সিনেমা: ডেড পোয়েটস সোসাইটি (১৯৮৯)- রিভিউ

তারিখ:

পোস্ট শেয়ার করুন:

সিনেমা: ডেড পোয়েটস সোসাইটি (১৯৮৯)- রিভিউ

সিনেমা: Dead poets society (1989)

ডিরেক্টর: পিটার উইয়ার

স্ক্রিপ্ট: টম শুলম্যান

আইএমডিবি: ৮.১/১০

রোটেন টম্যাটোজ: 84%

ডেড পোয়েটস সোসাইটি
সংগৃহীত

জীবনের সার্থকতা আসলে কী? প্রতিটি দিনকে ঠিক নিজের মতো করে উপভোগ করাই  আসলে জীবনের সার্থকতা। যেখানে কারো অনুশাসন থাকবে না, কড়া চোখে বারণ রবে না। যার মূল ভিত্তি রবে- কার্পে ডিয়াম। যার অর্থ তোমার বর্তমানকে লুফে নাও। জীবনকে রঙিন ও অসাধারণ করে তোলো। এই যে জীবনকে আমি যেভাবেই চাই সেভাবেই উপভোগ করাটাই আসলে সার্থকতা।

মানুষের একটিই জীবন অথচ সেখানে হাজারো অনুভূতি। এই অনুভূতি গুলোই আমাদের বাঁচতে শেখায় আবার এই অনুভূতির জন্যই বাঁচার ইচ্ছে মরে যায়। কখনো আনন্দ কখনোবা দুঃখ; কখনো প্রেম আসে, কখনোবা ফিরে যায়-ফিরেও তাকায় না; বন্ধুত্ব বাড়ে- আবার হারিয়েও যায় বয়সের ভারে! কখনোবা ব্যর্থতা- তুচ্ছ করে দেয় সমগ্র জীবন, কখনোবা সাফল্যের জয়গান- ভুলিয়ে দেয় সকল ব্যর্থতার গ্লানি! কখনো জড়ো হয় হারানোর ভয়, কখনোবা সংগ্রামের স্পৃহা বুকে আনে জ্বালাময়ী গান। এসবই জীবনের উপাদান। আর এই সবগুলো উপাদানের চিত্র ফুটে উঠেছে “ডেড পোয়েটস সোসাইটি”তে।

১৯৮৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই সিনেমাটিতে আপনি নতুন করে খুঁজে পাবেন জীবনের মানে। যেখানে প্রতিটি মুহূর্তই ‘কার্পে ডিয়াম।’ অর্থাৎ বর্তমানকে লুফে নাও। সিনেমার কাহিনি এগিয়েছে স্কুলে পড়তে আসা একদল টিনেজ বয়সী আলাদা-আলাদা চিন্তাধারার শিক্ষার্থীদের নিয়ে। যেখানে সবাই নিজেদের জীবনকে উপভোগ করতে চায়।

টম শুলম্যানের কাহিনি এবং পিটার উইয়ারের পরিচালনায় ১৯৮৯ সালে মুক্তি পাওয়া ডেড পোয়েটস সোসাইটি মূলত টিনএজ ড্রামা জনরার সিনেমা। সিনেমায় মূখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেছেন লিজেন্ডারি অভিনেতা রবিন উইলিয়ামস। এছাড়াও নিখুঁত পরিচালনা, যথাযথ স্ক্রিনপ্লে এবং একদল ডানপিটে বালকদের অনবদ্য অভিনয়ে সিনেমাটি হয়ে উঠেছে জীবনমুখী গল্পের সম্পূর্ণ প্যাকেজ।

কাহিনী সংক্ষেপ:

কাহিনি শুরু হয় ১৯৫৯ সালের স্নিগ্ধ শরতের এক সকালে “ভেরমন্টের ওয়েল্টন একাডেমি”র ওরিয়েন্টেশন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। যেখানে একদল নতুন শিক্ষার্থীদের স্বাগত জানানো হচ্ছিল, সাথে তাদের একাডেমির রুলস ও রেগুলেশন সম্পর্কে অবগত করা হচ্ছিল। পাংশু মুখে বসে থাকা ছেলেমেয়েগুলোর কাছে এটিকে নিতান্ত কারাগার বলে মনে হচ্ছিল! কারণ, তাদের বোঝানো হচ্ছিল জীবনের চারটি খুঁটি হলো- Tradition, Honour, Discipline, Excellence. কিন্তু তাদের কাছে চারটি খুঁটি ভিন্ন ছিল- Travesty, Horror, Decadence, Excrement.

ওরিয়েন্টেশন শেষে অভিভাবকগণ বিদায় নেন, ছেলেমেয়েগুলো খুঁজে পায় নতুন পরিবার অর্থাৎ নতুন সব বন্ধুদের। তাদের পরিচয় পর্ব দিয়ে এই অংশ শেষ হয়।

এরপর, অপেক্ষা করছিল ছেলেগুলোর জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। যা তাদের জীবনকে অন্যরকম ভাবতে শেখায়। তাদের জীবনে আগমন ঘটে এক নতুন মানুষের। যার হাত ধরে উঠে আসে একদল শিক্ষার্থীর জীবনকে নতুনভাবে ভাবার গল্প। যিনি নতুন এক ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখান। তিনি হচ্ছেন, জন কিটিং। কিন্তু কে এই জন কিটিং?

আচ্ছা ধরুন, ক্লাসের প্রথম দিনে  কোনো শিক্ষক শিস দিতে-দিতে ক্লাসে প্রবেশ করল, তাহলে ব্যাপারটা কেমন দেখাবে? হ্যাঁ, এমনই এক ঘটনা ঘটান জন কিটিং নামের এক ইংরেজি  প্রোফেসর। ঠিক হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো করে শিস বাজিয়ে তিনি ক্লাসের সকল স্টুডেন্টকে আকর্ষণ করেন। তিনি নিজের পরিচয়ের পাশাপাশি বলেন, “আমাকে তোমরা ভালোবেসে ‘ও ক্যাপ্টেন, মাই ক্যাপ্টেন’ নামেও ডাকতে পারো।“ পরবর্তীতে এই ডায়ালগটি আইকনিক হয়ে ওঠে।

প্রোফেসর কিটিং তাঁর প্রথম ক্লাসেই ছাত্রদের বোঝান,  ‘Carpe diem. Seize the day, boys.  Make your lives extraordinary. দিনটি উপভোগ করো। প্রতিটি দিনকেই উপভোগ করো। তোমাদের জীবনকে অসাধারণ করে তোলো।’

জন কিটিং-এর ভিন্নধর্মী ক্লাস থেকে ছাত্ররা গতানুগতিক শিক্ষাব্যবস্থা থেকে হাপ ছাড়ার এক প্রয়াস খুঁজে পায়। তাঁর হাত ধরেই জেগে ওঠে এক নতুন প্রজন্মের।

ডেড পোয়েটস সোসাইটি
ডেড পোয়েটস সোসাইটি

পরেরদিন দ্বিতীয় ক্লাসে জন কিটিং আরেকটি অদ্ভুত কাণ্ড করে বসেন। তিনি সবাইকে কবিতার বইয়ের ২১ নম্বর পৃষ্ঠা বের করতে বলেন এবং জোর গলায় বলেন, ‘ছিঁড়ে ফেলো’! সবাই অবাক হয়ে তাকায়, তারা কি ঠিক শুনেছে? মি. কিটিং আবারও বলেন, “ছিঁড়ে ফেলো।“ কেননা, এই পৃষ্ঠায় লেখা ছিল কবিতার নিয়মকানুন। তিনি বলেন, কবিতা কোনো নিয়ম মানে না। তিনি ছাত্রদের বোঝান, “You will learn to savour words and language. No matter what anybody tells you. Words and ideas can change the word.”

তিনি ডিসিপ্লিন ভেঙে ছাত্রদের টেবিলের উপর দাঁড়াতে বলেন৷ তিনি উপলব্ধি করান যখন জীবনকে একমূখীভাবে দেখতে বিরক্তি চলে আসবে তখন দেখার ধরণ বদলাতে হবে।

ছাত্ররা উনার চমৎকার উপস্থাপনে মুগ্ধ হয়। তাই তাঁর ব্যাপারে জানতে আগ্রহী হয়। তারা স্কুলের একটি পুরনো ম্যাগাজিন খুঁজে পায়। যেখানে প্রোফেসর কিটিং-কে তাঁর সহপাঠীদের সাথে গ্রুপ ফটোতে দেখা যায়। সেইসাথে উনার রচিত কবিতা এবং শেষে খুঁজে পায় একটি লাইন- ডেড পোয়েটস সোসাইটি।

ছাত্ররা কৌতূহলী হয়ে কিটিং-কে পেছন থেকে ডাক দেয়, ‘ও ক্যাপ্টেন, মাই ক্যাপ্টেন!’ কিটিং মুচকি হেসে পেছনে ফিরে তাকালে ছাত্ররা ডেড পোয়েটস সোসাইটি সম্পর্কে জানতে চায়।

জন কিটিং বলেন, উনি যখন একাডেমির ছাত্র ছিলেন তখন বন্ধুদের নিয়ে এই ডেড পোয়েটস সোসাইটি তৈরি করেন। এর মূল উদ্দেশ্য হলো জীবনকে ভিন্ন আঙ্গিকে উপভোগ করা। রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে উনারা চুপিচুপি হল থেকে বেরিয়ে যেতেন। এরপর জঙ্গলে গিয়ে একটা গুহাতে ঢুকে সবাই আনন্দের সাথে নিজের উপমায় কবিতা আবৃত্তি করতেন। যদিও সেইসব আবৃত্তিতে অশ্লীলতারও যোগান ছিল।

বয়সের উদ্দীপনায় ছাত্ররা এ ব্যাপারে খুব কৌতূহলী হয়ে উঠলো। তারা কয়েকজন মিলে সিদ্ধান্ত নিলো একইভাবে জীবন উদযাপন করবে। রাতের আঁধারে চুপিসারে কয়েকজন ছাত্র Pitts, Stephen Meeks, Todd Anderson, Charlie Dalton, Knok Overstreet, Neil Perry বেরিয়ে পড়ে গুহার সন্ধানে। তারা গুহায় বসে একেএকে নিজনিজ পছন্দের কবিতা আবৃত্তি করলো। তারা জীবনকে উপভোগ করার নতুন তরিকা খুঁজে পেলো। ঠিক যেন গভীর গুহার মাঝে জ্বলে উঠলো এক ঝাঁক নক্ষত্র। তারা গড়ে তুলল নিজেদের ‘ডেড পোয়েটস সোসাইটি।’ এরপর থেকে প্রতি রাতেই তারা হল থেকে পালিয়ে বেরিয়ে পড়ত সার্থক জীবনের অন্বেষণে। গুহার অন্ধকারে পিদিমের আলোয় ঝলমলে হয়ে উঠছিল তাদের ভবিষ্যতের ইচ্ছে, আকাঙ্খাগুলো।

কিন্তু, এই আনন্দ বেশিদিন স্থায়ী হবার আগেই নতুন বিপত্তি ঘটে যায়।  চার্লি ডাল্টনের একটি আর্টিকেল ম্যাগাজিনে ছাপানোর পরে জানাজানি হয়ে যায় ডেড পোয়েটস সোসাইটি সম্পর্কে। এরপরে জন কিটিং-একাডেমি-ডেড পোয়েটস সোসাইটি তৃমুখী বিরোধে ঘটনাপ্রবাহ অন্যদিকে মোড় নেয়। আর স্পয়লার না দিই, এরপরে ঠিক কী ঘটে জানতে হলে আপনাকে সিনেমাটি দেখতে হবে।

সিনেমার কোথাও বোরিং হবার সু্যোগ নেই। সিনেমাটি দেখার সময়ে আপনারও ইচ্ছে হবে, গুহায় বসে সমস্বরে কবিতা আবৃত্তি করতে। ফিরে যেতে ইচ্ছে হবে ডানপিটে বয়সে জীবনের অন্বেষণে বেরিয়ে পড়তে।

সিনেমার আইকনিক মূহুর্ত; শেষ দৃশ্যে যখন প্রোফেসর কিটিং বিদায় নিচ্ছিলেন, ক্লাসের ছাত্ররা স্কুলের বেঁধে দেওয়া ডিসিপ্লিনের তোয়াক্কা না করে বেঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে বুলি আউড়াতে শুরু করে,

ও ক্যাপ্টেন, মাই ক্যাপ্টেন! তাদের ধরে যাওয়া গলা, ছলছলে চোখের অনুসরণে আপনার বুকের ভেতর থেকেও কাঁপাকাঁপা স্বরে বেরিয়ে আসবে, ‘ও ক্যাপ্টেন, মাই ক্যাপ্টেন!’

অভিনয়:

অভিনয়ের দিক থেকে সবাই ছিল অনবদ্য। রবিন উইলিয়ামস-এর জন কিটিং চরিত্রের পাশাপাশি Charlie Dalton, Neil Perry, Todd Anderson, Knok Overstreet এর মতো চরিত্রগুলো তাদের প্রত্যেকের জায়গা থেকে অনবদ্য অভিনয় করেছে। সমালোচনা করার কোনো অভিযোগ রাখেনি। সাথে সহযোগী অভিনেতারাও অভিনয়ে কোনো কমতি রেখেনি।

পরিশিষ্ট:

সিনেমাটি বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যিকভাবে ভালো সাফল্য পায়। বক্স অফিসে $২৩৫,৮৬০,৫৭৯ ডলার মতো আয় করে নেয়, যার মধ্যে ডোমেস্টিক আয় ছিল $৯৫,৮৬০,১১৬ ডলার।

এছাড়াও সিনেমাটি সেরা পরিচালক, সেরা চলচ্চিত্র এবং সেরা অভিনেতা হিসেবে রবিন উইলিয়ামস একাডেমি পুরষ্কারের জন্য মনোনয়ন পান। এছাড়াও সিনেমাটি সেরা চলচ্চিত্র ক্যাটাগরিতে বাফটা পুরষ্কার, সেরা বিদেশি চলচ্চিত্রের জন্য সিজার পুরস্কার এবং সেরা বিদেশি চলচ্চিত্রের জন্য ‘ডেভিড ডি ডোনাটেলো’ পুরষ্কারও জিতেছে।

তাই, বোরিং সময় থেকে সাময়িক প্রশান্তি পেতে দেখে নিতে পারেন এই চমৎকার সিনেমাটি।

শেষে একটা বাক্য দিয়ে শেষ করি,

”When you read, don’t just consider what the author thinks, consider what you think”

Seize your day.

সিনেমার গল্পসল্প

রিভিউ করেছেন drishty rubayet

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

spot_img

সম্পর্কিত নিবন্ধ

জুতা (ছোট গল্প)- আফিন্দী

জুতাবিদ্যুৎ’এর গলার তেজে ফাঁকা মেসরুম গমগম করে উঠলো, “ভাই, তুমি যাবে পাঁচ ভাইয়ে? খিদেয় আমার জান যায়! খালা...

মৃত্যু পরবর্তী জগতের অভিজ্ঞতা 

মৃত্যু পরবর্তী জগতের অভিজ্ঞতা  মৃত্যু পরবর্তী জীবনের অভিজ্ঞতা কেমন? মানুষ তার অনিশ্চিত জীবনে শুধু একটি বিষয়ের নিশ্চয়তা নিয়ে জন্মেছে।...

বুক রিভিউ- হুমায়ূন আহমেদের ‘মেঘ বলেছে যাব যাব’

বুক রিভিউ- হুমায়ূন আহমেদের 'মেঘ বলেছে যাব যাব' বুক রিভিউ- হুমায়ূন আহমেদের 'মেঘ বলেছে যাব যাব'।বইয়ের নাম:মেঘ বলেছে যাব...

ডা. স্যাটান: সিরিয়াল কিলার ডা. মার্সেল পেটিওটের ভয়ংকর গল্প!

তাকে আখ্যা দেয়া হয়েছিল ডা. স্যাটান বলে। তিনি একই সাথে একজন সৈনিক, ডাক্তার, মেয়র, ভয়ঙ্কর অপরাধী এবং সিরিয়াল...