোহার একটা দন্ড ব্যারেলে ঢোকানো হয়, বুলেট বের হওয়ার সময় এই দন্ডে ঘুরে যায় আর এর পাশগুলো কেটে গিয়ে দাগের সৃষ্টি হয়। ফিঙ্গারপ্রিন্টের মতো এই দাগগুলো দেখে কোন ধরনের বন্দুক থেকে গুলি ছোড়া হয়েছে সেটা খুঁজে পাওয়া যায়।

ল্যান্ডব্লাডের মতে তদন্ত করা উচিত গাছের ডালপালা ধরে ধরে। নিয়ম মেনে প্রতিটা সূত্র ধরে সেটার সাথে তথ্য যোগ করে সে আগাতে চায়। ঘটনাস্থল থেকে আক্রান্তদের বাড়ির দূরত্ব, প্রত্যক্ষদর্শীদের বাড়ির দূরত্ব, তারা কী গতিতে গাড়ি চালাচ্ছিল, এসব ছোটখাট তথ্য দিয়ে সে তদন্ত শুরু করল। নিহতদের শেষ দিনের প্রতিটা মিনিটের হিসেব নেয়া হয়েছে, এজন্য চৌত্রিশটা সাক্ষাৎকারের প্রয়োজন পড়েছে। নিহত দুজনের ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও তদন্ত করেছে ল্যান্ডব্লাড। বেটি লুই আর ডেভিডের পরিবার আর বন্ধুবান্ধবদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে, সেই সাথে কিছু সন্দেহভাজনকেও। বেটি লুইয়ের পরিবার থেকে এটা জানা গেল যে স্কুলে এক ছেলে বেটিকে রীতিমতো অনুসরণ করতো, সে ডেভিডকেও হুমকি দিয়েছিল। এই

ছেলেটাকেই প্রাথমিক সন্দেহভাজন হিসেবে ধরেছিল। এই তথ্যটা ল্যান্ডব্লাডকে দিয়েছিল হোরান, যদিও ছেলেটার একটা শক্ত আলিবাই ছিল। বোনের জন্মদিনের অনুষ্ঠানের পর সে মেয়ার আইল্যান্ডের পুলিশের সঙ্গে বসে রাত এগারোটা পর্যন্ত টেলিভিশন দেখেছিল।

সাধারণ জনগনের কাছ থেকেও সাহায্য চাওয়া হলো। কিন্তু আপাত দৃষ্টিতে এই নৃশংস হত্যাকান্ডের কোন কারণ খুঁজে পাওয়া গেল না। এই ক্ষেত্রে ছিনতাই, ডাকাতি বা যৌণ অত্যাচারের কোন চিহ্ন পাওয়া যায়নি। হয়তো খুনটাই হত্যাকারীর কাছে যৌণ আনন্দ, ধারনা করলো সে।

সেক্রামেন্টোর ক্রিমিনাল আইডেন্টিফিকেশন এন্ড ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট থেকেও কোন খবর পাওয়া গেল না। সেখানে উল্লেখ করে হলোঃ যদি জে সি হিগিন্স ৮০ অটোমেটিক উদ্ধার করা হয়, তাহলে দেখতে হবে সে পিস্তলে ফায়ারিং পিনের পজিশন কী ঘড়ির কাঁটার দিকে কিনা, সেখানে পনেরো ডিগ্রি কোণে কিছু দাগ থাকার কথা। এই মডেলের সব পিস্তলই এক ধরনের, সেক্ষেত্রে ব্যবহৃত পিস্তল চিহ্নিতকরণ বেশ কঠিন কাজ। পরিধেয় বস্ত্রের পরীক্ষায় দেখা গেছে, একটা গর্ত ছিল পিঠের ঠিক মাঝখানে, বাকিগুলো ডানদিকে কাধের উপরের অংশে।

উপরের একটা গর্ত ছাড়া আর কোথাও পোড়া বা গানপাউডারের অবশিষ্টাংশ পাওয়া যায়নি। এই পরীক্ষা থেকে ধারনা করা যায় আক্রান্ত ব্যক্তির কয়েক ফুট দূরত্ব থেকে গুলি ছোড়া হয়েছে। এই দূরত্ব নিরুপণ করা আপাতত সম্ভব নয়।

এই কেসে কোন স্বাক্ষী, কোন মোটিভ বা সন্দেহভাজন কেউ নেই।

চলবে…

রবার্ট গ্রেস্মিথ 

সাহিত্য… 

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

spot_img

সম্পর্কিত নিবন্ধ

জুতা (ছোট গল্প)- আফিন্দী

জুতাবিদ্যুৎ’এর গলার তেজে ফাঁকা মেসরুম গমগম করে উঠলো, “ভাই, তুমি যাবে পাঁচ ভাইয়ে? খিদেয় আমার জান যায়! খালা...

মৃত্যু পরবর্তী জগতের অভিজ্ঞতা 

মৃত্যু পরবর্তী জগতের অভিজ্ঞতা  মৃত্যু পরবর্তী জীবনের অভিজ্ঞতা কেমন? মানুষ তার অনিশ্চিত জীবনে শুধু একটি বিষয়ের নিশ্চয়তা নিয়ে জন্মেছে।...

বুক রিভিউ- হুমায়ূন আহমেদের ‘মেঘ বলেছে যাব যাব’

বুক রিভিউ- হুমায়ূন আহমেদের 'মেঘ বলেছে যাব যাব' বুক রিভিউ- হুমায়ূন আহমেদের 'মেঘ বলেছে যাব যাব'।বইয়ের নাম:মেঘ বলেছে যাব...

ডা. স্যাটান: সিরিয়াল কিলার ডা. মার্সেল পেটিওটের ভয়ংকর গল্প!

তাকে আখ্যা দেয়া হয়েছিল ডা. স্যাটান বলে। তিনি একই সাথে একজন সৈনিক, ডাক্তার, মেয়র, ভয়ঙ্কর অপরাধী এবং সিরিয়াল...