হেমন্ত হাসান এর গল্প
মেয়েমানুষী
“তমাল সাহেব….”
খুব মনোযোগ দিয়ে আমি ইন্টারনেটে নাসার একটি আর্টিকেল পড়ছিলাম। বেশ কয়েক বছর ধরে নাসা ইউরেনাস গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব নিয়ে তুমুল গবেষণা করে আসছিল। খুব সম্প্রতি তাদের রেফারেন্স দিয়ে খবরের কাগজগুলো মানুষ আকৃতির একটি ছায়ার ছবি ছেপে দাবি করেছে, এই ছবিটি নাকি ইউরেনাস গ্রহের অভ্যন্তর থেকে তোলা। তারা স্পষ্ট করেই বলেছে, পৃথিবীর বাইরে অন্যকোন গ্রহে বুদ্ধিমান প্রাণী বা এলিয়েন থাকা না থাকা নিয়ে মানুষের মনে যে কৌতূহল ছিল তা এবার দূর হয়ে গেছে। পৃথিবীর বাইরেও যে বুদ্ধিমান প্রাণী আছে বিষয়টি খবরের কাগজগুলো মোটামুটি নিশ্চিত। কিন্তু আমি কেন জানি নিশ্চিত হতে পারছিলাম না। তাই এই ব্যাপারে স্বয়ং নাসার বক্তব্য কী সেটাই জানার চেষ্টা করছিলাম। এরই মাঝে কেউ আমাকে নাম ধরে ডাকল। আমি জানি আমাকে কে ডেকেছে। তবু আমি তার ডাকে সাড়া দিলাম না। আমি আমার কম্পিউটারের মনিটরের দিকে তাকিয়ে এমন একটা ভাব করে থাকলাম, যেন আমি প্রচন্ড ব্যস্ত এবং কারও ডাক আমি শুনতে পাইনি।
“এই যে তমাল সাহেব….”
লোকটা আবার আমাকে ডাকল। এবার শুধু ডেকেই ক্ষান্ত থাকল না- আমার কাঁধে হাত রেখে একটা ঝাঁকুনি দিল। সেই ঝাঁকুনি খেয়ে আমার মনে হল, আমার কাঁধের এক পাশের হাড্ডি আলগা হয়ে এল! এর নাম আব্দুল মজিদ। সহজে তার হাত থেকে নিস্তার নেই। লোকটাকে আমি একদম পছন্দ করিনা। সারাক্ষণ সে মুখ লাল করে পান খায়। শুধু পান না, পানের সাথে রতন না হাকিমপুরি কি এক জর্দা মিশিয়ে খায়। সেই জর্দার এত তীব্র ঝাঁজ যে, সে পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেই আমার মাথা ঝিমঝিম করে। বমি পায়। মজিদ সাহেবের আরেকটি বদ অভ্যাস হচ্ছে, শ্রোতার বিরক্তি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে অনর্গল বকবক করা। এছাড়াও সে ফুলের টবে পানের পিক ফেলে অফিসের অল্প বয়েসী ক্লিনার ছেলেটাকে বসের বকা খাওয়ায়। এই লোক এমন একটা আধুনিক কোম্পানিতে চাকুরি পেল কীভাবে কে জানে!
ঘাড়ের অন্যপাশটাও নড়ে যাবার আশঙ্কায় আমি আমার বৃথা অভিনয়ের চেষ্টা বাদ দিলাম। ঘাড় ঘুরিয়ে মুখে কৃত্রিম একটা হাসি ফুটিয়ে বললাম, আরে মজিদ সাহেব যে। কী খবর বলুন।
মজিদ সাহেব দাঁত বের করে হাসলেন। সাথে সাথে জর্দার বিকট গন্ধের একটা দমকা হাওয়া বয়ে গেল। আমার নাড়িভুঁড়িগুলো প্রায় আমার গলার কাছে এসে থেমে আছে। আর একটা মাত্র সুযোগ পেলেই তারা মুখ দিয়ে বের হয়ে আসবে। মুখ ভর্তি পান নিয়ে মজিদ সাহেব বলল, এত মনোযোগ দিয়ে কী পড়ছিলেন?
তেমন কিছুনা, ঐ নাসার একটা রিপোর্ট আরকি।
কী বিষয়ে রিপোর্ট?
কিছুদিন আগে পত্রিকাগুলো ইউরেনাস গ্রহে এলিয়েনের ছায়ার একটা ছবি ছাপালো না- সেই বিষয়ে।
অ। আচ্ছা তমাল সাহেব, এটা কী সম্ভব?
কোনটা?
পৃথিবীর বাইরব অন্য কোন জায়গায়, ধরেন ইউরেনাস গ্রহেই, মানুষ বা অন্য কোন প্রানী কি বাস করতে পারে?
অসম্ভব বলে তো কিছু নেই। হতেও পারে। মহাবিশ্বের খুব ক্ষুদ্র অংশই এখন পর্যন্ত মানুষ জানতে পেরেছে।
মজিদ সাহেব তার হাসিটা আরও বিস্তৃত করে বলল, ইউরেনাস গ্রহে মানুষ বা কোন প্রানী বেঁচে আছে এমনটা হলে তো সেখানে গাছপালাও থাকার কথা তাইনা? অক্সিজেন ছাড়া তো আর মানুষের বেঁচে থাকা সম্ভব না।
সম্ভাবনা আছে। বরং ব্যাপারটা এমন যে, সেখানে গাছপালা থাকলে মানুষ বা অন্যান্য প্রাণীদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেশি। কেননা সকল ধরনের প্রাণী কোনও না কোনভাবে উদ্ভিদের উপর নির্ভশীল।
হুম…. তমাল সাহেব, মানুষ থাকলে, গাছপালা থাকলে, লতাগুল্ম থাকলে সেখানে তো পানও চাষ হবার কথা!
কথা শুনে রাগে আমার পিত্তি জ্বলে গেল। ব্যাটা বলে কী? ইউরেনাস গ্রহে পান চাষ হবে!
মজিদ সাহেব হাসি হাসি মুখে বলল, ধরুন তমাল সাহেব, কোন একদিন মানুষ আর এলিয়েনরা মিলে মিশে ইউরেনাস গ্রহে বসবাস শুরু করল৷ তখন এলিয়েনদের আমি পান খাওয়া শেখাব। পান খেতে খেতেই তাদের সাথে আমার বন্ধুত্ব গাঢ় হতে থাকবে। আমরা মিলে মিশে একটা পানের বরজ করব। বরিশালের পান। আপনি কি জানেন এলিয়েনদের প্রিয় খাবার কী?
আমি মাথা নাড়লাম, না জানিনা।
সমস্যা নেই। আমার যেমন প্রিয় খাবার ভাত আর গরুর মাংস। এই খাবার খেয়ে উঠার পর আমাকে একটা পান মুখে দিতেই হয়। এমনিতে অবশ্য তেমন একটা খাইনা। ঠিক তেমনই ধরুন, আমার কোন এলিয়েন বন্ধুর প্রিয় খাবার এক বাটি কেঁচো বা তেলাপোকা খেয়ে আমরা দুজন মিলে কোন এক মোড়ের দোকানের বেঞ্চিতে বসে দুটো পান মুখে দিয়ে গল্প জুড়ে দিলাম। কত মজা হবে বলেন ব্যাপারটা?
আমি অনুভব করলাম, দৃশ্যটা কল্পনা করে আমার যতটা মেজাজ খারাপ হবার কথা ছিল- ততটা হলোনা। বরং মজিদ সাহেবের এমন শিশুদের মত সারল্য দেখে আমারও হাসি পেয়ে গেল। আমি তার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললাম।
দুপুরে আমি আর মজিদ সাহেব একসাথে লাঞ্চ করলাম। খেতে খেতে তিনি বললেন, খবর জানেন কিছু?
কোন খবর? আমি আগ্রহ নিয়েই জানতে চাইলাম।
মজিদ সাহেব গলা নামিয়ে এনে আস্তে করে বললেন, সরকার যে মানুষের বাচ্চা আমদানি বন্ধ করে দিচ্ছে?
তাই নাকি! সত্যি বলছেন? আমি বেশ অবাক হই। খবরটা আমি জানিনা। আমি জানতে চাইলাম, খবরটা তিনি কোথায় পেয়েছেন?
বিশ্বস্ত সূত্রে পেয়েছি। মজিদ সাহেবের জবাব।
বিশ্বস্ত সূত্রে পাওয়া বেশিরভাগ খবরই বিশ্বাস করা যায়না।
না করা গেলে আর কি করা। আমার কোন সমস্যা অবশ্য নেই তাতে। বাজারে পান বিক্রি তো আর বন্ধ হয়ে যাচ্ছেনা! বলেই তিনি হাসতে থাকেন। তার হাতে একটা নতুন পানের খিলি। সেটাকে সে মুখে পুরে দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
আমি মজিদ সাহেবের কথাটি তেমন গুরুত্ব দিলাম না। কেননা, মানুষের বাচ্চা আমদানি সরকারের একটি লাভজনক ব্যবসা। বাজারে এটির চাহিদা তুমুল। হুট করে সরকার এটি বন্ধ করে দিতে পারেনা। আর তাছাড়া মানুষের বাচ্চা এখন একটি জনপ্রিয় নিত্য প্রয়োজনীয় পন্য। বাজারে গেলে মানুষের বাচ্চার দোকানে রীতিমতো লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। মানব শিশুর কচি মাংস মানুষ এত পছন্দ করে!
আমার তাই মনে হয়না তথ্যটি সঠিক। ব্যাপারটা আমি ভুলে যাবার চেষ্টা করলাম। তবে খবরটিকে একেবারে উড়িয়েও দেয়া যায়না। কারণ যুগে যুগে কিছু ঘাস খাওয়া বুদ্ধিজীবী নামক বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী থাকে, যাদের কাজই হলো একটা স্মুথ সিস্টেমের পেছনে হুট করে বাঁশ ভরে দিয়ে চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকা।
★★★
সপ্তাহ খানেক পরের ঘটনা। রাতের খাবার খেয়ে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আমি একটা সিগারেট ধরালাম। আমার স্ত্রী ইভা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছিল। আমি শূন্যে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে তাকে লক্ষ্য করতে থাকলাম। পৃথিবীর সকল স্ত্রীদের ওই বিষয়টি কি কমন? যত ধনী বা দরিদ্র ঘরের বউ হোক- প্রত্যেকেই যতটা সম্ভব সেজেগুজে পরিপাটি হয়ে বিছানায় আসে। অথচ ছেলেরা সারা দুনিয়া চষে এসেও পারলে হাত পা না ধুয়েই বিছানায় শুয়ে পরতে চায়।
ইভা আমার সামনে এসে বসল। সে একটা সবুজ শাড়ি পরেছে। সাথে লাল রঙের স্লিভলেস ব্লাউজ। বুকের একপাশ থেকে আঁচল সরে গিয়ে আলো ছড়াচ্ছে। কী অদ্ভুত সুন্দরই না লাগছে ইভাকে! আমি হাত বাড়িয়ে তাকে আমার বুকের কাছে টেনে নিয়ে আসি। ওর পিঠের কাছে চুমু খাই।
শোন…- ইভা বলে।
হুম। ছোট্ট সাড়া আমার।
টুইটি দু’দিন ধরে বায়না ধরেছে চাইল্ড মিট খাবে।
টুইটি আমার মেয়ের নাম। ওর বয়স ছয় বছর। রান্না করে খাবার জন্য বাজার থেকে আমরা যে মানুষের বাচ্চাগুলো কিনে আনি সেগুলোও চার-পাঁচ বছর বয়েসী শিশু। কিন্তু তারা কেউ কথা বলতে পারেনা। তারা খুব ধীরস্থির, নড়ে কি চড়ে না। তাদের অনুভূতি ভোঁতা। সাড়া দেবার প্রবণতা যাচ্ছেতাই। মানুষের সাথে এদের আচরণ একেবারে হতাশাজনক। দেখতে মানুষের মত হলেও এরা আসলে ল্যাবে তৈরি মুরগি বা মেষ শাবকের মতই। সভ্য সমাজ তবু মানুষের মাংস না বলে সুন্দর একটা নাম দিয়েছে- চাইল্ড মিট।
আমি ইভাকে বললাম, দু’দিন ধরে খেতে চাইছে আর তুমি আমাকে আজ বলছ?
না মানে, তুমি এত ব্যস্ত ক’দিন ধরে… ইভা আমতা আমতা করে।
হুম… ব্যস্ততা অবশ্য কদিন ধরে একটু বেশিই। তুমি এক কাজ করতে পারতে। বাবাকে বলতে পারতে।
হ্যাঁ পারতাম। তবে ইচ্ছে করেই বলিনি। বাবার হাঁটুর ব্যাথাটা বেড়েছে খুব। সে বাজারে যেতে পারবে না।
ঠিক আছে, কাল অফিস থেকে ফেরার পথে আমজ নিয়ে আসব। আমি সমাধান দিয়ে দিই।
এই শোন, ফর্সা দেখে একটু মোটাতাজা একটা বাচ্চা আনবে। নিগ্রো বাচ্চা আনবে না। ওগুলোর মাংসও কেমন জানি কালো হয়- আমি খেতে পারি না। ঘেন্না লাগে।
আচ্ছা।
পরেরদিন অফিস থেকে ফেরার পথে আমি বাজার হয়ে এলাম। যেসব দোকানে মানুষের বাচ্চা সাপ্লাই দেয় এরকম সবগুলো দোকান ঘুরে ঘুরে আমি যারপরনাই হতাশ হলাম। কোন দোকানেই কোন বাচ্চা নেই। দু’একটা দোকানে একটা দুটা বাচ্চা আছে বৈকি- কিন্তু সেগুলো খাবার অযোগ্য। কোনটার একটা মাত্র চোখ, কোনটার পা লুলা, কোনটার আবার এক হাত নেই। আমরা সবজি কেনার সময় যেমন বেছে বেছে ভালোগুলো কিনে নিয়ে যাই, দোকানির ঝুড়িতে নষ্টগুলো সব পরে থাকে, এখানকার অবস্থাও ঠিক তাই। পয়সা দিয়ে এসব কেনার মানে হয়না। বাসায় ফিরতে ফিরতে আমার মনে হল, মজিদ সাহেবের কথাই তাহলে ঠিক।
খালি হাতে বাসায় ফেরার পর টুইটি খুব কান্না শুরু করল। সেই কান্না থামার কোন লক্ষন দেখা যাচ্ছিল না। একটা ছয় বছরের শিশু তারই বয়সের অন্য একটি শিশুর মাংস খাবার বায়না ধরে কাঁদছে বিষয়টি আমার মনকে একটুও বিচলিত করল না। পুরো ব্যাপারটিই আমার কাছে খুব স্বাভাবিক বলে মনে হতে থাকে। কিন্তু উপায় ছিল না। ফ্যামিলির সবাই মিলে কাঁদলেই বা কি করার আছে? এই সরকারের মাথা খারাপ হয়েছে কিনা কে জানে! হুট করে কেউ এমন ডিসিশন নেয়? এমন নির্মম একটা প্রস্তাবনা যে কে উপস্থাপন করল, আর রাতারাতি সেটা মন্ত্রীসভায় পাশও হয়ে গেল! কারা চালাচ্ছে এই দেশ! কিভাবে চালাচ্ছে! মানুষের প্রিয় একটি খাবার, ভাত ডালের মত একটা রেগুলার ফুড আইটেম, সেটাও আইন করে বন্ধ করে দিতে হবে? মানবিকতা জিনিসটাই আসলে এদের মধ্যে নেই।
অন্যকারো কথা জানি না, তবে আমি পরলাম ঘোর বিপদে। টুইটি প্রতিদিন নিয়ম করে কাঁদতে থাকল। তাকে কোনভাবেই বুঝানো গেল না যে, ওই মুহুর্তে বাজারে চাইল্ড মিট পাওয়া যাচ্ছেনা। বড় বড় ব্যবসায়ী আর আমলারা এটা নিয়ে কাজ করছে। খুব দ্রুতই একটা সমাধান তারা বের করে ফেলবে। এসব কথা টুইটির বুঝার কথা না, সে বুঝলও না। তার সাইরেন সে বাজিয়ে চলল নিয়মমাফিক সকাল সন্ধ্যা। অবস্থা চরম বিরক্তিকর হয়ে গেল আমার জন্য। সকালে ঘুম ভাঙে সাইরেনে। অফিসে যাই ভ্যা ভ্যা শুনতে শুনতে। অফিস থেকে ফিরে এসে আবার সেই ভ্যা ভ্যা সাইরেন যন্ত্রণায় জীবন হাবিয়া দোজখ হয়ে উঠল। ঠিক তখনই আমার মাথায় আক্ষরিক অর্থেই চমৎকার এক ভাবনা উঁকি দিয়ে গেল। একারণেই বুঝি বলে, প্রয়োজনই আবিস্কারের জননী!
২
পুরো বাসায় খাবারের অনন্য এক সুঘ্রাণ ছড়িয়ে পরেছে। আমরা সবাই খাবার টেবিলে রাতের খাবার খেতে বসেছি। টুইটি সবার আগে খেতে শুরু করে দিয়েছে। সে মাথার দু’পাশের দুটি বেণি দুলিয়ে দুলিয়ে একটা বড় হাড় চেটে চেটে খাচ্ছে।
বাবাকে জবাই করা সহজ ব্যাপার ছিলনা। লম্বা চওড়া আর বেশ স্বাস্থ্যবান মানুষ ছিলেন আমার বাবা। আবার মাকেও রাজী করানো যাচ্ছিল না। কথাটা শুনেই সে ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদতে শুরু করে দিল। খানিক সময়ের জন্য আমার মেজাজ চরে গিয়েছিল। প্রায় প্রতি মাসেই মানুষের মাংস খাচ্ছে অথচ এখন এমন ছেলেমানুষী করছে যেন কোনদিন ঝোলও চেখে দেখেনি।
যাইহোক, অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে মাকে রাজী করানো গেল। বাবার এখন বয়স হয়েছে- বাঁঁচবেই বা ক’দিন। শরীরে বাসা বেঁধেছে হৃদরোগ আর ডায়াবেটিসের মত জটিল রোগ। তারপর আবার ইদানীং হাঁটতে চলতে খুব কষ্ট হচ্ছে তার। বৃদ্ধ বাবা বিছানায় শুয়ে শুয়ে ব্যথায় কাতরাবে সেটা দেখার চেয়ে পরিবারের সবার হাসিমুখ দেখাটা কি বেশি আনন্দের নয়? আর বাবা যখন দু’দিন পর মারা যাবে, তখন তাকে কবর দিলে তো মাটিতে খাবে, পোকায় খাবে। শেয়াল কুকুরে মরা লাশটা টেনে-ছিঁড়ে খাবে৷ কী বিভৎস ব্যাপার! ভাবতেই গা শিউরে ওঠে আমার। তার থেকে এই দুর্মূল্যের বাজারে আমার অকর্মা বাবার কোন একটা গতি যদি করা যায় সেটাই কি ভালো না? বাবারও একটা গতি হয়, টুইটির ইচ্ছাও পূরণ হয়। আর তাছাড়া আমরাও তো অনেকদিন হয়ে গেল মানুষের মাংস খাইনা।
তাইতো! এমন অকাট্য সব যুক্তি বা বাস্তবতা যাই-ই বলিনা কেন- না মেনে মায়ের আর কোনও উপায় ছিল না।
আগেই বলেছি বাবাকে জবাই করা সহজ ব্যাপার ছিল না। আমি কোনও ঝামেলায় না গিয়ে বাজার থেকে দুইজন কসাই ডেকে আনলাম। আশ্চর্য, বাবাকে দেখার পর তারা তাদের মজুরির বাইরেও বাবার অর্ধেক মাংস দাবী করে বসল। অনেক মুলামুলির পর তাদের তিন ভাগের এক ভাগ মাংস দেবার কথা বলে রাজী করালাম। ভাবলাম কসাই হলেও তো তারা মানুষ। কসাই বলেই যে তারা প্রতিদিন মাংস ভাত খায় তা তো নয় নিশ্চয়ই। আর এখন তো বাজারে মানুষের মাংস পাওয়াই যাচ্ছেনা। আমি তাই রাজি হয়ে গেলাম। মানবিকতা বলে তো একটা ব্যাপার আছে নাকি?
পুরো ব্যাপারটায় বাবার প্রতিক্রিয়া ছিল ভীষণ রকম নির্লিপ্ত। শুধু তাকে যখন জবাই করার জন্য বাথরুমে ঢোকানো হচ্ছিল, তখন বাথরুমের দরজা ধরে দাঁড়িয়ে বাবা একই সাথে দুর্বোধ্য এবং তীব্র অসহায় এক দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়েছিল একবার। এক মূহুর্ত সময় আমার বুকের ভেতরটা যেন কেমন করে উঠেছিল। আমি অবশ্য সাথে সাথে নিজেকে সামলে নিয়েছিম এসব ছেলেমানুষী আবেগ গুরুত্ব দেবার কোনও মানে হয়না।
তরকারিটা ইভা অসাধারণ রান্না করেছে। সাথে বাসমতি চালের ভূনা খিচুড়ি। আমরা সবাই পরম তৃপ্তিতে খাচ্ছিলাম। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, মা কিছু খাচ্ছে না। সে আঙুলে শুধু ভাত নাড়াচাড়া করছে। আমি বললাম, মা, খাচ্ছো না যে?
মা কোনও কথা বলল না। হু হু করে কেঁদে ফেলল।
মা’র এমন কান্ড-কীর্তি দেখে আমার খুব বিরক্ত লাগলো। টুইটি খাওয়া বন্ধ করে অবাক হয়ে মা’র মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আমিও অবাক হয়ে বললাম, কী শুরু করলে মা বল তো?
আমি খেতে পারব না তমাল!
কি বল!
আমি খাব না।
কেন? কেন খাবে না মা?
আমি খেতে পারছি না।
ছেলেমানুষী করো না তো মা, খেয়ে নাও।
আমার খুব কষ্ট হচ্ছে রে! গলা দিয়ে ভাত নামবে না আমার।
মা শোন, না খেলে কষ্ট আরও বেশি হবে। এখন না খেয়ে ঘুমাতে যাবে, তারপর গ্যাস্ট্রিকের ব্যাথায় সারারাত কাতরাবে। বলবে বুক জ্বলছে, বমি পাচ্ছে, নাড়ি ছিঁড়ে যাচ্ছে।
এই কথা শুনে মা আমার দিকে মুখ তুলে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকল। তারপর শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছে বসে থাকল চুপচাপ। আমি বললাম, ওয়াশরুমে যেয়ে চোখে মুখে একটু পানি দিয়ে এসে খেতে বস। দেখবে ভালো লাগবে। কি যে ভালো রান্না হয়েছে মা!
মা কোনও কথা বলল না। তার চোখের ভাষাও আমি পড়তে পারলাম না। কিছুক্ষণ ঝিম ধরে বসে থেকে উঠে চলে গেল।
মিনিট পাঁচেক পর মা ফিরে এল। চেয়ার টেনে বসতে বসতে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ইভাকে বলল, বউমা, তরকারিতে ভাজা জিরার গুঁড়া দিয়েছ? ভাজা জিরা ছাড়া মাংসের তরকারি একদম মজে না।
মা’র কথা শুনে আমি মনে মনে খানিকটা হাসলাম। এই বুড়ো বয়সেও মা কি যে ছেলেমানুষী করে মাঝে মাঝে!
= © =
★ মুহম্মদ জাফর ইকবাল এর গল্প ছেলেমানুষী থেকে অনুপ্রাণিত।
লেখক
প্রকাশিত গ্রন্থঃ
সামাজিক উপন্যাস অনন্ত আগুন এবং কিশোর উপন্যাস বন্ধু বাহাদুর।
মোবাইলঃ ০১৬৮০-৫৬৭৮৯০
ইমেইলঃ hemantohasan99@gmail.com
লেখকের চিন্তা করার গভীরতা বিশাল