অটোমান সাম্রাজ্য : ক্ষমতার  উত্থান এবং পতনের গল্প

তারিখ:

পোস্ট শেয়ার করুন:

অটোমান সাম্রাজ্য : ক্ষমতার  উত্থান এবং পতনের গল্প

অটোমান সাম্রাজ্য, বিশালতার উদাহরণ হিসেবে আজও যে সাম্রাজ্যের নাম চলে আসে। তবে অটোমান সাম্রাজ্য শুধু বিশাল নয়,মধ্যযুগের সবচেয়ে  ক্ষমতাধর এবং শক্তিশালী সাম্রাজ্য ছিল।  ইতিহাসের প্রতি যাদের আগ্রহ রয়েছে, তাদের মধ্যে বরাবরই কৌতুহল দেখা যায় শক্তিশালী এই সাম্রাজ্যের উত্থান এবং পতন নিয়ে। এশিয়া , ইউরোপ এবং আফ্রিকা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এই সাম্রাজ্য, যা ৬০০ বছরের বেশি সময় ধরে শাসন করেছে। চলুন জেনে নেওয়া যাক,  শক্তিশালী এই সাম্রাজ্যের উত্থান এবং পতনের গল্প।

১৩০০ খ্রিষ্টাব্দে একদিকে যখন  বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের আধিপত্য  কমতে শুরু হয় অন্যদিকে তুর্কিশ রুম সেলজুক সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়ে যায়। এই সাম্রাজ্যটি এনাতোলিয়াতে অবস্থিত ছিল । সেলজুক সাম্রাজ্য  ধ্বংস হয়ে গেলে তুর্কিরা এনাতোলিয়াতে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে যায়। তুর্কিরা জাতি হিসেবে ছিল যোদ্ধা এবং তারা গাজী নামেও পরিচিত ছিল। প্রাচীনকাল  থেকেই তাদের  বিভিন্ন রাজ্য দখল করে নেওয়ার ইতিহাস শোনা যায়।  কিন্তু সেলজুক রাজ্য ধ্বংসের পর তারা কোনো কেন্দ্রীয় শক্তি দ্বারা আবদ্ধ ছিল না। ঠিক এই সময়েই উসমান নামের একজন নেতার আগমন ঘটে। তিনিই মূলত ১৩০০-১৩২৬ খ্রিষ্টাব্দে এনাতোলিয়াতে একটি মুসলিম রাজ্য স্থাপন করেন এবং তুর্কীদের এই ছোট ছোট দলগুলোকে কেন্দ্রীয় শক্তি দ্বারা আবদ্ধ করেন।

অটোমান সাম্রাজ্য
Source: https://cdn.britannica.com/86/64886-050-49479F82/Ottoman-Empire-extent.jpg

এই উসমানকেই ইউরোপীয়রা ডাকতো অথমান নামে এবং তার অনুসারীদের অথম্যান। সেই থেকেই এই সাম্রাজ্যের নাম হয় অটোমান। যা পরবর্তীতে তিনটি মহাদেশ এশিয়া, ইউরোপ এবং আফ্রিকা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।

উসমান এনাতোলিয়াতে তার রাজ্য স্থাপনের পর থেকেই অটোমান গাজীরা তাদের আশে পাশের বিভিন্ন এলাকা কিনে নিতে শুরু করে। সেইসাথে কিছু কিছু অঞ্চল যুদ্ধ করেও দখল করে নেয়। এইসময় তারা বাইজেন্টান সাম্রাজ্যের ওপরেও আক্রমণ শুরু করে।

অটোমানদের সামরিক কৌশল এবং অস্ত্র ছিল অন্য সকলের চেয়ে আলাদা। এরমধ্যে অন্যতম ছিলো তাদের গানপাউডার। এছাড়া সেই সময় থেকেই তারা কামান ব্যবহার করত। যার ফলে অন্যান্য  সাম্রাজ্যগুলো তাদের এড়িয়ে চলতে শুরু করে ।

অটোমান সাম্রাজ্য
মেহমেদ দ্বিতীয় By Fausto Zonaro – http://www.worldvisitguide.com/oeuvre/O0025022.html, Public Domain, https://commons.wikimedia.org/w/index.php?curid=2727680

এর পরেই আগমন হয় উসমানের পুত্র অরখানের, যিনি নিজেকে সুলতান হিসেবে ঘোষনা করেন। ১৩৬১ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান অরখান বাইজেন্টান সাম্রাজ্যের আরেকটি শহর এড্রিয়ানোপোল দখল করে নেয়। যা এখন আধুনিক তুর্কীতে অবস্থিত। এরপরে সাম্রাজ্যের সুলতান হয় মুরাদ। উসমান,অরখান এবং মুরাদের সাফল্যের দ্বারাই অটোমান সাম্রাজ্যের উত্থান শুরু হয়।

কিন্তু এর পরেই বায়েজিদ দ্বিতীয় এর সময়কালে তৈমুর লং  অটোমান আক্রমণ করলে  বেশ কিছু সময় পর্যন্ত অটোমানের বিস্তার বন্ধ হয়ে যায়।তবে তৈমুর অটোমান ছেড়ে চীনের দিকে চলে গেলে আবার শুরু হয় সাম্রাজ্যের বিস্তার।

১৪৫১ খ্রিষ্টাব্দে মেহমেদ দ্বিতীয় অটোমান সাম্রাজ্যের সুলতান হন। তিনি মাত্র ২১ বছর বয়সে ক্ষমতায় বসেন এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তার সময়েই বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের  আধিপত্য  কমতে থাকে। বাইজেন্টাইনের রাজধানী কনস্টান্টিনোপলের জনসংখ্যাও কমতে শুরু করে। কিন্তু তখনো বসফরাস প্রণালি বাইজেন্টাইনদের দখলেই ছিল, যা ইউরোপকে এশিয়ার সাথে  সংযুক্ত করে। যার নিয়ন্ত্রন তুর্কীদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যার কারনে মেহমেদ কনস্টান্টিনোপল  দখল করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। অবশেষে ১৪৫৩ খ্রীষ্টাব্দে তিনি কনস্টান্টিনোপল আক্রমন করেন। তার সেনারা দুর্দান্ত পরিকল্পনার মাধ্যমে শহরটিকে দুইদিকে থেকে ঘিরে ফেলে এবং তাদের শক্তিশালী অস্ত্র দ্বারা আক্রমণ চালায়। শহরটি সাত সপ্তাহ ধরে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা চালায় কিন্তু কোনো ভাবেই নিজেদের রক্ষা করতে পারেনা। অবশেষে মেহমেদের সেনারা দখল করে নেয়  বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনোপল। এর মাধ্যমেই পতন হয় হাজার বছরের বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য। যার কারণে ইউরোপীয়রা পরবর্তীতে ভারতীয় উপমহাদেশ এবং আমেরিকার দিকে চলে যায় এবং তাদের কলোনী স্থাপন করে।

অটোমান সাম্রাজ্য
কনস্টান্টিনোপল অবরুদ্ধ By Jean Le Tavernier – Illustration by fr (Jean Le Tavernier) accompanying a translation by Jean Miélot of Bertrandon de la Broquière’s Voyage d’Outre-Mer. It is one of three full-page miniatures in the Bibliothèque nationale de France, MSS fr. 9087, at folio 207 vv.Image taken from:http://expositions.bnf.fr/flamands/grand/fla_444.htm, Public Domain, https://commons.wikimedia.org/w/index.php?curid=87115344

মেহমেদ যে শুধু ভালো যোদ্ধাই ছিলো তা নয়, তিনি অসাধারণ  শাসকও ছিলেন। তিনি কনস্টান্টিনোপলে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পর সব ধর্মের মানুষকে স্বাগত জানায় তার রাজ্যে। সবাই মিলে আবার নতুন করে গড়ে তোলার চেষ্টা চালায় শহরটিকে। শহরটির নাম বদলে ইস্তাম্বুল নামকরণ করা হয় এবং ইস্তাম্বুলকে অটোমানের রাজধানীও ঘোষণা করা হয়। ইস্তাম্বুল খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পুরো বিশ্বে বানিজ্য এবং সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।

তবে অটোমান সাম্রাজ্যের সোনালী যুগ শুরু হয়, যখন সুলতান সুলাইমান ক্ষমতায় আসেন। সুলতান সুলাইমান ১৫২০ খ্রীস্টাব্দে  ক্ষমতায় এসে দীর্ঘ ৪৬ বছর শাসন করেন। সুলাইমান একজন অসাধারণ যোদ্ধা ছিলেন। তিনিই মূলত এশিয়া, ইউরোপ এবং আফ্রিকার বেশিরভাগ অঞ্চল জয় করেন। তিনিই প্রথম এই সাম্রাজ্যের আইন প্রনয়ণ করেন। এছাড়াও যেহেতু সুলাইমানের সময় সাম্রাজ্য বিশাল আকার ধারণ করে, সুলতানের পক্ষে সাম্রাজ্য পরিচালনা কঠিন হয়ে পরে। এই সময়েই সুলতান সাম্রাজ্যকে একটি সরকারী কাঠামোর মধ্যেও নিয়ে আসেন। তিনি নতুন কোনো রাজ্য জয় করলে, সেখানকার আঞ্চলিক লোকজন দিয়েই সেই অঞ্চল পরিচালনা করতেন। যাতে রাজ্য পরিচালনায় কোনো সমস্যা না হয়। অটোমান সাম্রাজ্য একটি মুসলিম সাম্রাজ্য হলেও অন্যান্য ধর্মের মানুষ যেমন খ্রিস্টান, ইহুদিদের যেন তাদের ধর্ম পালনে বাধা দেওয়া হয়, তিনি সেদিকেও খেয়াল রাখতেন। সুলাইমান রাজ্যের প্রজাদের জীবনমান উন্নয়নের দিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন,  যার ফলে তিনি তার প্রজাদের প্রিয় হয়ে ওঠেন। তিনিই ছিলেন এই সাম্রাজ্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় সুলতান।

অটোমান সাম্রাজ্য
Sultan Suleiman By After Titian – Kunsthistorisches Museum Wien, Public Domain, https://commons.wikimedia.org/w/index.php?curid=2646041

বিশাল এই সাম্রাজ্যের পতন কীভাবে হয় তা নিয়ে অনেকেরই আগ্রহ রয়েছে, ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে এই সাম্রাজ্যের আধিপত্য  কমতে শুরু করে। এর প্রধান কারণ ছিল ইউরোপে শিল্প বিপ্লব।  অন্যদিকে সুলতান সুলাইমান তার প্রথম পুত্রকে হত্যা করেন এবং দ্বিতীয় পুত্রকে রাজ্য থেকে বিতাড়িত করে তৃতীয় পুত্র সেলিমকে ক্ষমতায় বসান। সেলিম অটোমানের মত বিশাল সাম্রাজ্য পরিচালনায় মোটেও দক্ষ ছিলেন না। বলা হয়ে থাকে সুলতান সুলাইমানের পর অটোমান সাম্রাজ্যে আর কোনো যোগ্য সুলতানের আগমন ঘটে নি। পরবর্তী সুলতানেরা বিশ্ব বানিজ্যের দিকেও পিছিয়ে পরেন।

১৬৮৩ সালে ভিয়েনার যুদ্ধে তুর্কিরা হেরে যায়। এই হার তাদের সাম্রাজ্যকে আরো পতনের দিকে নিয়ে যায়। পরবর্তীতে আরো বিভিন্ন যুদ্ধে সাম্রাজ্যটি তার গুরুত্বপূর্ণ  অঞ্চলগুলো হারিয়ে ফেলে।

অটোমান সাম্রাজ্য
The Battle of Kahlenberg, 1683 by Frans Geffels www.reed.edu

১৮৩০ সালে গ্রিস বিল্পবের মাধ্যমে অটোমান সাম্রাজ্য থেকে আলাদা হয়ে যায়। ১৮৭৮ সালে রোমানিয়া, হাঙ্গেরি এবং বুলগেরিয়াও তাদের থেকে স্বাধীন হয়ে যায়।

১৯১২ সালের বলকান যুদ্ধে অটোমান সাম্রাজ্যের ইউরোপের বেশিরভাগ অঞ্চল হারিয়ে যায়। বলকান যুদ্ধের মাত্র দুই বছর পরেই শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সাথে তুর্কির সরাসরি কোনো সংযোগ না থাকলেও, বলকাল যুদ্ধে ইউরোপের যেসব অঞ্চল তারা হারিয়ে ফেলে, সেসব অঞ্চল ফিরে পাওয়ার লোভে তারা এই যুদ্ধে যোগ দেয়।  এছাড়াও, সেই সময়ে জার্মানির সাথে তুর্কির শাসক কামাল পাশার মিত্রতা গভীর ছিল।

যার ফলস্বরূপ, তুর্কি জার্মানি এবং অস্ট্রিয়া-হাংগেরির পক্ষে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেয়। কিন্তু এই যুদ্ধে জার্মানি হেরে গেলে তুর্কি তার নিজের অঞ্চল ফিরে তো পায় নি বরং তারা তাদের আরো বেশ কয়েকটি অঞ্চল হারিয়ে ফেলে। যা পরবর্তীতে রাশিয়াসহ অন্যান্য বেশ কয়েকটি দেশের অংশ হয়ে যায়।

অবশেষে ১৯২২ সালে অটোমান সুলতান পদবী বাতিল হয়ে গেলে আনুষ্ঠানিকভাবে এই সাম্রাজ্যের পতন ঘটে।

২৯ অক্টোবর, ১৯২৩ সালে মোস্তাফা কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে তুর্কিকে একটি স্বাধীন প্রজাতন্ত্রে রূপান্তরিত করা হয়। তিনি ১৯২৩- ১৯৩৮ পর্যন্ত তিনি তুর্কির রাষ্ট্রপতি হিসেবে ভূমিকা পালন করেন। তবে আধুনিক তুর্কির সংস্কৃতিতে এখন পর্যন্ত অটোমান সুলতানদের প্রভাব দেখা যায়। এমনকি ইউরোপ, আফ্রিকা এবং এশিয়ার অন্যান্য যেসব অঞ্চল অটোমানদের আধিপত্য ছিল সেইসব অঞ্চলের সংস্কৃতি, শিল্প এবং স্থাপত্যে অটোমান সুলতানদের প্রভাব দেখা যায়।  অটোমান  সুলতানরা তাদের সামরিক দক্ষতা, শিল্প, সংস্কৃতি,  স্থাপত্য কলার কারণে এখনো স্মরনীয় হয়ে আছেন।

লিখেছেন- Dinar Hossain Himu

গল্পসল্প ইতিহাস

 

 

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

spot_img

সম্পর্কিত নিবন্ধ

জুতা (ছোট গল্প)- আফিন্দী

জুতাবিদ্যুৎ’এর গলার তেজে ফাঁকা মেসরুম গমগম করে উঠলো, “ভাই, তুমি যাবে পাঁচ ভাইয়ে? খিদেয় আমার জান যায়! খালা...

মৃত্যু পরবর্তী জগতের অভিজ্ঞতা 

মৃত্যু পরবর্তী জগতের অভিজ্ঞতা  মৃত্যু পরবর্তী জীবনের অভিজ্ঞতা কেমন? মানুষ তার অনিশ্চিত জীবনে শুধু একটি বিষয়ের নিশ্চয়তা নিয়ে জন্মেছে।...

বুক রিভিউ- হুমায়ূন আহমেদের ‘মেঘ বলেছে যাব যাব’

বুক রিভিউ- হুমায়ূন আহমেদের 'মেঘ বলেছে যাব যাব' বুক রিভিউ- হুমায়ূন আহমেদের 'মেঘ বলেছে যাব যাব'।বইয়ের নাম:মেঘ বলেছে যাব...

ডা. স্যাটান: সিরিয়াল কিলার ডা. মার্সেল পেটিওটের ভয়ংকর গল্প!

তাকে আখ্যা দেয়া হয়েছিল ডা. স্যাটান বলে। তিনি একই সাথে একজন সৈনিক, ডাক্তার, মেয়র, ভয়ঙ্কর অপরাধী এবং সিরিয়াল...